চাই প্রয়োজন বুঝে বিদেশি ভাষার ব্যবহার

  © টিডিসি ফটো

মানুষের স্বাভাবিকভাবে বসসাস আর জীবনধারণের জন্য ভাষা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। হোক সেটা লিখিত বা কথ্য কিংবা ইশারা ভাষা। সবগুলোর গুরুত্ব আমাদের কাছে অপরিসীম। পৃথিবীতে রয়েছে হাজার প্রজাতির ভাষা, যেগুলোর মাধ্যমে পৃথিবীর শত শত কোটি মানুষ তাদের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।

পৃথিবীর প্রত্যেকটি ভাষার রয়েছে নিজস্ব সম্মান ও মর্যাদা। কোন ভাষাকে ছোট বা খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই। হোক সেটা ঘোর শত্রুর ভাষা। শত্রুদের ভাষা হলেও সেই ভাষার প্রতি থাকতে হবে আমাদের সম্মান এবং শ্রদ্ধাও।

কিস্তু যদি কোন গোষ্ঠী তাদের ভাষাকে অন্য কোন গোষ্ঠীর উপর যাদের রয়েছে নিজস্ব ও স্বতন্ত্র ভাষা তাদের উপর জোর করে চাপিয়ে দেয় বা গুরুত্বপূর্ণ কোন ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে বাধ্য করে- তাহলে সেটা আর মেনে নেয়া যায় না। এতে সেই চাপিয়ে দেয়া ভাষাটির কোন দোষ নেই, ভাষার উপর যারা কর্তৃত্ব চালায় দোষটা হচ্ছে তাদের।

যেমনটা ঘেটেছিল ১৯৫২ সালে। যা সংগ্রামী বাঙ্গালী কোন ভাবেই মেনে নিতে পারেনি। এরই ফল স্বরুপ ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঘটেছিল বিশ্বের ব্যতিক্রমী এক আন্দোলন। যা দেশ, ভূখন্ড, অর্থ কিংবা ক্ষমতার জন্য নয়, সেই আন্দোলন হয়েছিল এক ভাষার জন্য। সেই ভাষাটি হল বাংলা ভাষা।

আন্দোলন হয়েছিল বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষার জন্য, নিজ ভাষায় কথা বলার অধিকার রক্ষার জন্য। যা পৃথিবীর ইতিহাসে আগে কখনও ঘটেনি। এমনকি এখন পর্যন্ত আর দ্বিতীয় কোন নজির পাওয়া যায়নি। তারা পেরেছিলেন! যেকোন সময় ছত্রভঙ্গ করে দিতে পারে, গুলি চালাতে পারে, তা জানা সত্ত্বেও ভাষার জন্য রাজপথে নেমেছিল সেই বীরেরা। তাদেরকে আমরা শ্রদ্ধার সাথে সালাম জানাই।

তাদের ত্যাগ আর পবিত্র রক্তের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীনভাবে বাংলা ভাষায় কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। শুধু আমরাই না, এই ভাষার উপর, এই আন্দোলনের উপর বিশ্বও দেখিয়েছে অনেক সম্মান। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেস্বর ইউনেস্কো তাদের প্যারিস অধিবেশনে ২১ শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। ২০০০ সাল থেকে জাতিসংঘের সদস্যদেশসমুহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে দিবসটি।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করতে একটা প্রস্তাব পাস হয়। এমনকি সিয়েরালিওন নামে একটি দেশতো তাদের দ্বিতীয় ভাষাও করেছে বাংলা ভাষাকে। তাই এই ভাষা আর ভাষা আন্দোলেনের গুরুত্ব যে কতটুকু তা বোঝার অপেক্ষা রাখে না।

কিন্তু কথা হচ্ছে আমরা এই ভাষার উপর এখন কতটুকু সম্মান দেখাতে পারছি? এখন আমরা নিজেরাই চাচ্ছি না এই ভাষার সম্মান নিতে এবং আমাদের নতুন প্রজন্মও দিন দিন বাংলা ভাষার সম্মানের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে।

