বাংলাদেশে করোনাভাইরাস: সংখ্যা ও বিভ্রান্তি
- অনুপম দেব কানুনজ্ঞ
- প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২০, ০৮:১৪ PM , আপডেট: ৩১ মার্চ ২০২০, ০৮:১৪ PM
করোনা সংকটে সংখ্যা নিয়ে আমরা খুব বেশি চিন্তিত। হিসেব কষে দেখাতে চাচ্ছি বাংলাদেশে কতজন আক্রান্ত হওয়া যুক্তিযুক্ত, কতজনের মৃত্যু৷ আগে একটু সংখ্যার মারপ্যাঁচ দেখে নেই।
অনেকেরই অভিযোগ, বাংলাদেশ সরকার করোনা নিয়ে সঠিক তথ্য প্রকাশ করছে না। বিপুল জনগোষ্ঠীর সরকার কর্তৃক প্রকাশিত তথ্যের প্রতি তীব্র অনাস্থা থাকায় এমন মনোভাব যেকোনো দেশেই তৈরি হওয়া স্বাভাবিক।
অভিযোগ রয়েছে, লক্ষণ থাকলেও অনেককেই পরীক্ষা করা হচ্ছে না, ফলে বাংলাদেশে প্রকৃত শনাক্তের সংখ্যা জানা যাচ্ছে না৷ এইসব অভিযোগ সত্যিও হতে পারে, মিথ্যাও হতে পারে। কিন্তু অনেকে এর পেছনে যুক্তি দাঁড় করাতে গিয়ে ইতালিসহ বিভিন্ন দেশের দিনপ্রতি আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়ার সঙ্গে বাংলাদেশে আক্রান্তের ধীরগতির তুলনা করছেন। এই সংখ্যাগত তুলনাটাই ভুল। কেন? সংখ্যার জবাবে সংখ্যা দিয়েই বলছি।
১) পৃথিবীর একেক দেশে টেস্টের জন্য একেকরকম নীতি নেয়া হয়েছে। কোনো দেশ মৃদু লক্ষণ দেখা দিলেও অনেককেই টেস্ট করছে, যাকে অ্যাগ্রেসিভ টেস্ট বলা হচ্ছে। এর উদাহরণ জার্মানি। অন্য অনেক দেশের চেয়ে এজন্যই জার্মানিতে শনাক্তের সংখ্যাও বেশি, কিন্তু মৃত্যুর সংখ্যা কম।
অন্যদিকে, যুক্তরাজ্য তীব্র লক্ষণ দেখা না দিলে বেশিরভাগ মানুষকেই টেস্ট করছে না, বরং বাসায় সেল্ফ কোয়ারান্টিনে থাকতে উৎসাহিত করছে। ফলে দেশটিতে শনাক্তের সংখ্যা কম হলেও সে তুলনায় মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। কোনো দেশই লক্ষণ না থাকলেও তার সব নাগরিকের টেস্ট করাচ্ছে, এমনটা হচ্ছে না। সেটা যৌক্তিক না, বাস্তবও না।
২) স্বাস্থ্যসেবায় উন্নত দেশগুলোতেও টেস্টের সংখ্যা সমান নয়। স্টাটিস্টার ২০ মার্চের তথ্য অনুযায়ী বলছি। তাইওয়ান প্রতিদিন গড়ে টেস্ট করছে প্রতি লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় ৯০ জনের। অন্যদিকে বাহরাইন প্রতি লাখ নাগরিকের জন্য প্রতি দিন ১০৯৮টি। কিন্তু দুই দেশেরই শনাক্ত আর মৃতের সংখ্যায় খুব বেশি তফাত নেই।
ফলে যে যত বেশি টেস্ট করবে, সে তত ভালোভাবে করোনা ঠেকাতে পারবে, এটা সবসময় সত্যি নয়। তবে হ্যাঁ, টেস্ট একমাত্র না হলেও অবশ্যই সংক্রমণ ঠেকানোর গুরুত্বপূর্ণ একটা হাতিয়ার। লক্ষণ থাকলেই টেস্ট করে আইসোলেশন বা কোয়ারান্টিনের পরামর্শ দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তবে সে টেস্ট লক্ষণযুক্ত মানুষ ও তার আশেপাশের মানুষের জন্য, একটা দেশের সব মানুষের জন্য নয়।
৩) ইতালিতে বয়স্ক লোকের সংখ্যা অনেক বেশি। ইউরোস্ট্যাটের তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ সালে দেশটির ২২.৬ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় চার ভাগের এক ভাগ মানুষের বয়স ছিল ৬৫ বছর বা তার ওপরে। আর করোনা সংক্রমণে মৃত্যুর ঝুঁকি তো এই বয়সে বেশি, এটা এরই মধ্যে প্রমাণিত।
অন্যদিকে স্টাটিস্টা বলছে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ৬৫ বা তার চেয়ে বয়স্ক মানুষের হার কেবল ৫.১৬ শতাংশ, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ ভাগের এক ভাগ।
১৪শ শতকে ইউরোপে মহামারি আকার নিয়েছিল প্লেগ, যা ইতিহাসে ‘ব্ল্যাক ডেথ’ নামে পরিচিত। প্রায় ২০ কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল মহামারিতে। ভেনিস কর্তৃপক্ষ নিয়ম জারি করে, বন্দরে কোনো জাহাজ ভিড়লে যাত্রীদের নামানোর আগে সমুদ্রে ৪০ দিন নোঙর করে রাখতে হবে। ৪০ সংখ্যাকে ইটালিয়ান ভাষায় বলা হয় কোয়ারানতা, আর অপেক্ষার সময়টিকে কোয়ারানতিনো। তখন থেকে সংক্রামক রোগের আশঙ্কায় কাউকে আলাদা করে রাখাকে কোয়ারেন্টিন বলা হয়।
৪) ফিনানশিয়াল টাইমস বলছে ইটালিতে যাদের শনাক্ত করা হয়েছে, তাদের গড় আয়ু ৬২। আর যারা মারা গিয়েছেন তাদের একটি বড় অংশের বয়স ৬০ বছরের উপরে। এর মানে কি কম বয়সের কেউ আক্রান্ত হচ্ছেন না? অবশ্যই হচ্ছেন, কিন্তু তাদের অনেককেই লক্ষণ না থাকায় টেস্ট করা হচ্ছে না, বা তারা সাইলেন্ট স্প্রেডার অর্থাৎ কোনো লক্ষণ টের পাচ্ছেন না।
ফলে পৃথিবীর কোন দেশে আসলে কতো সংখ্যক মানুষ করোনা আক্রান্ত, এর সঠিক সংখ্যা কেউ জানে না। বিজ্ঞানীদের ধারণা, সব আক্রান্তকে শনাক্ত করা গেলে মৃত্যু হার অনেক কমই হবে।
৫) নিশ্চয়ই আমরা এতোদিনে জেনে গেছি, যারা বয়স্ক এবং তাদের মধ্যে যাদের হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, ডায়বেটিস, হৃদরোগের মতো নানা জটিলতা রয়েছে, তারাই এই ভাইরাসের সংক্রমণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছেন। একই সঙ্গে বেশ কিছু জটিলতা থাকার বিষয়টিকে কোমরবিডিটি বলা হয়।
ইতালিতে এই কোমরবিডিটি নিয়ে অনেকেই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, মারাও গিয়েছেন। মৃত্যুর কারণ হিসেবে ইতালির স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বেশ উদার নীতি গ্রহণ করেছেন। ভাইরাসে আক্রান্ত কেউ মারা গেলেই তাকে করোনায় মৃত্যুর তালিকায় সংযুক্ত করা হচ্ছে।
এমনকি অনেক ক্ষেত্রে আগে ফুসফুসের সংক্রমণ বা নিউমোনিয়া ছিল, পরে করোনা সংক্রমণ ঘটেছে, এমন রোগীর মৃত্যুকেও এই তালিকায় ফেলা হয়েছে। ফলে কে আসলে হৃদরোগে মারা গিয়েছেন, কে নিউমোনিয়ায় মারা গিয়েছেন আর কে করোনাভাইরাসের কারণেই মারা গিয়েছেন, তা বোঝার কোনো উপায় নেই।
