বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা বিস্তারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা
কালের ব্যপ্ত পরিসরে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
- এম এ মতিন
- প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:৩৯ PM , আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:৪৭ PM
ভূমিকা: বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মূলত তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে: পাবলিক (সরকারি মালিকানাধীন), বেসরকারি (বেসরকারি মালিকানাধীন) এবং আন্তর্জাতিক (আন্তর্জাতিক সংগঠন কর্তৃক পরিচালিত) বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, যা দেশের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশে বর্তমানে ৫৬টি সরকারি ও ১১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রথম সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এগুলো বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) অধিভুক্ত। ইউজিসি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি আদেশ (১৯৭৩ সালের পি.ও. নং ১০) অনুযায়ী গঠিত একটি কমিশন। এ ছাড়াও রয়েছে ৩টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিশ্ববিদ্যালয়। এগুলো হলোঃ ১। ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলোজি (আই ইউ টি), গাজীপুর ২। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর ওম্যান (এ ইউ ডাব্লিউ), চট্টগ্রাম, এবং ৩। সাউদার্ন এশিয়ান ইউনিভার্সিটি (এসএইউ), দিল্লি।
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা বিস্তারে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৯৯২ সালে বিএনপি'র শাসনামলে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিশেষ অনুকুল্যে সরকার ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৯২’ পাশ করেন। পরবর্তীকালে ২০০৮ সালে আইনটি সংশোধন করে ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০’ অনুমোদিত হয় যা আজ অবধি চলমান। দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসেবে সর্বপ্রথম দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৮৯), ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস, এগ্রিকালচার আন্ড টেকনোলজি (আই ইউ এ বি এ টি (১৯৯১), নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়(১৯৯২) এবং একাদশতম ক্রমধারায় এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (এইউবি) (১৯৯৬) প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বর্তমানে এশিয়ান ইউনিভার্সিটির স্থায়ী ক্যাম্পাস সাভারস্থ আশুলিয়ার খেজুরবাগান এলাকার টংগাবাড়িতে প্রায় বিশ একর সবুজে ঘেরা নয়নাভিয়াম জায়গায় দশতলা বিশিষ্ট বৃহাদাকার ভবনে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এ ইউ বি এ’ র শিক্ষাপ্রদান কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে ৪ জানুয়ারী, ১৯৯৬ শুরু করলেও এর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এটির পরিকল্পনা শুরু হয়েছেল ১৯৮৮ সালে। এ ইউ বি’র প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, গবেষক ও অর্থনীতিক প্রফেসর ড. আবুল হাসান এম সাদেক ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি, মালয়েশিয়া (আই আই ইউ এম)- এ কর্মরত থাকাকালীন সময়ে তিনি বাংলাদেশে বেসরকারি পর্যায়ে উচ্চশিক্ষা প্রদানের বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছিলেন এবং তা তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের গোচরিভূত করেছিলেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়য়ের তৎকালীন সচিব জনাব ইরশাদুল হক, (সি এস পি) এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. এম এ বারী প্রফেসর সাদেক–এর বাংলাদেশে বেসরকারি পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ধারনাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশে বেসরকারি পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পেছনে যাদের চিন্তাভাবনা, মেধা ও মনন কাজ করেছে তাদের মধ্যে প্রফেসর সাদেক অন্যতম। তাঁর চিন্তাজগতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাটি এসেছিল বাংলাদেশের গ্রামীণ পশ্চাদপদ এলাকার দরিদ্র অথচ উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী ছাত্রছাত্রী ও বিভিন্ন চাকরিতে নিয়োজিত ব্যক্তিদের উচ্চশিক্ষায় সহায়তা করার সুযোগ সৃষ্টির প্রয়াস থেকে। তাই দ্বৈত শিক্ষাদান পদ্ধতির (অনলাইন এবং অফলাইন) মাধ্যমে এই পশ্চাদপদ দরিদ্র শিক্ষিত জনগোষ্ঠির নিকট উচ্চশিক্ষা সহজলভ্য করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। এই পদ্ধতিতে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাদান করে আসছিল। পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যলয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউ জি সি) কতৃক প্রকাশিত ‘হ্যান্ডবুক ফর প্রাইভেট ইনিভার্সিটিস অফ বাংলাদেশ’ শীর্ষক বই এ প্রফেসর সাদেক কে বাংলাদেশে দূরশিক্ষণ পদ্ধতি প্রবর্তনের স্বপ্নদ্রষ্টা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
২০০৯ সনে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত “হ্যান্ডবুক: ইউনিভার্সিটিস অব বাংলাদেশ ২০০৯” (Handbook: Universities of Bangladesh) র্শীষক বইয়ের ২০৩ পৃষ্ঠায় যা লিখিত আছে তা এখানে হুবুহু উদ্ধৃত করা হলো।
“Inspired by the concept of dual mode of education overseas, Professor Dr. Abul Hasan M. Sadeq made efforts in late eighties to establish a dual mode university in Bangladesh for providing quality education to as many people as possible in the country from an interdisciplinary integrated ethico-human approach reflecting our values, heritage and principles. He could not succeed to accomplish this goal at that time since no legal framework existed in the country for establishing such a venture in the private sector. After enactment of Private University Act, 1992. Professor Sadeq took initiative again for establishing a dual mode university. Finally, Asian University of Bangladesh was established in 1996. Professor Dr. Abul Hasan M. Sadeq is the Founder and Founder Vice-Chancellor of the university. At present it is managed by Asian University of Bangladesh Trust”.
পূর্বেই বলা হয়েছে- উচ্চশিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে এবং দক্ষ ও যোগ্য জনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে তৎকালীন সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৯২’ অনুমোদন করে। পরবর্তীকালে ২০০৮ সালে আইনটি সংশোধন করে ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০’ অনুমোদিত হয় যা আজ অবধি চলমান। ১৯৯২ সালের পূর্বে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা ছিল একচেটিয়াভাবে সরকারি খাতের ডোমেইন। যাহোক, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মক্ষমতা নানাবিধ কারণে গুরুতরভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কারণগুলোর মধ্যে অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, যেমন- স্থানের সীমিত প্রাপ্যতা, শ্রেণীকক্ষ, শিক্ষক, সম্পদ, সেশন জ্যাম বা অ্যাকাডেমিক ব্যাকলগ, রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সহিংসতা এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সশস্ত্র সংঘর্ষ এবং এগুলোর ক্রমবর্ধমান প্রবাহ অন্যতম। উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের এই চ্যালেঞ্জগুলির পাশাপাশি, চাহিদা সরবরাহের তীব্র ব্যবধান যা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একা মোকাবেলা করতে সক্ষম ছিল না। এই পরিস্থিতিতে উচ্চশিক্ষা খাতে কতিপয় বেসরকারি উদ্যোক্তা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খোলার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
স্মর্তব্য, নব্বইয়ের দশকের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে অনেক শিক্ষার্থী আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয় পড়াশোনার জন্য চলে যেত। এতে মেধা পাচার ও বৈদেশিক মুদ্রার বিপুল অপচয় হতো। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ সংখ্যা প্রায় শূণ্যের কোঠায় নেমে এসেছে। সুতরাং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যুগের চাহিদাসম্পন্ন সাবজেক্ট অনুমোদন দেওয়া হলে এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করা হলে দেশেই বিভিন্ন সেক্টরের দক্ষ মানবশক্তি তৈরি সম্ভব হবে এবং বিপুল অর্থের সাশ্রয় হবে। বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়বে এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম উৎস হতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৫৬টি সরকারি ও ১১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু আছে।
বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা
ব্রিটিশ আমল (১৮০০-১৯৪৭)
স্যার চার্লস উড (১৮০০–১৮৮৫) বৃটিশ আইন সভার সদস্য এবং ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বোর্ড অফ কন্ট্রোলের সভাপতি ছিলেন (১৮৪৬-৫২)। বৃটিশ সরকার তথা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ১৮৫৪ সালে ভারতবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষে চার্লস উড কে প্রধান করে একটি উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন করেন। ইতিহাসে এই কমিশন ‘উড কমিশন’ নামে পরিচিত। তখন ভারতবর্ষের গভর্ণর জেনারেল ছিলেন লর্ড ডালহৌসি (১৮৪৮-৫৬)। চার্লস উড ডালহৌসির নিকট ১৮৫৪ সালে কমিশনের রিপোর্ট পেশ করেন। ইতিহাসে এই রিপোর্ট ‘উড’স ডেসপ্যাচ অন এডুকেশন ১৮৫৪’ (Wood's Dispatch on Education, 1854) নামে পরিচিত। উড’স ডেসপ্যাচকে ভারতে উচ্চশিক্ষার 'ম্যাগনা-কার্টা' হিসাবে বিবেচনা করা হয়। উড কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতেই লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে ১৮৫৭-৮৭ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩০ বছরে ভারতবর্ষে মোট ৩টি বিশ্ববিদ্যালয় (বোম্বে, মাদ্রাজ ও কলকাতা) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরবর্তিতে আরও ২টি (পাঞ্জাব ও এলাহাবাদ) বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর ১৯১৬-৪৭ পর্যন্ত ৩১ বছরে ভারতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৭টি। তখন ভারতবর্ষের (পাক-ভারত-বাংলাদেশ) জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৩৯ কোটি। আর এখন ১৪২ কোটি লোকের দেশ ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১১৩ টি (সরকারি, বেসরকারি)। অপরপক্ষে ১৭.৫০ কোটি জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশে বর্তমানে ১৭২টি বিশ্ববিদ্যালয়। এগুলোর মধ্যে ৫৬টি সরকারি ও ১১৬টি বেসরকারি পর্যায়ের। চার্লস উড কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে এই উপমাহাদেশে বোম্বে, মাদ্রাজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নজির উপমাহাদেশে আরও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ভিত্তি ও সম্ভাবনা সৃষ্টি করে ও এই ধারাবাহিকতায় ১৯১২ সালে ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ব্যারিস্টার স্যার রবার্ট নাথান -এর সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই ১৯২১ সালের জুলাই মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। পূর্ববঙ্গের মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির উন্নয়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ রদের প্রেক্ষাপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপিত হইয়েছিল। বৃটিশ আমলে বাংলাদেশে স্থাপিত একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
পাকিস্তান আমল (১৯৪৭ – ১৯৭১)
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৩): পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দেশের উত্তরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষা বিস্তারে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচনে সাহায্য করে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) (১৯৬১) ১৯৬১ সালের ১৮ আগস্ট ময়মনসিংহে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের তৃতীয় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রথম বিশেষায়িত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষাঙ্গনের আয়তনের দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) (১৯৬২) হচ্ছে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় প্রকৌশল- সম্পর্কিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এটি ঢাকা শহরের লালবাগ থানার পলাশী এলাকায় অবস্থিত। কারিগরি শিক্ষা প্রসারের জন্য ১৮৭৬ সালে ঢাকা সার্ভে স্কুল নামে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীভুক্ত আহসানউল্লাহ স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পরিণত হয়ে কারিগরি শিক্ষা প্রদান করতে থাকে। ১৯৬২ সালে এটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চতুর্থ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার পরে এর নাম হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬৬): চট্টগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৭০): বাংলাদেশের প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে। জাবি একটি সুশৃঙ্খল শিক্ষা পরিবেশ নিশ্চিত করতে সহায়ক হয়।
বাংলাদেশ আমল (১৯৭১-বর্তমান পর্যন্ত)
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ সংসদে পাশকালে দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মাত্র ৬টি। এগুলোর মধ্যে জেনারেল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত ছিল ৪টি (ঢাবি, জাবি, চবি ও রাবি) এবং স্পেশালাইজড বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ২টি (বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়)। স্বাধীনতার সময় দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি আর এখন সাড়ে সতেরো কোটি আর দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা সর্বমোট ৬১টি।
১৯৭১ সালের পর শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠন হয় এবং প্রযুক্তি, কৃষি, চিকিৎসা ইত্যাদি বিশেষায়িত ক্ষেত্রে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
মোটকথা, উনিশ শতকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা শুরু হলেও, স্বাধীনতার পর থেকে এই ধারা অব্যাহত আছে এবং বর্তমানে এটি একটি বহুস্তরীয় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ রূপ ধারণ করেছে।
বিশ্বায়নের এ যুগে তথ্যপ্রযুক্তির আকাশচুম্বী সফলতা, বিজ্ঞান, গবেষণা, স্যাটেলাইট প্রযুক্তি, চিকিৎসাবিজ্ঞান, যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্যের আন্তর্জাতিক প্রচার ও প্রসার—সব কিছুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে উচ্চশিক্ষা নিশ্চিতকরণ ও উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি কিছুসংখ্যক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে অবদান রেখে চলছে। দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, উৎপাদন শিল্পকারখানা, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বিজ্ঞান ও গবেষণাচর্চামূলক প্রতিষ্ঠানে দক্ষ জনবলের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি প্রায় সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে নেই। আন্তর্জাতিক র্যাংকিং এ বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে সম্মানজনক স্থান লাভ করতে সক্ষম হয়েছে।
টাইইমস হায়ার এডুকেশন তাদের নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিংয়ের বাইরেও ‘নবীন বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিং’ নামে আরেকটি র্যাংকিং করে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বয়স হতে হয় সাধারণত অনূর্ধ্ব ৫০ বছর। বয়সভিত্তিক এই র্যাংকিংয়ে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম হয়েছে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় (৩০১-৩৫০) ও দ্বিতীয় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় (৩৫১-৪০০)। তৃতীয় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (৪০১-৫০০)।
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ উল্লেখিত বৈশ্বিক র্যাংকিং এ উচু স্থান লাভ করতে না পারলেও উচ্চশিক্ষা বিস্তারে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৯৯৬ সালের ৪ জানুয়ারী ৫টি ফ্যাকাল্টি ও ১২ টি বিভাগ নিয়ে স্বল্প সংখ্যক ছাত্র নিয়ে এর যাত্র শুরু হলেও অতি অল্প সময়ের মধ্যে এর সুনাম সারা দেশে এমন কি বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে এর ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং সাফল্যের সাথে যোগ্য গ্রাজুয়েট বের হতে থাকেন। বিদেশী ছাত্রছাত্রীও আসতে থাকেন। এ যাবত প্রায় ২ লক্ষাধিক গ্রাজুয়েট এশিয়ান ইউনিভার্সিউটি থেকে বের হয়েছে এবং তারা বাংলাদেশ ও বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উচু পদে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং করছেন। এ ইউ বি ছাড়া অন্যান্য যে সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা বিস্তারে কাজ করে যাচ্ছে সেগুলোর ভূমিকাও প্রশংসনীয়। ইউ জি সি’র হিসেব (২০২৩) মতে বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৪.৫ থেকে ৫.০ লক্ষের মত।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও এ কথা সত্য যে, বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণকারি সংস্থা ইউজিসি’র সহযোগিতামূলক মনোভাবের জায়গায় অতিনিয়ন্ত্রণ ও অযাচিত চাপ সৃষ্টির প্রবণতার কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যলয়গুলোর অগ্রগতির পথে বাঁধা সৃষ্টি হচ্ছে। এই অতিনিয়ন্ত্রণ ও চাপের বড় উদাহরণ হচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে বাধ্য করা। যদিও বা নব অনুমোদিত বেশকিছু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ভাড়া বাড়িতে দীর্ঘদিন থেকে ধুঁকে ধুঁকে তাদের শিক্ষাক্রম চালানোর উদাহরণ রয়েছে। এ ছাড়া বছরে কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালকে ২ টির বেশি বিষয় খোলার অনুমোদন দেয়া হচ্ছে না। অনুষদ, অবকাঠামো ও তথ্যপ্রযুক্তিগত সামর্থ্য ও দেশ বিদেশে সুনাম থাকা সত্ত্বেও এম ফিল ও পিএইচ ডি প্রোগ্রাম খোলার অনুমোদন দেয়া হচ্ছে না। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো– যে সকল শিক্ষক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি পান তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতাকে চাকরির ক্ষেত্রে গণনা করা হয় না। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পরিবর্তন করা এমন শিক্ষকের সংখ্যা একেবারে কম নয়। অনেকেই এ বিষয়ে তাদের ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিকট আমাদের দাবি: ক. একটি আলাদা কমিশন গঠন করা যেতে পারে। খ. এই কমিশনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। গ. শিক্ষার মান ধরে রাখার জন্যে কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। ঘ. গবেষণখাতে সরকারি গ্র্যান্ট/অনুদানের বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে।
কিন্তু বিপুল সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলাদেশের সব পর্যায়ের শিক্ষার গুণগত মান সম্পর্কে দেশী ও বিদেশী বিভিন্ন পর্যায়ে প্রশ্ন উঠছে। প্রশ্ন উঠছে শিক্ষাব্যবস্থাপনার দক্ষতা ও গুণগত মান অর্জন নিয়ে, শিক্ষার সকল স্তরে দুর্নীতির রাহুল গ্রাসের থাবা বিস্তারের ভয়াবহ অবস্থা নিয়ে। শিক্ষায় অনুদান প্রদানকারী প্রথম সারির উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে পরিচিত বিশ্বব্যাংক ও ইউনিসেফ –এর মূল্যায়নে দেখা যায় বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মান পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও শ্রীলংকার চেয়ে খারাপ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৫ম শ্রেণি পাশ একজন ছাত্র বিজ্ঞান, গণিত ও ভাষা বিষয়ে যা জানে – শ্রীলঙ্কা কিংবা ভারতের ৩য় শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রীরা তার চেয়ে ভাল জানে। আমাদের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের উচ্চ জিপিএ প্রাপ্তদের যে পরাকাষ্ঠা তা আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের(ঢাবি) ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল দেখেই অনুমান করতে পারি যেখানে শতকরা মাত্র ১০ জন পাশ করে ও ৯০ জন ফেল করে। ঢাবি ভর্তি পরীক্ষার এই ফলাফলের খবর প্রকাশ করে বলেই আমরা ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলের এই দুরবস্থা জানতে পারি। বুয়েটসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল এভাবে প্রকাশ করে না। করলে অবস্থা যে ঢাবি’র মতই হতো তা আমরা অনুমান করতে পারি। পূর্বেই বলা হয় হয়েছে -বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় আজ অবধি বৈশ্বিক ৫০০ উৎকৃষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নাম লেখাতে পারেনি। এই বৈশ্বিক র্যাংকিং এ ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় না আসতে পারাকে উচ্চশিক্ষার বিরাট ঘাটতি বলে অনেক শিক্ষাবিদ মনে করেন। বৈশ্বিক র্যাংকিং এ বহুদিন থেকে কর্মরত দি টাইমস হাইয়ার এডুকেশন অতি সম্প্রতি তাদের ২০২৫ সালের র্যাংকিং ফলাফল প্রকাশ করেছে। এতে প্রথম ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের একটিও নেই। যদিও দক্ষিণ এশীয় দেশ ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকার একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় উল্লিখিত বৈশ্বিক র্যাঙ্কিং তালিকায় অন্যান্য বছরের মত এবারও স্থান লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। সুতরাং শিক্ষাব্যবস্থার যথোপযুক্ত সংস্কার এখন সময়ের দাবি। শিক্ষা সংস্কারের মূল লক্ষ্য হবে মানসম্মত ও গুণগত শিক্ষা প্রদান, শিক্ষকদের যথোপযুক্ত সম্মানী ও সম্মান প্রদান, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলনামূলকভাবে উপযুক্ত স্থানে অধিষ্ঠান।
বাংলাদেশে অতি সম্প্রতি (জুলাই–আগস্ট ২০২৪) বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছত্রছায়ায় ছাত্র-জনতার যৌথ অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে ডকট্রিন অব নেসেসিটি অনুসারে নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ৮ আগস্ট ২০২৪ তারিখে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পর দেশের সকল পেশার লোকজনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্র মেরামত সংক্রান্ত বিভিন্ন সংস্কারের দাবি উঠছে। এ সকল দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ৬টি কমিশন গঠন করেছেন। এসব কমিশন ১ অক্টোবর থেকে কাজ শুরু করবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
কমিশনগুলো হচ্ছে: ১. নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, যার প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার ২. পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন, যার প্রধান সরফরাজ হোসেন ৩. বিচারবিভাগ সংস্কার কমিশন, যার প্রধান বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান ৪। দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, যার প্রধান ড ইফতেখারুজ্জামান ৫। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, যার প্রধান আব্দুল মুয়িদ চৌধুরী এবং ৬. সংবিধান সংস্কার কমিশন, যার প্রধান হিসেবে অধ্যাপক ড. আলী রিয়াজ দায়িত্ব পালন করেছেন এবং ইতোমধ্যে কমিটি তাদের প্রতিবেদন সরকারের নিকট পেশ করেছেন। উল্লেখ্য, এখানে শিক্ষা সংস্কার বিষয়ক কোন কমিশনের উল্লেখ নেই। তাহলে কি বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কাকারের কোন প্রয়োজন নেই? ইতোমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন গোষ্ঠী ও বিশিষ্টজনেরা শিক্ষা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে সরকারের নিকট শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠনের দাবি জানাচ্ছেন। আমাদের আশা ও বিশ্বাস, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে একটি শক্তিশালী উপযুক্ত কমিশন গঠনের প্রস্তাব বিবেচনা করবেন।
শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা
স্বাধীনতার পর বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে অন্তত ৯ টি শক্তিশালী শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালে গঠিত হয় কুদরত-ই-খুদা কমিশন ও সর্বশেষ ২০০৯ সালে কবীর চৌধুরী শিক্ষা কমিশন। সকল কমিশনই তাদের প্রতিবেদন যথাসময়ে সরকারের নিকট দাখিল করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার কবীর চৌধুরী রিপোর্টকে পাশ কাটিয়ে (যদিও বা আওয়ামী লীগ সরকারই এই কমিশন গঠন করেছিল) সম্ভবত অন্য কোন উদ্দেশ্যে ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও সর্বশেষ ২০২১ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও চালু করে, যা নিয়ে গোটা দেশের মধ্যে চরম বিতর্ক ও বিশৃংখলা তৈরি হয়। অবশেষে অন্তর্বর্তী সরকার এই শিক্ষানীতি স্থগিত ঘোষণা করে ইতঃপূর্বেকার ২০১২ সালের সৃজনশীল শিক্ষাক্রম চালু করার ঘোষণা দেয়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিকট শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠনের দাবির পেছনে যে সকল কারণ বিদ্যমান সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে - শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে বিরাজমান ঘাটতি, বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি ও বিভিন্ন পরীক্ষায় উচ্চ জিপিএ অর্জনকারী ছাত্রছাত্রীদের যোগ্যতা প্রমাণে ব্যর্থতা, সর্বোপরি বৈশ্বিক র্যাঙ্কিংয়ে ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় না থাকা এবং এ সকল কারণে ছাত্র শিক্ষক অভিভাবকসহ বিজ্ঞজনদের মধ্যে সৃষ্ট হতাশা। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার অগ্রাধিকারের দাবি রাখে বলে অনেকে মনে করেন। বিভিন্ন সরকারের আমলে শিক্ষা কমিশন প্রদত্ত সুপারিশের ভিত্তিতে প্রণীত শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ফলে শিক্ষা সংস্কারের কাজ এ যাবত কতটা সফল হয়েছে? গুণগত শিক্ষা প্রদানে আমরা কতটা সফলতা অর্জন করতে পেরেছি?
মানসম্মত ও গুণগত শিক্ষা বলতে কী বোঝায়?
শিক্ষাবিদ ও বিশেজ্ঞদের মতে গুণগত শিক্ষা বলতে সেই শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থাকে বুঝায় যে শিক্ষা কিছু সুনির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক চলক এবং মানদণ্ড পূরণ করতে সক্ষম। শিক্ষায় ঐ সকল চলক ও মানদণ্ড পূরণ না করে যেনতেনভাবে শিক্ষা প্রদান ও সার্টিফিকেট বিতরণ করে কেবল সংখ্যা বৃদ্ধি করলে তা ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের জন্যে কোন সুফল বয়ে আনতে পারে না। বর্তমান যুগ তীব্র প্রতিযোগিতার যুগ। শিক্ষা গ্রহণ, জীবিকার্জনের জন্যে কর্মসংস্থানসহ সকল ক্ষেত্রেই এই প্রতিযোগিতা সমানভাবে বিদ্যমান। সুতরাং ছাত্র-শিক্ষক-গবেষকসহ সকল পেশাজীবীকে এই প্রতিযোগিতার কথা মনে রেখে স্ব স্ব কাজে উৎকর্ষতা অর্জন করতে হবে। তাই শিক্ষার মান বজায় রাখা একটি দেশের জন্য অতীব জরুরি। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে শিক্ষা দেশের অন্যতম বৃহত্তম পরিসর বা সেক্টর। তাই শিক্ষাব্যবস্থাকে যথাযথ কাঠামোর মধ্যে রাখতে হবে।
দেশ কত উন্নত হবে অথবা রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কতটুকু উন্নয়নের পথে ধাবিত হবে তা বোঝা যায় শিক্ষাসংক্রান্ত পরিকল্পনার ভেতর দিয়ে। শিক্ষা এবং শিক্ষার মান ও গুণ কথা দু’টির ভিন্ন তাৎপর্য রয়েছে। বর্তমানে বহুল উচ্চারিত শব্দ হলো ‘মানসম্মত’ ও ‘গুণগত শিক্ষা’। শিক্ষা দেওয়া ও গ্রহণ করার সাধারণ রীতি যেটা শুধু শিক্ষিত খেতাবের জন্য। কিন্তু একজন ছাত্রকে সুনাগরিক হিসেবে এবং জীবনসংগ্রামে টিকে থাকার জন্যে দক্ষ ও উপযুক্ত মানব হিসেবে গড়ে উঠতে গেলে প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষার । তাই শিক্ষার মান উন্নয়ন প্রয়োজন। গুণগত শিক্ষা এমন একটি পরিকল্পিত ব্যবস্থা যার উদ্দেশ্য হলো সামগ্রিকভাবে শিক্ষার্থীকে সাহায্য করা যেন শিক্ষার্থীরা তাদের পূর্ণ সম্ভাবনার বিকাশ ঘটিয়ে সমাজে জন্য একজন পূর্ণাঙ্গ ও উৎপাদনশীল নাগরিক হয়ে উঠতে পারে। তাই শিক্ষায় এমন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে যেন প্রতিটি শিশু স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায় এবং স্কুলের লব্ধ জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং তৎপরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন কারিগরি ও পেশাভিত্তিক শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে সফলতার সাথে সকল প্রতিযোগিতা পেরিয়ে অংশগ্রহণ করতে পারে এবং শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতের জন্য উৎপাদনশীল নাগরিক হয়ে গড়ে উঠতে পারে।
এ ছাড়া গুণগত শিক্ষা শিক্ষার্থীদেরকে সুনাগরিক, ন্যায়বোধ, কর্তব্যপরায়ণতা, শৃঙ্খলা, আচরণবিধি, ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা, বন্ধুত্বর্পূণ মনোভাব, সহাবস্থান, অনুসন্ধিৎসু, দেশপ্রেমিক, দেশের অতীত ও বর্তমান ইতিহাস, দেশের গুণীজন ও সাধারণ জনগণের প্রতি ভালোবাসাবোধ, দায়বদ্ধতা, অধ্যবসায়সহ নৈতিক ও আধ্যাত্মিক অন্তর্নিহিত গুণ অর্জন ও উন্মোচনে সহায়তা করে। গুণগত মানসম্মত শিক্ষা প্রদান ও অর্জন তখনই সম্পন্ন হয়েছে বলে ধরা হবে যখন ছাত্রছাত্রীরা এ সকল গুণ অর্জন করে ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের জন্য তৈরি হবে এবং বৈশ্বিক পরিবেশে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হবে। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ –এর শিক্ষাক্রমে শুরু থেকেই এই নৈতিকতা বিষয়টিকে সংযুক্ত ও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
গুণগত শিক্ষা ও উন্নয়ন অংশীদারদের প্রত্যাশা
বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে সর্বজনীন অন্তর্ভুক্তিমূলক গুণগত শিক্ষা বাস্তবায়নে আঙ্গীকারাবদ্ধ। সহস্রাব্দ বাস্তবায়ন লক্ষ্যমাত্রা (এম ডি জি ২০০০-২০১৪) বাস্তবায়নে সরকার কাজ করেছে। কিন্তু এম ডি জি আশানুরূভাবে সফল হয় নি। অতঃপর ২০১৫–২০৩০ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়নযোগ্য টেক- সই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এস জি ডি) বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে চলছে। বলা দরকার এস জি ডি’র লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হলে ২০২৬ (করোনার জন্যে প্রাপ্ত গ্রেস ২০২৭ সাল পর্যন্ত) সাল নাগাদ বাংলাদেশের উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের সনদ পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠতে পারে। সে জন্যে এস ডি জি’র লক্ষ্যমাত্রা ৪ -এ প্রদত্ত সকল লক্ষ্য অর্জনের জন্যে আমাদের সচেষ্ট হতে হবে।
এস জি ডি’র লক্ষ্যমাত্রা – ৪ অর্জন করতে হলে বিশেষজ্ঞদের মত হলো: ১. মানসম্মত শিক্ষকের সংখ্যা বাড়াতে হবে; ২. যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করতে হবে; ৩. মানসম্মত বই ও শিখন সামগ্রী সরবরাহ ও ব্যবহার করতে হবে; ৪. শিখন-শেখানো পদ্ধতির ও কৌশলের কার্যকর ব্যবহার; ৫. নিরাপদ ও সহযোগিতামূলক শিখন পরিবেশ নিশ্চিত; ৬. উপযুক্ত মূল্যায়ন ব্যবস্থা; ৭. প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তার ও কর্মচারীর সুসম্পর্ক; ৮. শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নের জন্যে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা; এবং ৯. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত সুবিধা বৃদ্ধি করাসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজ ও সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে।
শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের যে দাবি আজ আমরা এখানে তুলছি তার মূল প্রতিপাদ্য এস ডি জি’র লক্ষ্যমাত্রা ৪ –এ মোটামুটিভাবে বিধৃত হয়েছে। আমাদের দাবি - গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নের এ সকল উপাদান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অবশ্যই কার্যকর প্রাধিকারভিত্তিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এগুলোর মধ্যে আবশ্যিক উপাদান যেগুলো রয়েছে তা মূলত ২ প্রকার। ১. সরকারের এখতিয়ারভুক্ত বিষয় ও ২। শিক্ষা সংস্কার কমিশনের এখতিয়াভুক্ত বিষয়াবলি। সরকারের এখতিয়ারভুক্ত বিষয়াবলি সরকার তার ক্ষমতাবলে বাস্তবায়ন করবে আর অনিষ্পন্ন কিছু বিষয় যেগুলো শিক্ষা সংস্কার কমিশন চিন্তাভাবনা করে জাতির ভবিষ্যৎ উন্নত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্যে সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা প্রদান করবে।
১. সরকারের এখতিয়ারভুক্ত বিষয়সমূহ
১.১. বাজেট বরাদ্দ
ইউনেস্কোর পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন অনুযায়ী একটি দেশের শিক্ষাখাতে বরাদ্দ হওয়া উচিত বাৎসরিক মোট বাজেটের ২০% এবং জিডিপি’র অন্তত ৬%। যাই হোক, সে হিসাবে বাংলাদেশ অনেকটাই পিছিয়ে আছে। শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের চলতি অর্থ বছরের (২০২৪ -২৫) বরাদ্দ জিডিপি’র ১.৮১% এবং মোট বাজেটের ১৩.৭০%, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। বাজেট বরাদ্দ কম থাকার কারণে আমাদের শিক্ষকদের বেতনও কম। কম বেতন যা দিয়ে একজন শিক্ষক স্বাচ্ছন্দ্যে সংসার চালাতে পারেন না তিনি টিউশনি বা অন্য পার্শ্ব আয়ের কথা চিন্তা না করে একনিষ্ঠভাবে কীভাবে শিক্ষাদানে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারেন? সুতরাং মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নের প্রসঙ্গ আসলে শিক্ষকদের বেতন ও সামাজিক মর্যাদার কথা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। মনে রাখা দরকার, শিক্ষা সংস্কারের জন্যে এবং তা সংস্কারকৃত শিক্ষা টেকসই রাখার জন্যে বাজেট অত্যাবশ্যকীয়। কিন্তু অতিরিক্ত বাজেট বরাদ্দের জন্যে সরকারের আর্থিক সক্ষমতা ও সদিচ্ছা থাকতে হবে। শিক্ষাকে উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসেবে গণ্য করে অন্যান্য কম প্রয়োজনীয় খাতের বাজেট হ্রাষ করে শিক্ষাখাতে ইউনেস্কোর প্রস্তাব মোতাবেক বাজেট বরাদ্দ আমাদের বর্তমান অবস্থাতেও অসম্ভব নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের সময়কালের বাজেট প্রণয়নে শিক্ষাখাতে বাজেট বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করতে পারেন এবং আমরা মনে করি জাতির বৃহত্তর কল্যাণে এটি করা উচিত।
১.২. মানসম্পন্ন শিক্ষকের সংখ্যা ও তাদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রাথমিকে ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত হচ্ছে ১:৩০। মাধ্যমিকে তার চেয়ে সামান্য কম এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ১:২৩।প্রাথমিক এবং মাধ্যমিকে শিক্ষার মান বাড়াতে হলে যোগ্য ও বেশিসংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ও সন্মান নিশ্চিত করতে হবে। উপযুক্ত সর্বাধুনিক প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্যে পর্যাপ্ত শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট স্থাপন করতে হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষক সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়টি সরকার বিবেচনা করতে পারেন। তা না হলে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে না।
১.৩ শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি রোধ
নামে মাত্র পাশ আর ডিগ্রি সার্টিফিকেট নিয়ে শিক্ষিত বেকার তৈরি হয় – এমন জাতি সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত জাতি নয়। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্প্রসারণশীল হলেও শিক্ষার গুণগত মানের ক্রমাগত অবনতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের গভীরতা নিয়ে উন্নয়ন অংশীদারসহ অন্যান্য সকল অংশীজনের সন্দেহ আছে। নকল প্রবণতা বর্তমানে বহুল আলোচিত বিষয়। এছাড়া পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, সার্টিফিকেট জালিয়াতি করার মতো খারাপ কাজও করা হচ্ছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। নিয়মিতভাবে ক্লাসে পাঠদান না করে টিউশনি, কোচিং সেন্টারে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান এখন ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। সুতরাং এ সকল বিষয়ে সরকারের নজর দেয়া উচিত।
২.২. শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ
আজকের শিশুরাই হবে আগামী দিনের প্রকৃত মানুষ, আর প্রকৃত মানুষ হতে পারলেই তারা হতে পারবে উত্তম শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী। কেউ বা হবে শিল্পী, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, লেখক, কবি ও সাংবাদিক। এগুলো তৈরি হবে শিক্ষাঙ্গনেই। তাই শিক্ষাঙ্গনের শ্রেণিকক্ষই শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ জীবনের প্রস্তুতির ক্ষেত্র। পৃথিবীর প্রায় সব দেশই বর্তমান সমাজের প্রয়োজনমতো চাহিদা ও ভবিষ্যৎ সমাজের সম্ভাব্য চিত্রকে সামনে রেখে তাদের শিক্ষাব্যবস্থা তথা শিক্ষাঙ্গনে ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টিতে সচেষ্ট। আর এই পরিবেশ গড়ে তোলার দায়িত্ব শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের। ছাত্রদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাজনীতিতে টেনে নেয়া, যথানিয়মে হলে সিট বরাদ্দ না দেয়া, যথাসময়ে পরীক্ষা না নিয়ে সেশনজট তৈরি করে ছাত্রদের শিক্ষাজীবন দীর্ঘায়িত করা, অযাচিত র্যাগিং – এ সবকিছুই শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ নষ্ট করছে। এ অবস্থার জন্যে বিদ্যমান প্রশাসন দায়ী এবং তাদেরকেই এই অবস্থার অবসান ঘটিয়ে শিক্ষার পরিবেশ উন্নয়ন করতে হবে।
২.৩. শিক্ষক-অভিভাবক সম্পর্কোন্নয়ন
পাঠদানের বিষয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষকদের সম্পর্কন্নোয়ন ও সমন্বয় দরকার। শিক্ষার মান উন্নয়নে অভিভাবকদের ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি অভিভাবক অন্তত সপ্তাহে এক দিন শিক্ষকদের সম্মানের সাঙ্গে ছাত্রদের বিষয়ে জানতে চাইবেন। শুধু নিজের সন্তানকে সন্তান মনে করলে হবে না। বিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি সন্তানকে সমান চোখে দেখা উচিত। নিজের সন্তানকে তাগিদ দেওয়ার পাশাপাশি পাশের অন্যের সন্তানকেও জানতে হবে। নিজের সন্তানকে শুধু সন্তান মনে করে আমরা একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমে গিয়েছি। কেন আমার সন্তান রোল ১ করল না। কেন অমুকের সন্তানের রোল ১ হলো। এতে শিক্ষকরা কিছুটা বিড়ম্বনার শিকার হন। তবে এ ক্ষেত্রে যদি শিক্ষকদের কোনো ত্রুটি বা হাত থাকে তাহলে এ লজ্জাজনক কাজ থেকে সরে আসাই ভালো।
২.৪. নৈতিক ও সহশিক্ষা জোরদারকরণ
মূল্যবোধ শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষা, বিনয় ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করার দীক্ষা অবশ্যই আমাদের শিক্ষকদের দিতে হবে। মনে রাখতে হবে শিক্ষক কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, তিনি সমাজেরও শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নির্ভরতা কমিয়ে মানসিক চাপমুক্ত করতে সহায়তা করা শিক্ষকের একান্ত দায়িত্ব। পরীক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা সৃজনশীলতা হারাচ্ছে। পরীক্ষা নির্ভরতা কমিয়ে, মেধা যাচাই করে প্রাথমিক স্তরেই ভদ্রতা, নম্রতা, শিষ্টাচার, দেশপ্রেম, পরোপকারিতা ও ন্যায়পরায়ণতা, নাগরিক গুণাবলি, ইত্যাদি শেখানো উচিত। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পরীক্ষার ক্ষেত্রে বারবার নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলে বা নিয়ম চালু হলে তাতে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীর ভূমিকার ব্যাপারে লেখাপড়ার বিষয়ে কোনো সমস্যা দেখা গেলে তা অবশ্যই শিক্ষকদের জানাতে হবে। দুর্বল শিক্ষার্থী বন্ধুদের প্রতি কখনো খারাপ আচরণ করা যাবে না। তারা যাতে ভালো হয় সেদিকে সাহায্য করতে হবে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক যাতে সুবিধামতো পড়াতে পারেন সে বিষয়ে শিক্ষককে সহযোগিতা করতে হবে। প্রতিদিনের পড়া প্রতি দিন ক্লাসে শেষ করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা জ্ঞানবৃদ্ধির জন্য সবার পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। এতে শিক্ষার্থীরা যেমন একটি পরিচ্ছন্ন বিদ্যালয় পাবে, তেমনি তারা কর্মঠ, উদ্যমী ও স্বাবলম্বী হবে এবং পরিচ্ছন্ন থাকার জ্ঞান লাভ করবে। আমাদের শিক্ষার মান উন্নয়নে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। শিক্ষকদের ছাত্র শাসনের ব্যাপারে বিশেষ নিয়মে আবদ্ধ করা যাবে না। সেজন্য শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষকদের কোমলমতি মন নিয়ে ভালোবাসা দিয়ে যত্নসহকারে পড়াতে হবে। পাশাপাশি অভিভাবকদের শিক্ষকদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। সবকিছু মিলিয়ে প্রশাসনিক দিক থেকে তৃণমূল পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজালে আমাদের শিক্ষার মান উন্নয়ন সম্ভব।
খেলাধুলা, আবৃত্তি, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি সহশিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞান বৃদ্ধির লক্ষ্যে পাঠ্য বই এর বাইরের বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। সেজন্যে গ্রন্থাগার ক্লাশ ও গ্রন্থাগার থেকে পুস্তক ধার করার নিয়ম চালু করতে হবে। মোটামুটিভাবে এ সকল কার্যক্রম গ্রহণ ও চালু কার্যক্রম শক্তিশালী করার ব্যাপারে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগের যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। উচ্ শিক্ষার ক্ষেত্রে ডুয়াল মোড অব এডুকেশন অর্থাৎ শ্রেণীকক্ষে শিক্ষাদানের পাশাপাশি অনলাইন পদ্ধতি চালু রাখা যেতে পারে। সেই সাথে অনলাইন সেবা চালু করা যায়। উন্নত বিশ্বে বেশ আগে থেকেই এই অনলাইন পদ্ধতিতে শিক্ষাদান কার্যক্রম চলে আসছে।
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ শুরু থেকে এর পাঠসুচিতে নৈতিক শিক্ষা কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করেছে। এ ছাড়া সহশিক্ষা বিষয়ক কার্যক্রম, যেমন – একাডেমিক ( বক্তৃতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, উপস্থাপনা, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে অংশ গ্রহণ ও আয়োজন, ইত্যাদি), খেলাধুলা, সমাজসেবামুলক কার্যক্রম ও নৈতিকতা ভিত্তিক কাজ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের শুধু পাঠ্যবই পড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে এবারে শিক্ষা সংস্কার কমিশন গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর বিষয়ে কে কী করতে পারে সে বিষয়ে আলোকপাত করবো:
২.০ শিক্ষা সংস্কার কমিশনের এখতিয়াভুক্ত বিষয়াবলী
২.১. পাঠক্রম পর্যালোচনা ও যুগোপযোগী পাঠক্রম প্রণয়ন
বাংলাদেশের শিক্ষাখাত দেশের অন্যতম বৃহৎ একটি খাত। এতে চার কোটির অধিক শিক্ষার্থী ও তেরো লাখের মত শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছেন। এই শিক্ষা খাতের মধ্যে রয়েছে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক, কারিগরি, মাদ্রাসা ও কওমি মাদ্রাসা এবং উচ্চ শিক্ষা। এ ছাড়াও রয়েছে ফোরকানিয়া মাদ্রাসা (এখানে প্রাথমিক পর্যায়ে কোরআন হেফজ করানো ও প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হয়)। রয়েছে বিদেশি কারিকুলাম অনুযায়ী ইংরেজি মাধ্যম স্কুল (এই আলোচনায় অবশ্য তা বাদ দেয়া হয়েছে। সুতরাং বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্যে নিয়মিতভাবে প্রদত্ত পাঠক্রম মূল্যায়ন ও পরিবর্তনের জন্যে একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। এই কমিশনের সভাপতি হবেন একজন যশস্বী, দেশপ্রেমিক শিক্ষাবিদ, যার সাথে সদস্য হিসেবে থাকবেন বিষয় বিশেষজ্ঞ (প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত), শিক্ষা প্রশাসক ও শিক্ষা গবেষক, অভিভাবক ও অন্যান্য অংশীজন। ওই কমিশন পূর্বেকার শিক্ষা কমিশন রিপোর্টগুলো পর্যালোচনা করবেন, আমাদের সমাজকাঠামো ও মূল্যবোধ বিবেচনা করে, বৈশ্বিক অগ্রগতি তথা ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের বিষয় ও মানসম্মত শিক্ষার বিষয়টি মাথায় রেখে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থার টিচিং-লার্নিং, কারিকুলাম, মূল্যায়ন পদ্ধতি, ইত্যাদি মনিটরিং ও বিশ্লেষণ করে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদি সময়ভিত্তিক সুনির্দিষ্ট সুপারিশমালা প্রণয়ন করে সরকারের নিকট দাখিল করবেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সেগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইউজিসি, শিক্ষা অধিদপ্তর ও শিক্ষা বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিভাগকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবে। আমরা মনে করি, এই শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে ‘উড কমিশন ১৮৫৪’ বা ‘উড ডেস্পাচ অন এডুকেশন ১৮৫৪ রিপোর্টে’র মত কাজ করবে। উড কমিশন রিপোর্টকে ভারতের শিক্ষার ইতিহাসে এক সময় ম্যাগানাকার্টা হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
২.২. প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করা
প্রাথমিক শিক্ষার স্তর ৫ম শ্রেণীর স্থলে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত হওয়া প্রয়োজন। কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনে ১৯৭২ সনে এ সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু আজ অবধি কোন সরকার তা বাস্তবায়ন করেনি। প্রাথমিক শিক্ষা ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত করার যুক্তি হচ্ছে – এই বয়সে ছাত্রছাত্রীরা শারীরিক ও মানসিক যোগ্যতার প্রাথমিক ধাপ মেটাতে সক্ষম হয়। আমাদের দেশের ৪র্থ শ্রেণীর চাকরির যোগ্যতাও ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত চাওয়া হয়। আর ৮ম পর্যন্ত এই প্রাথমিকের পর শুরু হবে নিবিড় বাছাই পর্ব। শুধু মেধাবীরাই ৯ম শ্রেণীতে যাবে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে। বাকিরা টেকনিক্যাল ও ভোকেশনাল ট্রেনিং এ যাবে। বিদেশগামী শ্রমিকেরা হবে ৮ম শ্রেণি পাশ ও ভোকেশনাল ট্রেনিংপ্রাপ্ত দক্ষ শ্রমিক। গবেষণা ও নিবিড় পর্যালোচনার ভিত্তিতে কমিশন মতামত দিবেন প্রাথমিক পাশ করা শতকরা কতজন ছাত্রছাত্রী কারিগরি ভোকেশনাল ট্রেড কোর্সে অংশ গ্রহণ করবে? আর কতজন নবম শ্রেণীতে ভর্তি হবে? এসজিডি’র শর্ত মোতাবেক সর্বজনীন বাধ্যতামূলক শিক্ষা চালু করার পদক্ষেপ হিসেবে সরকার কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন কমিশনকে তারও নির্দেশনা দিতে হবে।
এখানে একটি কথা বলা দরকার - তা হলো বাংলাদেশে বর্তমানে ইংরেজি মাধ্যম (অক্সফোর্ড, ক্যাম্ব্রিজ সিলেবাস) ছাড়া প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার যে সকল ধারা বিদ্যমান – যেমন ইবতেদায়ী, ফোরকানিয়া, হেফজ, কওমি ধারার শিক্ষা বা অন্য যেগুলো চালু রয়েছে সেগুলো একীভূত করে একধারা প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার বিষয় চিন্তা করবেন কিনা। অনেকে মনে করেন, প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হলে এবং সরকার এর ব্য্যয় বহন করলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত একধারা শিক্ষা চালু করা যেতে পারে। সেখানে যথাযথ ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা থাকবে, মাতৃভাষা, ১/২ টি বিদেশি ভাষা শিক্ষা, বিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকবে। ধর্মীয় শিক্ষার স্তর এমন ভাবে বিন্যাসিত থাকবে যে কোন ছাত্র কোরানে হাফেজ হতে চাইলে অন্য বিষয়ের চাপ কমিয়ে সে হাফেজী লাইনে যেতে পারবে। ভবিষ্যতেও ইসলামি শিক্ষা বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ তার লক্ষ্য থাকতে পারে। বিষয়টি এজন্যে উল্লেখ করলাম যে, প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশের বহুসংখ্যক ছাত্রছাত্রী ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় এ ধরনের শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে।
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংস্কার
প্রাথমিকের পশ্চাদপদতা, শিক্ষকদের অদক্ষতা, ছাত্রছাত্রীদের আর্থসামাজিক অবস্থা, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, ইত্যাদি কারণে আমাদের মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মান নিম্নগামী। বিগত কয়েক বছর থেকে এই অবস্থা লক্ষণীয়। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে – বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করা। এর কারণ চিহ্নিত করা জরুরি এবং মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে তদনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। বিশেষ করে এমপিও-ভুক্ত বিদ্যালয়, মাদ্রাসা এবং কলেজের শিক্ষাদান ও ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। মনে রাখা দরকার, ২০৩০ এর মধ্যে মানসম্মত ও সার্বজনীন মাধ্যমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্য ৪ -এ উল্লেখ আছে। এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, ১৯১৭ সালে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ও উচ্চশিক্ষার উন্নতিকল্পে ব্রিটিশ সরকার মাইকেল স্যাডলার –এর নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন। কমিশনের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন স্যার আশুতোষ মুখার্জী, ড. জিয়াউদ্দীন, ফিলিপ হার্টগ (ঢাবি’র প্রথম ভি সি) ও অন্যান্য কয়েকজন। উল্লেখ্য স্যাডলার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতেই ঢাবি’র প্রতিষ্ঠা। স্যাডলার কমিশন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা চিহ্নিত করতে গিয়ে এই এলাকার মাধ্যমিক শিক্ষা উন্নয়নের উপর জোড় দিয়েছিলেন। কেননা কমিশন বুঝেছিলেন, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাল ছাত্র পেতে হলে মাধ্যমিক থেকে তা সৃষ্টি করতে হবে। তাই নতুন শিক্ষা কমিশন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংস্কার ও উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ প্রদান করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। যাতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভাল ছাত্র পেতে পারে।
কারিগরি শিক্ষা সংস্কার
বিশ্বের যেসব দেশ কারিগরি শিক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে, সেসব দেশ অর্থনৈতিকভাবে তত বেশি সমৃদ্ধ হয়েছে। দেশের সব শ্রেণির শিক্ষিত জনগোষ্ঠী সমন্বিত অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখলেও এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে কারিগরি শিক্ষা। বিশেষ করে মধ্যমস্তরের কারিগরি শিক্ষা। কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততার হারের ওপর গড় বাৎসরিক মাথাপিছু আয় নিবিড়ভাবে নির্ভরশীল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, যেমন- অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন কারিগরি শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করায় আজ তারা উন্নত বিশ্বের কাতারে অবস্থান নিশ্চিত করেছে। ষাট থেকে সত্তর দশকে মালয়েশিয়ার শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তি শিক্ষার জন্য ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে এসে ভর্তি হতেন। আর এখন আমাদের ছাত্রদের মালয়েশিয়ায় যেতে হয় তাদের দেশের প্রযুক্তি জ্ঞান অর্জনের জন্য। শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজিয়ে কারিগরি শিক্ষার হার বৃদ্ধি করার কারণেই তারা আজ উন্নত বিশ্বের কাতারে।
আমাদের দেশে ১৯৫৫ সালে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট (বর্তমান ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট) প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মধ্যম স্তরের প্রকৌশলী তথা ডিপ্লোমা প্রকৌশলী তৈরির স্বতন্ত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়। দীর্ঘ ৬৯ বছরে সরকারি ৫০টি এবং বেসরকারি পর্যায়ে প্রায় ৫ শতাধিক পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপিত হয়েছে। এর পাশাপাশি প্রতি জেলায় স্থাপিত সরকারি বৃত্তিমূলক র্শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (টিএসসি) দক্ষ জনবল তৈরিতে ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে কারিগরি শিক্ষার হার প্রায় ১৫-১৬ শতাংশ। বিগত সরকার এ হার ২০২০ সালের মধ্যে ২০ শতাংশে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছিল। সে টার্গেট অর্জিত হয়নি। বিগত সরকার কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতের হার ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। এটা খুবই আশাব্যঞ্জক হলেও কারিগরি শিক্ষা এখনো অবহেলিত। কারিগরি শিক্ষায় ৫০ শতাংশ ভর্তি বাধ্যতামূলক করতে হবে যেহেতু কারিগরি শিক্ষা গ্রহণে এখনো আমাদের দেশে আগ্রহ কম। সাধারণ ও কারিগরি শিক্ষা গ্রহণের অনুপাত নির্ধারণ হওয়া প্রয়োজন। কমিশন এ বিষয়ে সঠিক দিক নির্দেশনা প্রদান করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এখানে বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষার বর্তমান অবস্থার উপর সামান্য আলোকপাত করা দরকার।
বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের অধীনে শের-ই-বাংলা নগরস্থ আগারগাঁও এ অবস্থিত কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর। বাংলাদেশের একমাত্র কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অফিস এখানেই। কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণ ও মানোন্নয়নের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৬০ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর অধীনে সরকারি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মোট ২০০টি। এ গুলোতে শিক্ষার স্তর মোট ৩ টি। ১. ডিপ্লোমা ডিগ্রির নিচে ৬ মাস/ ১ বছর মেয়াদি ভোকেশনাল/ট্রেড কোর্স ২. পলিটেকনিক ইন্সটিউটে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ও ৩। স্নাতক পর্যায়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং। এগুলোর মধ্যে সার্টিফিকেট পর্যায়ে ১৩৪ টি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ এবং ১ট ভোকাশনাল টিচার্চ ট্রেনিং ইন্সটিটিউট রয়েছে। এ ছাড়া ডিপ্লোমা পর্যায়ে ৫০ টি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট এবং ডিগ্রি পর্যায়ে ৪ টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ রয়েছে। এগুলো ছাড়াও এই অধিদপ্তরের অধীনে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ২০২২-২৩ সালে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে সর্বমোট ১১,১১৮ টি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দিয়েছে। এ গুলোর মধ্যে সরকারি ৭৭৭ টি ও বেসরকারি ১০,৩৪১ টি। এগুলোর মোট আসন সংখ্যা হচ্ছে ১৩,৬৯, ১০৫ টি। ২০২২-২৩ সালে ভর্তি হয়েছে মোট ৬,৭৩,৫৯১ জন (সরকারি ৯৭,৯২৯ জন ও বেসরকারি ৫,৭৬,৬৬২ জন)। এ ছাড়া এই অধিদপ্তরের র অধীনে রয়েছে ‘জাতীয় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও গবেষণা একাডেমি (নেকটার)। ১৯৮৪ সালে বগুড়া জেলার শাজাহানপুর উপজেলার জাহাঙ্গীরাবাদ সেনানিবাস সংলগ্ন নেকটার –এর কার্যক্রম শুরু হয়। এর মূল কাজ হচ্ছে – শিক্ষিত বেকার যুবক ও মহিলাদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ ও আত্নকর্মসংস্থান এবং অনলাইন মার্কেট প্লেসে কাজ করার উপযোগী করে গড়ে তোলা। এ ছাড়াও সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জন্যে তথ্য প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ দেশে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণে প্রতি জেলায় একটি করে সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও প্রতিটি উপজেলায় একটি করে বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন, টেক্সটাইল ও লেদার ইনস্টিটিউটসহ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ শিক্ষানীতিতে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডকে অধিকতর শক্তিশালী করা ও প্রয়োজনীয় আর্থিক সংস্থান ও জনবল বৃদ্ধি, যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক-প্রশিক্ষক নিয়োগের অঙ্গীকার করা হলেও বাস্তব অগ্রগতি সামান্যই। প্রতিটি বিভাগে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড হওয়া দরকার। একটি মাত্র কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পক্ষে বিপুল সংখ্যক কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তত্ত্বাধাবন করা সম্ভব নয়।
দেশে ৮টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠা হলেও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সংখ্যা ১টিই রয়ে গেছে। অর্থাৎ কারিগরি শিক্ষা উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। উপরন্তু পরিকল্পনাহীনতার কারণেই দেশে এখন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা পঞ্চাশোর্ধ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত প্রায় ৭০০ সরকারি-বেসরকারি কলেজে অনার্স-মাস্টার্স খোলা হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এখন ১১৬টি (জুন ২০২৫)। এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতি বছর স্নাতক (পাস,স্নাতক, সম্মান) ও মাস্টার্স পর্যায়ে প্রায় ১২ লাখ শিক্ষার্থী ভর্তি হন। প্রতি বছর এসব প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে আসেন প্রায় ৭-৮ লাখ। কিন্তু এত বিপুলসংখ্যক উচ্চশিক্ষিত লোকবলের চাহিদা আমাদের শ্রমবাজারে নেই। সে কারণে প্রতি বছর প্রায় ৩-৫ লাখ উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণী বেকারের তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন।
তাই আমরা মনে করি ১. স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষাকে সীমিত করে সনদনির্ভর দক্ষতাহীন শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা হ্রাস করা। ২. প্রাথমিক (৮ম শ্রেণি পাশ) ও এসএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের কমপক্ষে ৫০ শতাংশকে কারিগরি শিক্ষাগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা। ৩. সাধারণ শিক্ষায় একাদশ শ্রেণির আসন সংখ্যা যৌক্তিক হারে সংকুচিত করে কারিগরি শিক্ষার আসন বৃদ্ধি করা এবং কোনো আসন যাতে খালি না থাকে তা নিশ্চিত করা। ৪. শুধু পরিমাণগত নয়, গুণগত মানও নিশ্চিত করা। ৫. বেসরকারি পর্যায়ে নতুন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট অনুমোদনের ক্ষেত্রে মান ও ইতোমধ্যে অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া। ৬. প্রতিটি বিভাগে ১টি করে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড স্থাপন করা। এবং ৭. শ্রম বাজারের চাহিদা নিরূপণ করে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো। [বুয়েট, কুয়েট, চুয়েট, রুয়েট ও বুয়েট এই আলোচনার অন্তর্ভুক্ত নয়]।
মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কার
বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা বলতে আমরা বুঝি মসজিদভিত্তিক মক্তব (যেখানে কোরআন ও মাসআলা-মাসায়েল শিক্ষা দেয়া হয়), ফোরকানিয়া মাদ্রাসা, ইবতেদায়ী মাদ্রাসা, আলিয়া মাদ্রাসা ও কওমি বা খারেজি মাদ্রাসা। আলিয়া মাদ্রাসায় সরকারি অনুদান দেয়া হয় এবং সিলেবাসের সাথে সাধারণ শিক্ষার মিল রয়েছে। যেমন – দাখিল (এস এস সি), আলিম (এইচ এস সি), ফাজিল (স্নাতক)। আলীয়া মাদ্রাসা থেকে পাশ করা ছাত্রছাত্রীরা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক এবং চিকিৎসা ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেন। কওমি মাদ্রাসা থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রীকে (দাওরা) ইতোঃপূর্বেকার সরকার মাস্টার্স ডিগ্রির সমমান দিয়েছিল যদিও তা দিয়ে তারা কোন চাকরি কিংবা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করতে পারেন না।
বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশ বর্তমানে প্রায় ৩৪ লক্ষ ছাত্র মাদ্রাসায় পড়াশুনা করছেন। এর মধ্যে ২০ লক্ষ জন আলীয়া মাদ্রাসায় এবং ১৪ লক্ষ জন কওমি মাদ্রাসায়। দেখা যায়, বাংলাদেশের মোট ছাত্রসংখ্যার প্রায় ৭-৮% মাদ্রাসায় পড়াশুনা করছেন। তাদের অধিকাংশই মূল স্রোতের বাইরে। ধর্মীয় অনুভূতি, মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য রক্ষা করে মাদ্রাসা শিক্ষাকে একই ছাতার নিচে আনা যায় কিনা কমিশন বিষয়টি বিবেচনা করতে পারেন। এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে যে বা যারা কোরআনের হাফেজ হতে চান তারা যেন তাই হতে পারেন আর যারা ইসলামি শিক্ষায় উচ্চতর ডিগ্রি নিতে চান তারা যেন সেই সুযোগ পান। আমাদের লক্ষ্য হবে, মানবসম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার– সেই সাথে আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ সংরক্ষণ। সে জন্যে কমিশনে আলীয়া ও কওমি মাদ্রাসার প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। কওমী মাদ্রসা থেকে দাওরা পাশ ছাত্রছাত্রীদের সাধারণ শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত করার লক্ষে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ইউ জি সি’র অনুমোদনক্রমে ইসলামী শিক্ষা বিভাগে স্নাতক ডিগ্রীতে ভর্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এতে বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী সাধারণ শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে।
উচ্চ শিক্ষা সংস্কার
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন -এর বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২৩ অনুযায়ী ৫৩ টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ লাখের মত, বেসরকারি ১১৬ টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪.৫ লাখের মত ছাত্রছাত্রী রয়েছে। এ ছাড়া সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজ ও মাদ্রাসাসমূহে প্রায় ৪২ লক্ষ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজসমূহে প্রায় ১৪.০ লক্ষ এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪.০ লক্ষাধিক ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া করছেন। বলা যায়, উচ্চশিক্ষা গ্রহণে বর্তমানে সর্বমোট প্রায় ৮২.০ লক্ষ ছাত্রছাত্রী নিয়োজিত আছেন। যা মোট ছাত্রসংখ্যার প্রায় ২৫%।
আমরা মনে করি, উচ্চশিক্ষা আবশ্যিকভাবে বিশেষায়িত এবং অতি মেধাবী নির্বাচিত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সীমায়িত থাকা প্রয়োজন। ঢালাওভাবে সবাইকে উচ্চশিক্ষা দিয়ে বেকার তৈরি করা গরিবের বিলাসিতা বৈ কী? উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত জ্ঞান সৃজন এবং বিতরণ। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যাল-শিল্প সম্পর্ক (ইউনিভার্সিটি-ইন্ডাস্ট্রি এলাইয়ান্স) প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়ন। এজন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা কর্ম পরিচালিত হওয়া এবং শিল্প মালিক ও শিল্প ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপন করা প্রয়োজন। পূর্বেই বলা হয়েছে, বৈশ্বিক র্যাংকিং এ ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও আজ অবধি কোন স্থান অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। যদিও দক্ষিণ এশীয় দেশ ভারত, পাকিস্তানের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় এই র্যাংকিং এ নিজেদের স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে। তাছাড়া নিকট অতীতে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ, অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষকদের দৈনন্দিন শিক্ষাদান, পরীক্ষা গ্রহণ ও ব্যবস্থাপনায় যে দুর্নীতি ও অনিয়মের খবরাখবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তাতে সকল অংশীজনদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে নেতিবাচক চরম হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা সম্পর্কে জনমনে যে ধারণার জন্ম হয়েছে তা থেকে বের হয়ে আসার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী সবাইকে এক যোগে কাজ করতে হবে। উচ্চশিক্ষা সংস্কারের লক্ষ্যে কমিশন নিন্মোল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচন করতে পারেন:
