ভাষার গালগল্প

  © ফাইল ফটো

লিখছি বাংলায়। সুতরাং ভাষার গালগল্প বলতে বাঙলা ভাষার গালগল্পের কথাই বলছি। গালগল্প শব্দের আভিধানিক অর্থ কথাবার্তা। কিন্তু এর ব্যবহারিক অর্থ মিথ্যা কথা বলে নিজেকে গৌরব দান। ভাষার ক্ষেত্রে মিথ্যা কথায় কীভাবে নিজেকে (বা ভাষাকে) গৌরব দান করা যায়, তার উদাহরণ মনে হয় বাংলাদেশ।

ভাষাভিত্তিক পরিচয়কে আশ্রয় করে যে বাংলাদেশী আইডেন্টিটির সূচনা হল, সেই আত্নপ্রতিষ্ঠার, আত্নমর্যাদার জায়গাটিতে বাংলা ভাষার নিজস্ব অবস্থান আজ নড়বড়ে। উচ্চ আদালত থেকে শুরু করে নিন্মশ্রেণির দরকারি অদরকারি সকল কাজ চালানোর জন্য বাংলা ভাষা আজও স্থান করে নিতে পারেনি।

একমাত্র সাংবিধানিক স্বীকৃতি ছাড়া ভাষার প্রশ্নে আমরা উদাসীন। কর্মতৎপরহীন। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথমভাগের ৩ ধারায় বলা আছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য ভাষা আছে কিনা সেটিও সংবিধানের উল্লেখ করা হয়নি। এখন বাংলা ভাষার সাংবিধানিক মনোপোলাইজেশন করেও ভাষার দিক থেকে বাংলা ভাষা প্রজাতন্ত্রের জনগণের প্রথম শ্রেণির ভাষা হয়ে উঠেনি।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ‘বাঙালীর জাতীয়তাবাদ’ গ্রন্থে লিখেছেন ‘মানুষের পক্ষে ধর্মান্তরিত হওয়া যদি কঠিন হয়, ভাষান্তরিত হওয়া কঠিনতর’। আমার মনে হয় তাঁর আশঙ্কা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। অন্তত বলব বাঙ্গালী সেই ভাষান্তরিত হবার কাজটি করে দেখিয়েছে।

ভাষার প্রতি অবহেলা আমাদেরকে মাতৃভাষার পক্ষে না বিপক্ষে, সেই দায়মুক্তি দিয়েছে। অনেকে অবশ্য বলবেন, এখন ইংরেজির যুগ, বিশ্বায়নের যুগ। ভাষার মাপকাটির চেয়ে বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ স্থাপন করাটাই মুখ্য কথা। যার যেমন সুবিধা সে সেই ভাষায় ভাব আদানপ্রদান করতে পারে। আমিও একমত। কিন্তু ইংরেজি পড়ে এই বঙ্গে কোন দিন প্রতিভার বিকাশ হয়নি বা হবেও না।

মাতৃভাষার বিকাশ ব্যতীত, হোক সেটি বাংলা, চাকমা, সাঁওতালি, কিংবা অন্য ভাষা, মহাপ্রতিভা কিংবা সামান্য প্রতিভার শ্রীবৃদ্ধি সম্ভব নয়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত যা করতে গিয়েও পারেননি। ইউরোপ তাঁকে কবির মর্যাদা দেয়নি। পরবর্তীতে ‘বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন’ আবিষ্কারে তাঁকে নিজ মাতৃভাষারই আশ্রয় নিতে হয়েছে।

ইংরেজি ভাষা তখনই আমাদের জ্ঞানবিকাশের সহায়ক ভাষা হয়ে উঠবে, যখন আমরা ইংরেজিতে লেখা পাঠ্য নিজ ভাষায় অনুবাদ করে সাধারণ পাঠকদের হাতে তুলে দিতে পারব। ফেব্রুয়ারি আসলে ১৯৫২ সালের কথা সবার আগে চলে আসে। ভাষার প্রশ্নে আমাদের অশ্রুহীন আবেগ এই মাসেই নতুন করে দানা বেঁধে উঠে। তার চিহ্ন দেখা যায় শহরের তরুণ-তরুণীর পোশাকে অথবা বইমেলা নামক আনুষ্ঠানিক রীতিনীতিতে।

মাসের শুরুতেই বই মেলা বসে বাংলা একাডেমি এবং তার আশেপাশের প্রাঙ্গণজুড়ে। বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা অথবা উন্নয়ন করবার বিপরীতে দেশের অভিভাবকতুল্য এই প্রতিষ্ঠানকে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় মেলার স্টল নির্মানের কাজে। অথবা বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরষ্কার কে পাবেন- তা নিয়ে দলাদলি দরকষার দায়িত্ব পালন করতে।

