আপসহীন নেত্রীর অনন্ত যাত্রা: কাঁদছে বাংলাদেশ
- প্রফেসর ড. সাইফুল ইসলাম
- প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:১৮ PM , আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:১৯ PM
১৯৯২ সালের জাকসু নির্বাচনে হল সংসদে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ব্যানারে এজিএস হিসেবে জয়ী হয়ে আমি কয়েকজন তরুণ ছাত্রনেতাসহ গিয়েছিলাম সুগন্ধায়—তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। সেই দিনটি আমার জীবনের স্মৃতিভাণ্ডারে স্থায়ী হয়ে আছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ ছাত্রনেতা হিসেবে তাঁর সামনে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। তাঁর চোখে-মুখে আমি যে দৃঢ়তা দেখেছিলাম, তার সঙ্গে ছিল এক অদ্ভুত মাতৃস্নেহের ছায়া—যা রাজনৈতিক নেত্রীদের মধ্যে বিরল। এরপর গুলশানস্থ দলের কার্যালয়ে বহুবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে—এবং প্রতিবারই বুঝেছি, তিনি নেতৃত্ব দেন শুধু ভাষণ দিয়ে নয়; নেতৃত্ব দেন উপস্থিতি দিয়ে, নীরব আত্মবিশ্বাস দিয়ে, আর সংকটে স্থির থেকে। আজ সেই স্মৃতিগুলো বুকের ভেতর ঢেউ তোলে, কারণ আপসহীনতার যে নামটি উচ্চারণ হলেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের দীর্ঘ এক সংগ্রামচিত্র চোখের সামনে ভেসে ওঠে, সেই নামই বেগম খালেদা জিয়া। তাঁর অনন্ত যাত্রার খবরে আজ কাঁদছে বাংলাদেশ—কাঁদছে শুধু একটি দল নয়, কাঁদছে একটি সময়, একটি প্রজন্ম, একটি সংগ্রামের ইতিহাস।
৩০ ডিসেম্বর(২০২৫) ঐতিহাসিক এই দিনে বেগম খালেদা জিয়ার মহাপ্রয়াণ শুধু বাংলাদেশকে নয়, পৃথিবীর বহু মানুষকেও স্পর্শ করেছে। সংবাদমাধ্যমে এসেছে, তিনি দীর্ঘ অসুস্থতার পর ৮০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। দেশের রাজনীতিতে দীর্ঘ সময় যে নেত্রীর নেতৃত্ব কয়েক প্রজন্মকে আলোড়িত করেছে—সেই যুগের এক প্রধান স্তম্ভ আজ ইতিহাসে চিরস্থায়ী হয়ে গেলেন।
বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নেতাদের কথা ভাবলে কয়েকটি শব্দ অবধারিতভাবে মনে পড়ে—ক্ষমতাবান, দূরদর্শী, প্রেরণাদায়ী, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং আপসহীন। মহান নেতাদের সম্মান করা হয়, কারণ তাঁরা নীতির প্রশ্নে আপস করেন না; তাঁরা বোঝেন, নেতৃত্ব মানে কেবল নির্দেশ দেওয়া নয়—নিজের আদর্শ দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। সেই আদর্শকে কাজে পরিণত করার সাংস্কৃতিক পরিবেশ তাঁরা নির্মাণ করেন, যাতে দলের লোকজন শুধু বিশ্বাসই না করে, বাস্তব জীবনের প্রতিটি কাজেও সেই মূল্যবোধ অনুশীলন করে। বেগম খালেদা জিয়া তেমনই এক নেতা—যাঁর নেতৃত্ব বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে, এবং দীর্ঘকাল ফ্যাসিস্ট শাসকের যাঁতাকলের মধ্যেও তাঁকে একটি বড় অংশের মানুষের কাছে ‘আস্থার’ নামে পরিণত করেছে।
খালেদা জিয়া ছিলেন গৃহবধূ—জনসম্মুখে খুব বেশি আসতেন না। মুক্তিযোদ্ধা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান (বীর-উত্তম) নিহত হওয়ার পরে বিএনপি যখন নেতৃত্বের সংকটে, বিভাজনের আশঙ্কায়, তখনই এক বিশেষ পরিস্থিতিতে তিনি রাজনীতিতে আসেন। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি বিএনপিতে যোগ দেন; এরপর সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হয়ে পরে চেয়ারপারসন হন। দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা, কর্মীদের মনোবল জাগানো, এবং প্রতিকূলতার মধ্যে সংগঠনকে বাঁচিয়ে রাখার কৌশল—এসবই তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রথম বড় দৃষ্টান্ত।
স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলন খালেদা জিয়াকে একটি শক্ত ভিত্তি ও ব্যক্তিত্ব গড়ে দেয়। আশির দশকে তিনি ৭–দলীয় ঐক্যজোটের নেতৃত্ব দেন। দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রাম, গ্রেপ্তার-হুমকি ও দমননীতি—এসবের ভিতর দিয়ে তিনি ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে পরিচিতি পান। ১৯৯০-এর গণআন্দোলনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। খালেদা জিয়া দেশের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন—এটি কেবল ব্যক্তিগত অর্জন নয়; একটি পুরুষশাসিত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নারীর ক্ষমতা-আরোহণের বড় ঘটনাও বটে।
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের বড় সাফল্য—তিনি ক্ষমতায় থেকেও এবং ক্ষমতার বাইরে থেকেও গণতন্ত্রের প্রশ্নটিকে কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে ধরে রাখতে পেরেছিলেন। তাঁর ২০০০ সালের সাক্ষাৎকারে একটি কথা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ- “বিভেদ-বিভ্রান্তির রাজনীতিতে আমি বিশ্বাস করি না; আমি বিশ্বাস করি উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের রাজনীতিতে।” এই বাক্যটি তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের সংক্ষিপ্তসার। রাজনীতি যখন ব্যক্তিগত আক্রমণ, ঘৃণা, বিভাজন ও প্রতিহিংসার ভাষায় দূষিত হয়, তখন একজন শীর্ষ নেতার মুখে “উন্নয়ন” ও “গণতন্ত্র”—এই দুই ধারণাকে একসঙ্গে উচ্চারণ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়—খালেদা জিয়া আন্দোলনে আপসহীন হলেও ‘সংলাপ’ ও ‘সমঝোতা’কে কখনো একেবারে অস্বীকার করেননি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বলেন, বৃহত্তর স্বার্থে তিনি প্রয়োজনে নিজের অবস্থান থেকেও সরে আসতে পারতেন। উদাহরণ হিসেবে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে যুক্ত করার প্রসঙ্গ এসেছে—প্রথম দিকে বিএনপি একমত না হলেও পরে জনদাবির বাস্তবতায় সেই ব্যবস্থাকে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে আনা হয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় এটিকে এক ধরনের বাস্তববাদী সিদ্ধান্ত হিসেবেও দেখা যায়—যেখানে সংঘাতকে কমিয়ে সাংবিধানিক পথে সমাধানের চেষ্টা থাকে।
বাংলাদেশে জোটভিত্তিক রাজনীতির একটি দীর্ঘ ইতিহাস আছে। খালেদা জিয়া দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ৭–দলীয়, পরে ৪–দলীয় এবং পরে ১৮–দলীয়/২০–দলীয় জোটের নেতৃত্ব দিয়েছেন। জোট রাজনীতির ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা একদিকে আন্দোলনকে ‘বৃহত্তর’ করে, অন্যদিকে রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রয়োজনীয় সমন্বয়ের পথ খুলেছে। কেউ এর সমালোচনা করবেন, কেউ এটাকে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বলবেন—তবু অস্বীকার করা যাবে না যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে “জোট” একটি বড় বাস্তবতা এবং খালেদা জিয়া সেই বাস্তবতাকে ব্যবস্থাপনায় পরিণত করতে পেরেছিলেন।
খালেদা জিয়ার জীবনপথে সবচেয়ে বড় পরীক্ষাগুলো এসেছে সংকটের সময়ে—গ্রেপ্তার, মামলা, কারাবাস, অবরুদ্ধ করা, ্পারিবারিক শোক এবং রাজনৈতিক
নিপীড়ন। এসব ঘটনার মধ্যেও তিনি একটি বার্তা রেখে গেছেন—দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার চাপ থাকলেও তিনি দেশ ছাড়তে চাননি; বরং বারবার “এ দেশের মাটি-মানুষই আমার ঠিকানা”—ধরনের অবস্থানকে রাজনৈতিক নৈতিকতার অংশ করে তুলেছিলেন। সংকটের সময়ে দলের নেতাকর্মীদের পরিবার-পরিজনের খোঁজ নেওয়া, কর্মীদের মনোবল জাগানো, সংগঠনকে ভাঙনের হাত থেকে টেনে তোলা—এসব কাজ তাঁকে দলের ভেতরে ঐক্যের কেন্দ্র করে রেখেছে।
শুধু তাই নয়—দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকলেও জনগণের একটি বড় অংশের কাছে তিনি ‘সম্মান’ ধরে রাখতে পেরেছেন। রাজনৈতিক জীবনের শেষ ভাগে এসে তিনি বিএনপির ঐক্যের প্রতীক থেকে ধীরে ধীরে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক—এই এক প্রতীকী অবস্থানে পৌঁছান—এমন মূল্যায়নও উঠে আসে। রাজনীতিতে এই রূপান্তর খুব কম নেতার ক্ষেত্রে ঘটে; কারণ, দলীয় সীমারেখা পেরিয়ে ‘মর্যাদা’ অর্জন করতে হলে চরিত্র, ভাষা, স্থৈর্য ও দীর্ঘ পরীক্ষার ভিতর দিয়ে যেতে হয়।
খালেদা জিয়ার সাফল্যকে এক লাইনে বাঁধা যাবে না, তবে কয়েকটি দিক উল্লেখযোগ্য—স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব: এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ৭–দলীয় জোটের নেতৃত্ব দিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে সংগঠিত করেছেন। প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়া- পুরুষশাসিত রাজনৈতিক পরিসরে নারীর ক্ষমতায়ন ও নেতৃত্বের এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন। সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারাকে প্রভাবিত করা- আন্দোলন-নির্বাচন-সরকার—সব পর্বে সংসদীয় ব্যবস্থার দাবিকে সামনে রেখেছেন। জোট রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা- রাজনৈতিক বাস্তবতায় জোট ও সমঝোতার কৌশল দিয়ে বড় আন্দোলন ও নির্বাচনী জোট নির্মাণ। সংকটে অটল থাকা ও রাজনৈতিক স্থৈর্য- দীর্ঘ দমননীতির মধ্যেও ভেঙে না পড়ে নেতৃত্ব ধরে রাখা—একটি বিরল ব্যক্তিত্বের পরিচয়।
বেগম খালেদা জিয়া—একজন ব্যক্তি নন; তিনি একটি সময়, একটি সংগ্রাম, একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতীক। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সমালোচনা আছে—কিন্তু তাঁর জীবনের যে রেখাটি সবচেয়ে উজ্জ্বল, তা হলো গণতন্ত্রের প্রশ্নে দীর্ঘস্থায়ী উপস্থিতি, সংকটে ধৈর্য, এবং মানুষের কাছে মর্যাদার জায়গা। আজ তাঁর প্রয়াণের পর আমরা কেবল একজন নেত্রীকে হারালাম না; আমরা হারালাম একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক যুগের এক প্রধান চরিত্রকে—যাঁর নাম বাংলাদেশের গণতন্ত্র, আন্দোলন, ক্ষমতা ও বিরোধিতা—সব আলোচনার মধ্যেই বারবার ফিরে আসবে। তাঁর নিজের ভাষায়—‘বিভেদ নয়, উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের রাজনীতিই হোক জাতির পথচলা।’ এই কথাটি আজ তাঁর স্মৃতির জন্যও এক বড় শিক্ষা হয়ে থাকল।
পরিশেষে বলতে চাই, আজ যখন নেত্রীর অনন্ত যাত্রায় বাংলাদেশ অশ্রুসজল, তখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে—বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন কেবল একজন রাজনৈতিক নেত্রী নন, তিনি ছিলেন একটি আদর্শ, একটি সাহসী অবস্থান। দমন-পীড়ন, মামলা, কারাবাস কিংবা ব্যক্তিগত শোক—কোনোটিই তাঁকে নীতির প্রশ্নে নত করতে পারেনি। ইতিহাস তাঁর বিচার করবে নেতৃত্বের দৃঢ়তা, ত্যাগের মহিমা ও গণতন্ত্রের প্রতি অবিচল আনুগত্যের আলোকে। দেহাবসানের মধ্য দিয়ে তাঁর পথচলা শেষ হলেও, আপসহীনতার যে বীজ তিনি বুনে গেছেন, তা থেকেই আগামী দিনের বাংলাদেশ গণতন্ত্রের শক্তি সঞ্চয় করবে। তাঁর নাম উচ্চারিত হবে শ্রদ্ধায়, তাঁর স্মৃতি বেঁচে থাকবে সংগ্রামের দীপ্ত প্রতীক হয়ে—কারণ আপসহীন নেত্রীর এই যাত্রা শেষ নয়, এটি ইতিহাসে অনন্ত।
লেখক: সাবেক চেয়ারম্যান, থিয়েটার এন্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়