১. গবেষণা: বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বর্তমানে পঠন-পাঠনকেন্দ্রিক ক্লাস-পরীক্ষা মুখ্য। কাঠামোগত ত্রুটির কারণে গবেষণা হয়ে থাকে গৌণ। অথচ জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে গবেষণা-উদ্ভাবনের কোনো বিকল্প নেই। তাই বিশ্ববিদ্যালসমূহে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা কীভাবে বৃদ্ধি করা যায় এবং প্রকাশনার সংখ্যা বাড়ানো যায় – কমিশন সে ব্যাপারে দিক নির্দেশনা দিতে পারেন। গবেষণায় বাজেট বৃদ্ধির বিষয়টিও আমাদের মনে রাখতে হবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উন্নততর গবেষণা কর্ম পরিচালনার জন্যে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দাতা সংস্থা ও বিভিন্ন এজেন্সি থেকে ফান্ড সংগ্রহ করে থাকে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষকবৃন্দ সে রকম ফান্ড সংগ্রহ করতে পারেন কিনা সে বিষয়েও কমিশন নির্দেশনা রাখতে পারেন।
প্রতিটি অ্যাকাডেমিক ডিসিপ্লিনের কনফারেন্সে অংশ নেয়ার জন্য ‘ইউজিসি কনফারেন্স ট্রাভেল অ্যাওয়ার্ড’ প্রবর্তন করা যেতে পারে। সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে যৌথ গবেষণার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরের বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও ভিজিটিং ফেলো, স্কলার ও ফ্যাকান্টি এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে। বহির্বিশ্বের (বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ) অভিজ্ঞতা রেফারেন্স হিসেবে গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বিদ্যমান বেতন কাঠামো রিভিউ করা এবং তা বৃদ্ধির ব্যাপারে ইউজিসি উদ্যোগ নিতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে গৃহীত বিভিন্ন কৌশলপত্র পরিকল্পনা ও প্রণয়নে অংশীজন হিসেবে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞ শিক্ষক ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুন্ত করা প্রয়োজন। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকারের বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
২. শিক্ষক নিয়োগ: কমিশন যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের প্রায়োগিক নীতিমালা প্রদান করতে পারেন। যেখানে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় রাখার নিমিত্তে একটি আদর্শ প্রক্রিয়া - যেমন লিখিত পরীক্ষা, ডেমনস্ট্রেশন ও মৌখিক পরীক্ষার ফলাফল যোগ করে গবেষণা প্রবন্ধ, কনফারেন্স পেপার, পিএইচডি (যদি থাকে), পূর্ব অভিজ্ঞতা, ইত্যাদি বিষয় অগ্রাধিকার দিয়ে “মাল্টিপল ব্লাইন্ড পিয়ার রিভিউ" পদ্ধতিতে সম্পন্ন করা যায় কিনা সে সম্পর্কে কমিশন সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিতে পারেন।
৩. শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ তৈরি ও দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি বন্ধ: শিক্ষায়তনের বিদ্যমান আইন, ধিবিধানগুলো যথাযথ প্রয়োগপূর্বক সব মত ও পথের শিক্ষার্থীদের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া হলগুলোতে যথাসম্ভব মেধাভিত্তিক আসন বণ্টন করে সৃজনশীল ও মননশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনকে আনন্দময় করে তুলতে হবে। এজন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানও জরুরি। তবে শিক্ষায়তনের আইনগত কাঠামোর আওতায় বিধিবিধান প্রয়োগ করে ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলীয় লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে হবে।
৪. শিক্ষক প্রশিক্ষণ: প্রত্যেক স্তরের শিক্ষককে প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে যাতে শিক্ষার মানোন্নয়ন সুনিশ্চিত হয়। উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক প্রশিক্ষণ একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা অতীব জরুরি। ওই প্রশিক্ষণ একাডেমিতে অ্যাকাডেমিক (কারিকুলাম, কো-কারিকুলাম, এক্সট্রা কারিকুলাম), প্রশাসনিক, আইন-সংবিধি, আর্থিক নিয়মাবলি, তথ্যপ্রযুক্তি, গবেষণা-প্রকাশনা-উদ্ভাবনসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে একটি ফাউন্ডেশন ট্রেনিং চালু করা যেতে পারে। ইউ জি সি ইতোমধ্যে এ বিষয়ে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতে ইউ জি সি’র এ উদ্যোগ সুদূর প্রসারী ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
৫. ছাত্রছাত্রীদের মূল্যায়ন রিপোর্ট: তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষে উপস্থিতি এবং তাদের মূল্যায়ন রিপোর্ট অভিভাবকদের অবহিতকরণসহ শিক্ষায়তনের আপডেট তথ্যাদি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সর্বোপরি, উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার নিবিড় পরিবীক্ষণের জন্যে ইউ জি সি কে শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।
উপসংহার
শিক্ষা যদি হয় জাতির মেরুদন্ড তাহলে শিক্ষার উপর আমাদের সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এই সময়ে আমাদের শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করতে হবে। চিন্তা করতে হবে, বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে আমাদের অবস্থান। আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট তো আছেই। সে লক্ষ্যে আমাদের শিক্ষা, শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ সেই লক্ষে কাজ করে যাচ্ছে নিরলসভাবে।
লেখক: উপদেষ্টা, গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগ ও প্রক্টর, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
ই-মেইল: amatin@aub.ac.bd
তথ্যসূত্র
1. University Grants Commission of Bangladesh. 2009. Handbook: Universities of Bangladesh 2009. Dhaka, UGC,
2. রহমান, মোহাম্মদ মজিবুর, ২০২৫। “শিক্ষা সংস্কারঃ সংকট ও উত্তরণ”। ঢাকা, আদর্শ প্রকাশনী, পৃ১৪।
3. শাহেদ, হোসনে আরা, সম্পা, ২০১৯। “বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা”। ঢাকা, সূচীপত্র,পৃ ২৩-৫।
4. Asadullah, M Niaz, Antonio Savoia and Wahiduddin Mahmud, 2014. “Paths to Development: Is there a Bangladesh surprise?” World Development. Volume 62, October, Pages 138-154
5. Asadullah, M Niaz, Antonio Savoia and Kunal Sen (2020). “Will South Asia achieve the Sustainable Development Goals by 2030? Learning from the MDGs experience,” Social Indicators Research, 152, 165-189.
6. Andaleeb, Saad (2024). Public universities and research: In 2022 and beyond, The Daily Star, 12 Feb, 2022.
7. Bangladesh Bureau of Statistics (BBS). Statistical Yearbook of Bangladesh 2023. Dhaka: BBS, 2024.
8. http://unstats.un.org/sdgs/report/2022. (Accessed on October 1, 2024)
9. Bangladesh Government. The Constitution of the People’s Republic of Bangladesh. Clause 17.
10. World Bank. Report on Primary and secondary education of Bangladesh. Washington: World Bank Report No. 234.
11. UNDP. Global Knowledge Index. 2023.
12. Swain, Bali and Yang-Wallentin, F. (2023) Achieving sustainable development goals: predicaments and strategies. International Journal of Sustainable Development & World Ecology, vol 27(2): 96 -106.
13. Barrett, A. M. (2011). A millennium learning goal for education post-2015: A question of outcomes or processes. Comparative Education, 47(1), 119–133.
14. https://bangladesh.un.org/en/sdgs/4
15. Imon IMM (2017) ICT integration in secondary education in Bangladesh: A study of policy and practice. Master’s Thesis, University of Oslo, Norway. Available at https:// www.duo.uio.no/bitstream/handle/10852/61350/1/ Imran-Thesis-CIE–17-.pdf (accessed 29 Jul 2025).
16. World Bank (2016) Bangladesh: Ensuring Education for All Bangladeshis. Available at: http://www.worldbank. org/en/results/2016/10/07/ensuring-education-for-allbangladeshis (accessed on 28 July 2025).
17. Rahman M (2017) Secondary education: A long way to go. The Daily Star, 28 February. Available at: https://www. thedailystar.net/education-employment/secondary-educa tion-long-way-go-1366504 (accessed 24 uly 2025).
18. en SD (2004) The power of reading: Insights from
19. the research. ABC-CLIO. Available at: https://goo.gl/
20. 5UM33B (accessed 6 March 2018).
21. Ranfeng Qiu(2023). Achieving sustainable development goals through a sharing economy: Empirical evidence from developing economies. Journal of Innovation & Knowledge, vol 8(1)
22.https://www.researchgate.net/publication/397608318_Muhammad_Qudrat-e-Khuda_Education_Commission_Report_and_the_National_Education_Policy_2010_A_Comparative_Analysis (Accessed on 9 December 2025)