১৯৮৭ সালের বাংলা ভাষা প্রচলন আইনে সকল সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানকে বিদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যাতিত সকল ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যাবহারের কথা বলা হয়েছে। কোন দেশের সরকারকেই দেশের আন্তর্জাতিক বিষয়ে আলোচনাসহ আরো অনেক বৈদেশিক সম্পর্ক বজায় রাখতে আন্তর্জাতিক ভাষার ব্যবহার করাটা জরুরী হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে অন্য ভাষার ব্যবহার করা কোন দোষের নয়।

ইংরেজি একটি আন্তর্জাতিক ভাষা। বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে চলতে হলে আমাদের অবশ্যই এই আন্তর্জাতিক ভাষাটা জানা দরকার। কিন্তু এই আন্তর্জাতিক ভাষার ব্যাবহারের পরিধিটাও আমাদের শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক কাজের মধ্যে সীমিত থাকা উঁচিত। আর কোন একটা ভাষা শেখা দোষের নয়। তেমনি শেখার উদ্যেশ্যে কোন ভাষার চর্চা করাও কোন দোষের নয়।

ভাষার সম্মান নির্ভর করে সেই ভাষাটা মানুষের মুখে বা কাগজে কিভাবে ব্যবহার হচ্ছে তার উপর। কোথাও বক্তৃতা করছেন সেটা যদি আন্তর্জাতিক কোন জরুরী আলোচনা কিংবা আন্তর্জাতিক মহলের কোন অনুষ্ঠান না হয়ে থাকে কিংবা শ্রোতাদের মধ্যে আন্তর্জাতিক মহলের গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি না থেকে থাকে, তাহলে সেখানে কেন ইংরেজিতে বক্তব্য প্রদান করতে হবে? এটা কি ইংরেজি ভাষার চর্চার উদ্যেশ্যে নাকি অন্য ভাষার প্রতি আপনার দক্ষতার প্রমাণ প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে?

আমাদের সাধারণ জনগণের মুখের ভাষার কথা বাদই দিলাম। আমাদের সুশীল সমাজের কিছু সুশীল নাগরিকদের টেলিভিশনের টকশোতে কিংবা গণমাধ্যমের সাক্ষাতকারে বাংলা বলার মাঝখানে কিছুক্ষণ ইংরেজি বলা বা কোন কোন বাক্য বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে বলে নিজেকে শিক্ষিত আধুনিকতার পরিচয় দেয়া যেন স্বাভাবিক দৃশ্য। শহরকেন্দ্রিক বিভিন্ন সভা কিংবা অনুষ্ঠানের বক্তাদের ভাষার দিকে লক্ষ করলে বোঝাই যায় না যে তারা বাংলার সাথে ইংরেজি ঢোকাচ্ছেন না ইংরেজির সাথে বাংলা?

ভাষার সম্মান শুধু টকশোতে, সাক্ষাতকারে কিংবা আধুনিক বক্তাদের মধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ নয়। আমাদের দেশের বিভিন্ন যায়গায় শহরে এমনকি প্রত্যেকটি বাজার কিংবা মোড়ে মোড়ে খেয়াল করলে বোঝা যাবে যে, আমরা বাংলা ভাষার প্রতি কতটুকু সম্মান দেখাচ্ছি। চারদিকে তাকালে বিভিন্ন দোকান এবং অফিস কার্যালয় গুলোর সামনে দেখা যাবে, স্পষ্টভাবে লেখা স্টোর, ভ্যারাইটিজ স্টোর, মার্কেট, শপিং মল ইত্যাদি।