৬) আমরা কেবল ইতালিসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশ, অ্যামেরিকা, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতির তুলনা করছি। কিন্তু কী কারণে চীনের হুবেই প্রদেশের এতো কাছে থেকেও তাইওয়ানে সংক্রমণ এতো কম, সেটা বিবেচনায় আনছি না।
তাইওয়ানে প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয় ২১ জানুয়ারি। এখন দেশটির আক্রান্ত-মৃত্যুর হিসেব জানেন? জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বলছে প্রথম শনাক্তের ৬৯ দিন পর ৩০ মার্চ পর্যন্ত তাইওয়ানে মোট আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন ৩০৬ জন, মারা গিয়েছেন ৫ জন।
আমরা যে চীন, ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ নানা দেশের ১৪ দিন, ২১ দিন, ২৮ দিনের হিসেব দিচ্ছি, তাইওয়ানের ক্ষেত্রে তা মিললো না কেনো?
৭) ভাইরাসটির সংক্রমণ কোথায় কিভাবে হবে, এটি অনেকগুলো ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করে। একটু দেশের মানুষের হাইজিন, অর্থাৎ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, মেলামেশার ঘনিষ্ঠতা, পর্যটন, সীমান্তে কঠোরতা এমনকি আবহাওয়ার ওপরও এর অনেককিছু নির্ভর করতে পারে। কিন্তু ভাইরাসটি একেবারেই নতুন ও অপরিচিত হওয়ায় এখনই শতভাগ নিশ্চিত হয়ে কিছু বলতে পারছেন না বিজ্ঞানীরা।
তাইওয়ান আমাদের চেয়ে ধনী দেশ। তাহলে চলুন অপেক্ষাকৃত দরিদ্র আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তুলনা করি। ১৪ ফেব্রুয়ারি মিশরের কায়রোতে শনাক্ত হয় আফ্রিকা মহাদেশের প্রথম করোনা সংক্রমণ। আফ্রিকানিউজ বলছে, ৪৫ দিন পর ৩০ মার্চ পর্যন্ত পুরো মহাদেশের ৪৬ দেশ মিলিয়ে শনাক্ত হয়েছেন ৪,৭৬০ জন, মারা গেছেন ১৪৬ জন৷ ইউরোপের সংক্রমণের ক্রমবর্ধমান চিত্রের সঙ্গে আফ্রিকা মিললো? না।
৮) আফ্রিকা মহাদেশের ৫৪টি দেশের মধ্যে ৪৬টিতে সংক্রমণ ঘটেছে, ৮টিতে এখনও ঘটেনি। আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে বেশি করোনা সংক্রমণ ঘটেছে সাউথ আফ্রিকায়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সাউথ আফ্রিকার ঠিক মাঝখানে অবস্থিত লেসোথো নামের দেশটিতে কোনো সংক্রমণ নেই।
ম্যাপ খুলে দেখুন, লেসোথোর চারপাশে সাউথ আফ্রিকা৷ সাউথ আফ্রিকায় শনাক্ত হয়েছে ১,২৫০ জন, লেসোথোয় একজনও না৷ হিসেব মিললো? না।
৯) এবার একটু অন্যরকম সংখ্যার হিসেব৷ শুনতে খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু অপ্রিয় সত্য হচ্ছে সংখ্যা অনেকক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে ভীতি তৈরি করতে পারে৷ যেভাবে রীতিমতো ম্যাপ তৈরি করে আমরা পুরো পৃথিবীর পরিসংখ্যান দেখাচ্ছি, তাতে ভয় লাগাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি আরো কিছু সংখ্যা বলছি, শান্ত হয়ে একবার ভেবে দেখুন, তুলনা করে দেখুন।
* আমি যখন লেখাটি লিখছি, তখন বিশ্বজুড়ে নোভেল করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা ৩৭,০৮৩।