স্টল নির্মানের স্বার্থে লক্ষ্মীর সাথে আত্নীয়তা রক্ষার দাবীতে সরস্বতীকে বিসর্জন দিয়ে সকলে এক জোট বাঁধেন। এক মাসের জন্য লক্ষ্মীকে আপন করতে গিয়ে সারা বছরের জন্য সরস্বতীকে ভুলে থাকেন। মাস গড়িয়ে একুশ তারিখ হলে প্রভাতফেরীতে নানান বয়সী মানুষকে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়।

৬৭ বছর আগের ভাষা আন্দোলন প্রভাতফেরীর মধ্য দিয়ে জীবন্ত হয়ে উঠে। দলে দলে মানুষের অংশগ্রহণই বলে দেয়, ভাষা আন্দোলন কোন মিথ ছিল না। মনে হয় বাঙালী সত্যি সত্যিই ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিল। ১৪৪ ধারা কিংবা বন্দুকের গুলি কিছুই সেই দিনের আন্দোলনকে ধাবিয়ে রাখতে পারেনি। বাঙালী প্রাণ দিয়েছে।

১৯৫২ সালের ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ বর্তমান বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে প্রশমিত করেছে। ভাষার জন্য আন্দোলন ক্রমশ স্বাধীন স্বদেশ ভাবনায় রূপান্তরিত হয়েছে। রাস্তায় হাটি। অনেক চেনাজানা শব্দে বাণিজ্যিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নাম দেখি। নামকরণের বেলায় দেশি শব্দের চেয়ে বিদেশী শব্দের প্রাধান্য। মনে হয় ভাষাগত দিক দিয়ে বাঙলা ভাষা উপনিবেশি রুপ ধারণ করেছে। স্বেচ্ছায় নিজ মুখমণ্ডলকে চিহ্নিত করেছে পরগাছার আদলে। নিজ ভূখণ্ডে মাতৃভাষা এলিয়েন হয়েছে।

বাঙলা ভাষার প্রতি কৃতজ্ঞ চিত্তের সকৃতজ্ঞ হবার চেষ্টায় আমাদের ক্লান্তিহীন অগ্রযাত্রা অব্যাহত আছে। বাংলা একাডেমি থেকে ২০০৯ সনে প্রকাশিত অরুণাভ সরকারের ‘লেখালেখি ও সম্পাদনা’ বইটিতে কবি আহসান হাবীবের কথা উল্লেখ করেছেন।

কবির বাংলা ভাষা প্রীতি সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ভাষার ব্যাপারে খুবই খুঁতখুঁতে ছিলেন কবি আহসান হাবীব। তাঁর বাসা ছিল ঢাকার মগবাজার এলাকায়। কর্মস্থল ডিআইটি (বা রাজউক) অ্যাভিনিউতে। যাতায়াত করতেন সব বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড, নেমপ্লেট ইত্যাদি দেখতে দেখতে। ভুল দেখলে খুব কষ্ট হতো তাঁর। সংশোধন করার অনুরোধ জানাতেন। সে কথায় কান দিত না কেউ।

তখন তিনি বলতেন, ‘ঠিক আছে, থাকুক ভুল। একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের মিছিল যাবে এই পথে। তখন মিছিলের কারও চোখ পড়লেই হয়’। কবির মন্তব্য শেষ করে লেখক লিখেছেন, ‘তখন কথায় কাজ হতো। এখন হয় না’।

লেখা শেষ করছি। বলার চেষ্টা করছি বাংলা ভাষার গালগল্প উপস্থাপন করার নানান কৌশল রয়েছে। ভাষার মানমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করবার জন্য শুধু সাংবিধানিক স্বীকৃতিই যথেষ্ট নয়। ১৯৫২ সনের ভাষা আন্দোলন বাংলাকে যে গৌরব দান করেছে তাকে নিত্যদিনের কার্যে প্রতিফলিত করতে না পারলে সেই গৌরব অগৌরবে রূপান্তরিত হবে।

বাংলা ভাষার প্রতি টান শুধু নীতিমালায় সীমাবদ্ধ থাকলেই হবে না, তাকে জাতির জ্ঞান বিকাশের প্রধান বাহন বানাতে হবে। বড় আফসোস হয় যখন দেখি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ বিভাগের নাম এখনও বিদেশী ভাষায় লেখা। অনেক বিভাগ তাদের নামকরণের বাংলা কি হবে সেই বিষয়েও সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনি। এই রকমের দুর্বল ভাষাতাত্ত্বিক দক্ষতা নিয়ে দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যলয় চলছে।

এই প্রজন্মের কাছে কবি আহসান হাবীব নাই। আছে শুধু সংবিধান। আর আছে বাংলা ভাষা নিয়ে মিথ্যা কথা বলার, মিথ্যা গৌরবের অংশীদার হবার বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক কর্মী, অথবা বাংলা একাডেমি।

লেখক: প্রভাষক, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence