ঢাবি ক্যাম্পাস হারাচ্ছে নান্দনিকতা ও সারল্য, সৌন্দর্য রক্ষার্থে নীতিমালা হবে কবে?
- ড. কাবেরী গায়েন
- প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৩৮ PM , আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৪২ PM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। অনেক পরিবর্তন হয়েছে সেই শিক্ষার্থী জীবন থেকে এই পর্যন্ত। লাইব্রেরির সামনের মাঠে আমরা একসময় ক্লাসশেষে ঘাসে বসে বন্ধুদের সাথে গল্প করতাম। সবুজ মখমলের মতো ঘাসে বসে আমরা নোট বিনিময় করতাম, গল্পের বই আদান-প্রদান করতাম। ঘাসে বসতাম কলাভবনের সামনের চত্বরে, মার্লো চত্বর তথা মল চত্বরে। সেসব মধুর স্মৃতিগুলো ছিল নব্বই দশকের। তখনো জায়গায় বেজায়গায় বড় বড় বেখাপ্পা দালান গজিয়ে ওঠেনি, ক্যাম্পাসটি নোংরা ও ময়লার জঞ্জাল হয়ে ওঠেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে চাকরিসূত্রে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলাম। সেখান থেকে চলে গেলাম দেশের বাইরে পড়তে। তাই মাঝের কয়েক বছর তেমন যোগাযোগ থাকেনি। ২০০৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে চাকরি করতে ঢোকার পরে বুঝলাম, ততদিনে সবুজ হারিয়ে গেছে ক্যাম্পাস থেকে, পরিচ্ছন্নতা উড়ে গেছে।
আমার বড় ভাই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী। ১৯৭৮ সালে দেশ ছেড়ে মার্কিন মুলুকে পিএইচডি করতে চলে যান। ওখানেই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় থেকে যান। মাঝে মাঝে দেশে এলেও ক্যাম্পাসে খুব একটা যাননি। ২০১২ সালের দিকে এলেন আমার সঙ্গে কলা ভবনে, আমার বিভাগে। তার অসম্ভব স্মৃতিশক্তি। এখনো বলে দিতে পারেন, তাদের সময়ে কোন কোনায় কোন গাছ ছিল। মার্লো চত্বরের সামনে দাঁড়িয়ে খুব মন খারাপ করলেন এত নোংরা দেখে। জিজ্ঞেস করলেন কেউ পরিস্কার করে না? ক্যাম্পাস দেখে খুব হতাশ হলেন।
সারা শহরের রোমান্টিক জুটিদের বিনে পয়সার নিরাপদ প্রেমপার্ক হয়ে উঠেছে কলাভবন এবং সামাজিক বিজ্ঞান ভবন চত্বর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অংশটা আসলে আর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর নেই, এটা মানতে হবে। বহিরাগতদের মুখে আমি সন্ধ্যার দিকে ডিপার্টমেন্টের থেকে বের হয়ে আসার সময়ে বিশ্রি মন্তব্য শুনেছি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে; যা আগে কল্পনাও করা যেত না। সত্যি কথা বলতে সন্ধ্যার পর বিভাগ থেকে ক্যাম্পাস পার হয়ে ফুলার রোড পর্যন্ত যেতে আমার ভয় কাজ করেছে। এটা নিঃসন্দেহে একটা ক্যাম্পাসের পরিবেশ হতে পারে না।
তারপরে ক্যাম্পাসে আরো কত পরিবর্তন যে হয়েছে! সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের মত আখাম্বা একটা দালান হয়েছে। লাইব্রেরির সামনের মাঠ ভরা হয়েছে খাবারের দোকান দিয়ে। সেখানে রাজ্যের জঞ্জাল। ওখানে একটা ছোট পুকুরের মত গর্ত করা হয়েছে। বেশিরভাগ সময়েই কোন জল থাকে না। আর থাকলেই বা কী? যত প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের ঠোঙ্গা, নোংরা টিস্যু দিয়ে বোঝাই ওই জায়গা। কলা অনুষদ চত্বরের কোথাও এক চিলতে খালি জায়গা নেই। শুনেছি যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের ছাত্রনেতাদের টেন্ডার ইত্যাদি দেয়ার একমাত্র উপায় হল নানা নির্মাণ কাজ। গত পনেরো বছর ক্ষমতায় থাকা দলের প্রশাসন তাদের ক্যাম্পাস নেতাদের তুষ্ট করেছে। যে-কারণে কলাভবনের শিক্ষক লাউঞ্জের ভেতরেও কাঠের পিলার দিয়ে দিয়ে কিম্ভূত কিমাকার অবয়ব দেয়া হয়েছে। আঁদ্রে মার্লো চত্বরের সবুজ মাঠ কংক্রিট দিয়ে ঢেকে সিমেন্ট করে কিছু জিনিয়া জাতীয় ফুলের