* ২০১৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি রিপোর্ট বলছে, প্রতি বছর বিশ্বে দুই লাখ ৯০ হাজার থেকে সাড়ে ছয় লাখ মানুষের মৃত্যু হয় মৌসুমি ইনফ্লুয়েঞ্জায়৷ এই রিপোর্ট পাবেন এখানে।
* ২০১৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে সাড়ে ১২ লাখ মানুষের। বাংলাদেশে সে বছর সড়কে মারা গিয়েছেন আনুমানিক ২০ হাজারের বেশি মানুষ। প্রায় প্রতি বছরেরই হিসেবটা এমন৷ এই মৃত্যুরও একটা ম্যাপ রয়েছে, দেখতে পারেন এখানে।
* বিশ্বে মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ, অর্থাৎ হৃদযন্ত্র ও রক্তচাপ সংক্রান্ত নানা রোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে পৃথিবীজুড়ে মানুষের মৃত্যুর ৩১ শতাংশই ঘটে এই কারণে। ২০১৬ সালের হিসেবে প্রায় এক কোটি ৭৯ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিলেন হৃদযন্ত্রের নানা রোগে। এই তথ্যটি দেখতে পারেন এখানে।
একবার চিন্তা করে দেখুন, ইনফ্লুয়েঞ্জা, সড়ক দুর্ঘটনা বা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর আশঙ্কা করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু তারপরও করোনার সংখ্যা নিয়ে এতো আতঙ্ক কেনো?
এর প্রথম কারণ, এমন বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ দ্রুত সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম ভাইরাস অন্তত গত ১০০ বছরে দেখা যায়নি। ইবোলায় মৃত্যুর হার গড়ে ৫০% হলেও এর সংক্রমণের গতি ছিল তুলনামূলক কম। অন্যদিকে নভেল করোনায় মৃত্যুর হার গড়ে ২-৩% বা তারও কম হলেও এটি সংক্রমিত হয় খুব সহজেই।
আর দ্বিতীয় কারণ আমাদের সংখ্যাপ্রীতি ও সংখ্যাভীতি৷ সড়ক দুর্ঘটনার উদাহরণই আবার টানছি। আট জেলায় আট জন মারা গেলে পত্রিকার ভেতরের পাতায় এবং টিভির স্ক্রলে খবর আসে। কিন্তু একটি দুর্ঘটনায় আট জন মারা গেলে সেটা প্রথম পাতা এবং ব্রেকিং এ জায়গা করে নেয়। আবার সেই আট জন একই পরিবারের হলে আমরা বিশেষ সংবাদসহ আরো বড় ট্রিটমেন্ট দেই। কিন্তু মৃত্যুর সংখ্যা তো সমানই, তাহলে? আমরা কী তাহলে মৃত্যুতেও গ্ল্যামার খুঁজি? চমক খুঁজি?
তাই বলে যেকোনো সংখ্যাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করতে বলছি না। আমার অনুরোধ, সংখ্যা অনেকক্ষেত্রে খুব বিভ্রান্তিকর হতে পারে। ফলে কেবল একপাক্ষিক চিত্র না দেখে আরো বিশদ অনুসন্ধান করাটা প্রয়োজন।
আমার পরামর্শ, সংখ্যায় ভয় পাবেন না। সংখ্যার কারণে বিভ্রান্ত হবেন না। আমরা বরং নিয়মিত হাত ধুই, নাক-চোখ-মুখে হাত না দেই, কয়েকটা দিন মানুষের ভিড় এড়িয়ে চলি। আর বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের তাদের কাজটা করতে দেই৷ এতে আমাদের সবার মঙ্গল।
সূত্র: ডয়েচে ভেলে