এদের সাথে পাল্লা দিয়ে পিছিয়ে নেই আমাদের পরিবহন মালিকেরা। তারাও বিভিন্ন নামে ট্রাভেলস, এক্সপ্রেস, এন্টারপ্রাইজ ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকে। আবার আমাদের দেশীয় উৎপাদিত পণ্যের মোড়কে বাংলায় সব তথ্য দিতেও কার্পণ্য করি। পথে-ঘাটে, বাজারে এসবের দিকে তাকালে মনে হয় আমাদের দেশে পথে-ঘাটে, বাজারে বিদেশিদের চলাচল কত রমরমা। তাদের চলাচলে যাতে অসুবিধা না হয় সেই জন্যই আমাদের এই প্রয়াস।

সব থেকে অবাক করার বিষয় হচ্ছে, সেই লেখাগুলিও থাকে আবার বাংলা বর্ণতে। ‘ইন্টারন্যাশনাল’ লেখাটি দেখে না বুঝতে পারবে কোন ইংরেজ আবার না বুঝতে পারবে কোন কম শিক্ষিত বাঙ্গালী, যাদের সংখ্যাই আমাদের দেশে বেশি।

হ্যা, আপনি যদি মনে করেন যে আপনার পণ্যে, প্রতিষ্ঠানের কাজে বিদেশিরা যুক্ত আছেন কিংবা বিদেশীরাও আপনার ক্রেতা, তাদের সাথে প্রতিষ্ঠানের লেনদেন আছে বা হওয়ার সম্ভাবনা আছে সেক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো আপনি বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতেও লিখতে পারেন। তাই বলে ১৬ জন বিদেশির জন্য আপনি ১৬ কোটি মানুষের ভাষাটা একেবারে বাদ দিয়ে দিবেন কিংবা আংশিক ব্যবহার করবেন সেটা মানা যায় না।

তবে কিছু শব্দ আছে, যেগুলো ইতিমধ্যে বাংলায় ঢুকে গেছে। সেগুলোর ব্যবহার করাটাই শ্রেয়। কেননা ভাষা ব্যাবহারের মূল উদ্যেশ্যই হল শ্রোতা যাতে সেটা ভালভাবে বুঝতে পারে।

আমরা ভালো করেই জানি, আমাদের উচ্চশিক্ষিত সমাজ ইংরেজি জানলেও ইংরেজি ভাষা জানে কয়জন ? পরীক্ষায় পাসের জন্য কিংবা ভাল ফলাফলের জন্য যতটুকু জানা দরকার ৯৫ ভাগ শিক্ষার্থী তাই জানে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের দাপ্তরিক ভাষায় বাংলা ভাষার যতটা ব্যবহার দেখা যায়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তার কিঞ্চিত পরিমাণ খুজে পাওয়া যায় না।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি তাদের দাপ্তরিক কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে পারে, তাহলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কেন নয়? এতে সমস্যাটা কোথায়? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তো কোন কাজে বাংলার ব্যাবহার লক্ষ করাই যায় না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক অনুমোদনপ্রাপ্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নামের দিকে তাকালে বোঝা যায় বাংলা ভাষার প্রতি তাদের কতটা ভক্তি।

নামগুলো কি বাংলায় হতে পারত না? মানুষ কি চিনত না? একটা প্রতিষ্ঠানের নামইতো। এগুলো বলে আর লাভ নেই। জবাবদিহি চাইবে কে? ইউজিসি? হাইকোর্ট? উনাদের পরিচয়ও তো মানুষ এখন বাংলায় বলে না। অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানও তাদের ইংরেজি নামটা বাংলা বর্ণতে লিখে বাংলা ভাষার উপর সম্মান দেখাচ্ছে।

তাছাড়া আমাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো তো আছেই, এ মাধ্যমগুলোতে বাংলিশ যেন হচ্ছে বাঙ্গালীদের সার্বজনীন লেখ্য ভাষা। তাই শুধুমাত্র ভাষার মাসেই নয়, সবসময় যেন এই বাংলা ভাষা বেঁচে থাকে সম্মানের সাথে। এটাই কাম্য।

লেখক: শিক্ষার্থী, এম.বি.এ
আই.বি.এ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence