বাংলাদেশ কি অবশেষে পেল সত্যিকারের লেগ স্পিনার?

নওশাদ জামিল
নওশাদ জামিল  © টিডিসি সম্পাদিত

ছোটবেলায় টেলিভিশনের পর্দায় শেন ওয়ার্নের বোলিং দেখতাম মুগ্ধ হয়ে। মায়াবী ঘূর্ণিবলে টার্নের পর টার্ন, ব্যাটসম্যানের পরাজিত ও বিভ্রান্ত মুখ, আর স্টাম্প উড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে রোমাঞ্চিত হতো কিশোর মন। মনে হতো ক্রিকেট যেন এক জাদুবিদ্যা, শেন ওয়ার্ন তার জাদুকর। কিশোর মনে প্রায়ই প্রশ্ন ঘুরত, বাংলাদেশে কবে একজন লেগ স্পিনার আসবে, যার বলে ব্যাটাররা দিশেহারা হয়ে পড়বে?

এ কথা অনেকেই জানেন, বাংলাদেশের ক্রিকেটে বাঁহাতি স্পিনারের অভাব কোনোদিনই ছিল না। রফিক, এনামুল, সাকিব, তাইজুল ইত্যাদি সবাই বাংলাদেশের স্পিন ঐতিহ্যেরই অংশ। ডানহাতি লেগ স্পিন? এ যেন এক অনন্ত শূন্যতার গল্প।

কৈশোরের দিনগুলোতে যখন বিভোর হয়ে ক্রিকেট দেখলাম, দিনের পর দিন টেলিভিশনের পর্দার সামনে বসে থাকতাম, তখন বাংলাদেশ দলে কোনো লেগ স্পিনারই ছিল না। পরে অবশ্য মোহাম্মদ আশরাফুল ও অলক কাপালি জাতীয় দলে এসেছিলেন, দুজনেই মাঝে মাঝে লেগ স্পিন করতেন। দুজনই ছিলেন মূলত ব্যাটার, জেনুইন বোলার নন। যার ফলে বাংলাদেশের ক্রিকেটে একজন প্রকৃত লেগ স্পিনারের জন্য হাহাকার ছিল দীর্ঘদিন ধরেই।

অনেক বছর পরের কথা। জাতীয় দলের কোচ হয়ে আসেন চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, গর্ডন গ্রিনিজ, ডেভ হোয়াটমোর, জেমি সিডন্স কিংবা স্টুয়ার্ট ল-এর মতো সফল কোচদের ভিড়ে চন্ডিকা একেবারে আলাদা চরিত্র। সাহসী, আগ্রাসী এবং বিশ্বাসে দৃঢ়। দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নামেন। চন্ডিকার পরীক্ষাগুলো ছিল ঝুঁকিপূর্ণ ও ফলপ্রসূও। ক্রিকেটারদের নতুন কিছু শেখাবেন, সাহসী সব ঝুঁকি নেবেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন, নতুন প্রতিভা বের করে আনবেন ইত্যাদি সফল কোচের যত গুণ থাকা দরকার, চন্ডিকার সবই ছিল মনে করি।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশের ক্রিকেট বদলাচ্ছে, দর্শক মানসিকতা কি বদলাবে?

সাফল্যের জন্য মরিয়া ও পাগলাটে কোচ চন্ডিকা যেন লেগ স্পিনার হান্ট শুরু করেন। কোথায় ডানহাতি লেগ স্পিনার? ঘরোয়া ক্রিকেটে তাদের তেমন যত্নআত্তি নেই, বাঁহাতি স্পিনারের ভিড়ে তাদের কোনো কদর নেই। এ সময় চন্ডিকা খুঁজে পান তরুণ লেগ স্পিনার তানভীর হায়দার, জুবায়ের হোসেন লিখন, আমিনুল ইসলাম বিপ্লবকে। তিনজনকেই জাতীয় দলে সুযোগ দেন তিনি। খানিকটা আলো ছড়িয়েছিলেন তারা, তবে ক্ষণিকের জন্য। দুঃখজনক ব্যাপার, তাদের কেউই টিকে থাকতে পারেননি, জাতীয় দলে স্থায়ী হতে পারেননি। লেগ স্পিনার পেয়েও যেন পায় না বাংলাদেশ।

