এ কেমন সিনেট সদস্য!

  © ফাইল ছবি

ডাকসু নির্বাচনের কারচুপি ও অনিয়ম সম্পর্কে জানতে কারও বাকি নেই। সেখানে শেষ রাতে (রাত ৩.৩০ টার পর) ফলাফল পাল্টে ছাত্রলীগ মনোনীত প্যানেলের অধিকাংশকে জয়ী ঘোষণা করা হয়। এত রাতে কেন ফলাফল ঘোষণা করা হলো, এ বিষয়ে ডাকসু নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান গণিত বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক সাজেদা বানুকে আমি প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, OMR মেশিনে সঠিক রেজাল্ট প্রকাশ হয়েছিলো কি না, তা যাচাই-বাছাই করার জন্য আমরা পুনরায় হাতে রেজাল্ট গণনা করি (sample), যে কারণে রেজাল্ট প্রকাশ করতে দেরি হয়।

কি চমৎকার উত্তর!!

হাতেই যদি ভোট গণনা করবেন, তাহলে টাকা দিয়ে OMR মেশিন কেনার বা ভাড়া করার কি দরকার ছিলো? না কি OMR এর রেজাল্ট দেখে অবাক হয়ে গিয়ে আবার হাতে গণনা করেছেন (ছাত্রলীগের প্যানেল ব্যতীত অন্যদের বেশি ভোট পাওয়া দেখে!)।

ডাকসু নির্বাচনে আমাদের মাননীয় ভিসি স্যার অর্থাৎ ডাকসুর সভাপতির ভূমিকা কি?

তিনি যে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগকে জিতিয়ে দিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন, তার প্রমাণ প্রকাশ পেয়েছে উপাচার্য মহোদয়ের বিভিন্ন কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে। পরিবেশ পরিষদের মিটিং এবং অন্যান্য সকল মিটিংয়ে উত্থাপিত সকল ছাত্রসংগঠনের দাবি-দাওয়া উপেক্ষা করে তিনি শুধুমাত্র ছাত্রলীগের দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে এক অন্যন্য নজির স্থাপন করেছেন।

ডাকসু মনোনীত সিনেটের জন্য ৫ জন ছাত্র প্রতিনিধি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তিনিও যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তা তার বক্তব্যের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি বলেছেন, ডাকসু বহির্ভূত সদস্য সিনেট সদস্য হতে পারে। ডাকসুর যারা প্রতিনিধি আছেন, তারা চেয়েছেন বলেই এটা হয়েছে। এক্ষেত্রে আইনগত কোনো সমস্যা নেই বলেও মত দেন তিনি।
(সূত্রঃ The daily Campus)

কি বলছে ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ?

সেখানে বলা আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশের ২০(১)(এম) ধারায় বলা হয়েছে, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদই (ডাকসু) ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল মনোনীত করবেন।’ মূলত তারাই সিনেট সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

এই ৫ সদস্যের সিনেট সদস্য কি ডাকসু মনোনীত?

আসুন দেখে আসি। এক্ষেত্রে ডাকসুর সর্বোচ্চ ছাত্র প্রতিনিধি নুর বলেছেন, ডাকসুতে এধরণের কোন মিটিং হয়নি। এই সিনেট সদস্য ডাকসু মনোনীত নয়। এছাড়া ডাকসুর আরেক প্রতিনিধি, সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেনও একই কথা বলেছেন৷ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর জিএস গোলাম রাব্বানী ডাকসুতে আনুষ্ঠানিক ভোটাভুটির মাধ্যমে যে সিনেট সদস্য নির্বাচিত হয়েছে বলে দাবি করেছেন, তা পুরোপুরি মিথ্যা বলে জানিয়েছেন ভিপি নুরুল হক নুর ও সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন।

ডাকসুতে এ বিষয়ে মিটিং হবে, সেখানে ভিপি জানতে পারবে না, এটা কেমন ডাকসু? এই ডাকসু কি শুধুই ছাত্রলীগের জন্য?

কি বলছেন ছাত্রলীগ মনোনীত ডাকসুর অন্যান্য নেতারা?

ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে নির্বাচিত ডাকসুর সদস্য তানভীর হাসান সৈকত বলেন, ডাকসুতে আনুষ্ঠানিক আলোচনা না করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে৷ ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচিত ডাকসুর ক্রীড়া সম্পাদক শাকিল আহমেদ বলেন, ‘দলীয় ফোরামে হয়তো সিদ্ধান্ত হয়েছে, তবে আমি সে বিষয়ে অবগত নই।’

ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে নির্বাচিত ডাকসুর আরেক সদস্য রাকিবুল ইসলাম বলছেন, প্রাথমিক একটি আলোচনা হয়েছিল, তবে এভাবে যে চূড়ান্ত করে দেওয়া হবে, জানতাম না। ভোটাভুটির গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটি হওয়ার কথা ছিল, সেটিও করা হয়নি।

ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে নির্বাচিত ডাকসুর সদস্য নিপু ইসলাম বলেন, ‘আনুষ্ঠানিকভাবে ভোটাভুটি আসলে হয়নি। হয়ে থাকলেও আমি জানি না।’ (সূত্রঃ প্রথম আলো)

যেখানে ভোটাভুটির কথা ছাত্রলীগ মনোনীত ডাকসুর অন্য প্রতিনিধিরা জানেনা, সেখানে ৫ জন সিনেট সদস্য নির্বাচিত হয়ে গেলো?

এ কেমন ডাকসু? এই ডাকসু কি সাধারণ শিক্ষার্থীদের? নাকি ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণ করতে বৈধ ক্ষমতা অর্জনের জন্য করা হয়েছিলো ডাকসু নির্বাচন?

ভোটাভুটির বিষয়ে কি বললেন ডাকসুর জিএস গোলাম রাব্বানী?

তিনি ফেসবুকে একটি পোস্ট করেছেন৷ সেখানে তিনি সুস্পষ্ট ভোটাভুটির কথা ও ডাকসু এজিএস সাদ্দাম হেসেনের ত্যাগের কারণে ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর সিনেট সদস্য হয়েছেন সেটি তিনি উল্লেখ করেছেন।

সাদ্দাম ভাইয়ের ত্যাগের কারণে ভিপি হবে সিনেট সদস্য! বিষয়টি হাস্যকর না? একটি অপরাধ ও মিথ্যাচারকে ঢাকতে আরেকটি মিথ্যাচার।

অতীতে ৫ জন সিনেট সদস্য নির্বাচন করেছেন ভিপি ও জিএস। এবারও এমন করার কথা ছিলো। কিন্তু ভিপি যদি সিদ্ধান্ত নিতে পারতো, তাহলে তো ডাকসুর বাইরে অনির্বাচিত কেউ সিনেটে যেতে পারতো না, তাই ভিপিকে সাইড করে রেখে তার অজান্তে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ৫ জন সিনেট সদস্য নির্বাচন করা হয়েছে।

নুরুল হক নুরকে সিনেট সদস্য হিসেবে নিজের পদটি ত্যাগ করার বিষয়ে কি বলেছেন এজিএস সাদ্দাম হোসেন?

তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক উদারতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে নুরুল হক নুরকেও সিনেট সদস্য হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। ভিপিকে এজিএস ত্যাগের মানসিকতা দেখাবে কেন? ভিপিকে বাদ রেখেই সিনেটের জন্য ৫ জন ছাত্র প্রতিনিধি বাছাই করতেন। অন্যায় করে এখন উদারতা ও মানবতার বাণী শোনাতে আসছেন?

জোর করে, পেশীশক্তির বলে অনেক কিছু করা যায়, কিন্তু মানুষের ভালবাসা পাওয়া যায়না। এভাবে ৫ জন সিনেট সদস্য নির্বাচন করে (একজন নির্বাচনে পরাজিত হওয়া, আরেকজন নির্বাচনে কোন রকম প্রার্থিতা না করা) সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনে আরেকবার আঘাত করলেন। সাহস থাকলে সহমত ভাইদের ব্যতীত সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামত নিয়ে দেখুন যে, তারা বিষয়টি কিভাবে দেখছে।

আর দীর্ঘ ২৮ বছর পরও যদি অনির্বাচিতরা সিনেটের ছাত্র প্রতিনিধি হতে পারে, তাহলে দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে কেন ছাত্র প্রতিনিধি সিনেটে রাখলেন না? ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশের দোহাই দেবেন? এবার ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনে অধ্যাদেশ মেনেছেন? গঠনতন্ত্র অনুসারে এই প্রতিনিধিরা ডাকসু মনোনীত?

আর যদি অনির্বাচিতদেরকে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে রাখবেন তবে দুজনকেই কেন ছাত্রলীগ থেকে রাখলেন? গণতন্ত্রের চর্চা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা যদি নিশ্চিত করতে চান, তাহলে কেন বিরোধী ছাত্র সংগঠন থেকে অনির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধি সিনেটে যেতে পারবে না?  যেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আছেন, সেখানে অনির্বাচিতদের সিনেট সদস্য করার বিষয়টি কতটুকু যুক্তিযুক্ত? অনির্বাচিতরাই যদি সিনেট সদস্য হবে, তাহলে নির্বাচিতদের কাজ কি?

লেখক:যুগ্ম আহবায়ক
বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ


সর্বশেষ সংবাদ