গাছ লাগানো হয়েছে। এখানেও ঝর্ণার মত করা হয়েছে। চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিকের খালি পানি বোতল যার অবধারিত ভবিতব্য। রয়েছে সেন্টাল লাইব্রেরির গেটের কাছে খাবারের দোকান, ভেতরে খোলা চুলায় ভাজা হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর সব চপ, চা, সিঙ্গারা। গেট থেকে বের হলেই পাশে ফুটপাথে যে যা পারে নিয়ে বসে গেছে বিক্রিবাট্টায়। কাপড়-চোপড়-জুতা স্যান্ডেল থেকে কী নেই! আরেকটু এগিয়ে যান টিএসসি। কদাকার এক ফোন কোম্পানির কী এক স্থাপনা। টিএসসির ভেতরে এক সময় আমরা নানা আবৃত্তির দল, নাটকের দল বসতে দেখেছি। এখন সেসব কাজ বন্ধ। ভেতরে যাওয়া যায় অডিটোরিয়ামে কোন অনুষ্ঠান হলে। গেট বন্ধই থাকে দেখেছি। মেট্রোরেল হবার পর এবং টিএসসি জংশন হবার কারণে এই এলাকাটা একটা গিজ গিজ করা হাটের মত হয়ে গেছে।
কার্জন হল, সায়েন্স এনেক্স কিংবা মোকাররম ভবন, সেন্টার ফর এক্সেলেন্স চত্বর কিন্তু এমন নয়। এত নোংরা না। যত চাপ কলাভবনে। রিকশাওয়ালা ভাইয়েরা নারিকেল গাছের গোড়ায় সন্ধ্যার দিকে দেখেছি প্রস্রাব করতে বসে যান। গত বছর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক সমাবেশে আসা ব্যক্তিরা গোটা ক্যাম্পাসকে গণ শৌচাগার বানিয়ে ফেললেন, মেয়েদের হলে ঢুকে যেতে চাইলেন। আর সারা শহরের রোমান্টিক জুটিদের বিনে পয়সার নিরাপদ প্রেমপার্ক হয়ে উঠেছে কলাভবন এবং সামাজিক বিজ্ঞান ভবন চত্বর। সেটা বরং অতোটা খারাপ না কিন্তু খুব চাপ পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অংশটা আসলে আর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর নেই, এটা মানতে হবে। বহিরাগতদের মুখে আমি সন্ধ্যার দিকে ডিপার্টমেন্টের থেকে বের হয়ে আসার সময়ে বিশ্রি মন্তব্য শুনেছি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যা আগে কল্পনাও করা যেত না। সত্যি কথা বলতে সন্ধ্যার পর বিভাগ থেকে ক্যাম্পাস পার হয়ে ফুলার রোড পর্যন্ত যেতে আমার ভয় কাজ করেছে। এটা নিঃসন্দেহে একটা ক্যাম্পাসের পরিবেশ হতে পারে না।
অনেকে লিখছেন বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়েও নাকি হকার থাকে ক্যাম্পাসের মধ্যে। কিছু টুকটাক থাকা অসম্ভব নয়। তবে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের কিছু ভালো ভালো ক্যাম্পাস দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। নিজের কারণে এবং পরিবারের সদস্যদের নানা ক্যাম্পাসে সংযুক্তিসূত্রে। আমি হলফ করে বলতে পারি, এত নৈরাজ্যকর, নিয়ন্ত্রণহীন যথেচ্ছ ব্যবহারের ক্যাম্পাস আমি কোথাও দেখিনি। সামারে ক্যাম্পাসের ঘাসে শিক্ষার্থীদের শুয়ে বই পড়তে দেখেছি, প্রেমিকের সাথে শুয়ে সূর্যস্নান করতে দেখেছি কিন্তু এমন অবাধ বাণিজ্য এবং মূত্রবিসর্জনের জায়গা হয়ে উঠতে কোথাও দেখিনি। কোথাও না। এমনকি ভারতের শিলচর বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা তেজপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছি। গেছি পুরুলিয়ার মত প্রত্যন্ত জায়গার বিশ্ববিদ্যালয়ে। এমন দেখিনি। আমাদের দেশ যত না গরীব, আমাদের রুচি গরীব, আমাদের রাজনীতি আরো গরীব। সবচেয়ে গরীব হল পপুলিস্ট রাজনীতি।
ফেসবুকে দেখলাম ডাকসুর নেতারা গিয়ে হকারদের উপর চড়াও হয়েছেন। এটা নিঃসন্দেহে মন্দ কাজ। তীব্র প্রতিবাদ জানাই। তাদের কাছে জবাবদিহি চাওয়া হোক। সবচেয়ে বড় কথা তাদের ফাটাকেষ্ট হবার ক্ষমতা দেয়া হয়নি। এজাতীয় কিছু করতে হলে প্রশাসন করবে। এক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব এসব বিষয়ে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে একটি নীতিমালা তৈরি করার ব্যাপারে সাহায্য করা। কাজেই যেভাবে হকারদের গায়ে হাত তুলেছেন এসব নেতারা, তারা অন্যায় করেছেন। এটা বন্ধ করতে হবে। এই কাজ করার এখতিয়ারই তাদের নেই। সবচেয়ে যেটা খারাপ লেগেছে, তারা চড়াও হয়েছেন ভাসমান বাদাম বিক্রেতা, চা বিক্রেতাদের উপরে। পরিবেশ ওনাদের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এক মাঠের মধ্যে তিন চারটা জায়গায় আগুন জ্বালিয়ে বড় বড় খাবারের দোকান চালালে। আমি বলছি লাইব্রেরির গেট থেকে ডাকসু ক্যাফেটারিয়া পর্যন্ত তিনটা খাবারের দোকান ও স্থাপনা চালালে। এইটুকু জায়গার মধ্যে ফের অন্য খাওয়ার ব্যবসা চালালে। ক্যাম্পাসকে অবাধ মূত্রালয় বানানোর লাইসেন্স দিলে। টিএসসির দেয়ালের পাশে চায়ের দোকানগুলো ঘিরে ময়লার জঞ্জাল অরণ্য বানিয়ে তুললে। শিক্ষার্থীদের জন্য যথাযথ টয়লেটের ব্যবস্থা না থাকলে।
কলা ভবনের ১০৮৮ নম্বর কক্ষ নিয়ে আমার বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের খুব উচ্ছ্বাস দেখি। অথচ আমি কোনদিন ওই কক্ষটা পছন্দ করতে পারিনি প্রস্রাবের দুর্গন্ধের জন্য। না শিক্ষার্থী জীবনে, না শিক্ষক হয়ে।
আমি একটু অজনপ্রিয় মত নিয়েই হাজির হয়েছি আজ। কলা ভবন এবং সামাজিক বিজ্ঞান ভবনের দুই চত্বরকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানাই। হকাররা আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন, গরীব মানুষরা এদেশের সব আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে ক্যাম্পাসের জায়গায় জায়গায় খাবারের দোকান, বাজার-ঘাট-শাড়ি-কাপড়-স্যান্ডেল সব বিক্রির জায়গা করে তুলতে হবে, উন্মুক্ত মুত্রালয় বানিয়ে ফেলতে হবে, এমনসব বিষয়কে বামপন্থার রাজনীতি যারা বলছেন তারা কেনো বলছেন জানি না। আমি দ্বিমত পোষণ করি। মেট্রোরেল ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাবার সময়েও বিরোধিতা করেছি। টিএসসিতে জংশন করার বিরোধিতাও করেছি। জানা কথাই যে ক্যাম্পাসটা জাহান্নাম হয়ে উঠবে। আমি বিদ্যায়তনের সারল্য বজায় থাকে এমন একটা পরিচ্ছন্ন ক্যাম্পাস দাবি করি। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে যেনো কারো রাজনৈতিক দূর্গ বানানোর অভিসন্ধি প্রতিষ্ঠিত না হয়, সেটাও সুস্থ রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলা করার আছে।
একটা নীতিমালা চাই ক্যাম্পাসে কটা ফটোকপির দোকান থাকবে (দশ মিনিটের হাঁটাপথে গেলেই নীলক্ষেত), কটা চায়ের দোকান থাকবে, এক মাঠের মধ্যে খাবারের কটা আগুন জ্বালানো দোকান থাকবে। এসব দোকানের বরাদ্দ পেতে ক্ষমতাসীন প্রশাসনকে তুষ্ট করেই পেতে হয়। এসব জঙ্গমের তুলনায় বাদাম-বিক্রেতা, কদবেল বিক্রেতা, আইস্ক্রিম বিক্রেতা, ফুল-বিক্রেতা শিশুরা বরং ক্যাম্পাসের অর্গানিক অংশিদার। তাদের তাড়ানোর জন্য ফাটাকেষ্টগিরি দেখানোর দরকার নেই। তারা পরিবেশের ক্ষতি করে না। হলের ক্যান্টিন, ডাইনিং, ডাকসু ক্যাফেটারিয়া এগুলোকে প্রাণবান করা হোক। প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়া নির্মাণ করা হোক শিক্ষার্থীদের জন্য। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বড় রাজনৈতিক সমাবেশ হলে, পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুরারিতে ক্যাম্পাস কীভাবে কতোটা উন্মুক্ত রাখবে তার পরিসর-এসব নিয়ে চিন্তা এবং সক্রিয়তার ব্যাপার আছে।
ঢাবি শুধু নয়, আমাদের কোনো ক্যাম্পাসই ভাগাড় না হোক। আবার কারো উপর জুলুম না হোক। রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি নয়, দৃষ্টিভঙ্গি হোক সমস্যা সমাধানের।
ড. কাবেরী গায়েন: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়