বাংলাদের সফল কোচ চন্ডিকা হাল ছাড়লেন না, নাছোড়বান্দার মতো খুঁজতে থাকেন লেগ স্পিনার। তিনি আবার ‘বাজি’ ধরেন, নতুন করে একজন প্রকৃত লেগ স্পিনারের স্বপ্ন দেখেন। অনেকেই হয়তো জানেন না, চন্ডিকার বাজিই আজকের রিশাদ হোসেন।

অল্পদিনেই রিশাদ জাতীয় দলে আলো ছড়িয়েছেন, দারুণ সব সাফল্য পেয়েছেন। ইদানীং রিশাদের বোলিং দেখলে প্রায়ই ভারতের কিংবদন্তি লেগ স্পিনার অনিল কুম্বলের কথা মনে পড়ে যায়। উচ্চতা, বলের গতি, বাউন্স আদায় করার কৌশল—ইত্যাদি নানা কিছুতে যেন খানিকটা মিল পাওয়া যায়। রিশাদের জন্য হয়তো কুম্বলের মতো উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছানো এখনো অনেক দূরের পথ, তবে খাঁটি লেগ স্পিনার হওয়ার যাত্রী তিনি নিশ্চিতভাবেই।

রিশাদকে আমি লক্ষ্য করছি তার কৈশোর থেকেই। অনেকবার বলেছি, ‘এ ছেলেটি অনেক দূর যাবে।’ মিরপুরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডে ম্যাচে রিশাদ হোসেন যেন নিজের ভবিষ্যতের দিকচিহ্ন এঁকেছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো অর্জন করেছেন নিজের প্রথম ‘ফাইফার’। অর্থাৎ এক ইনিংসে পাঁচ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব। শেষ পর্যন্ত ৩৫ রানের বিনিময়ে শিকার করেছেন ৬ উইকেট। রিশাদই বাংলাদেশের প্রথম ডানহাতি স্পিনার, যিনি ওয়ানডেতে ৫ উইকেট নিয়েছেন।

নীলফামারি থেকে উঠে এসেছেন রিশাদ হোসেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট কাঠামোর কেন্দ্র থেকে অনেকটাই দূরে তার জেলা। ১২ বয়স থেকেই ক্রিকেটের পথে যাত্রা শুরু। একদম শুরু থেকেই তিনি লেগ স্পিনার হবেন বলেই ঠিক করেছিলেন। জীবনের প্রথম বলটা তিনি করেছিলেন লেগ স্পিন গ্রিপেই। বাঁ-হাতি স্পিনার হওয়ার সংস্কৃতির মাঝে দাঁড়িয়ে তিনি এক ঝুঁকিপূর্ণ স্বপ্নই দেখেছিলেন। স্বপ্ন তো অনেকেই দেখেন। তবে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার মত ধৈর্য আর একাগ্রতা থাকে না অনেকেরই। রিশাদের তা ছিল বলাই যায়। 

ক্রিকেটার হওয়ার পথে রিশাদের জন্য স্কুল ক্রিকেট থেকে জেলা পর্যায়ের খেলার রাস্তাটা মোটামুটি সহজ ছিল। নিজ স্কুলের হয়ে বল হাতে চমকই দেখিয়েছিলেন। তারপর জেলা দল ও বিভাগীয় দলেও খেলার সুযোগ মিলেছিল তার। রিশাদের নজরকাড়া শুরু হয় রবি আয়োজিত স্পিনার হান্ট থেকেই। টেলিকম প্রতিষ্ঠান ‘রবি’ নিয়ম করে ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্রাম করত। এখন তা বন্ধ হয়ে গেছে বোধহয়। অনেকের হয়তো মনে থাকবে, রবির পেসার হান্ট প্রোগ্রাম থেকেই উঠে এসেছিলেন বাগেরহাটের রুবেল হোসেন। 

স্পিনার হান্টে রিশাদের উচ্চতা আলাদা করে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। রিশাদের উচ্চা প্রায় ৬ ফিট ২ ইঞ্চি। বাংলাদেশে তার মতো দীর্ঘদেহী স্পিনার যেন বিরলই বলা যায়। স্পিনার হান্ট প্রোগ্রাম থেকেই রিশাদ ছিলেন বিসিসির রাডারে, নজরে। তারপরও দ্রুতই জাতীয় দলে জায়গা পাবেন, অনেকেই তা ভাবতে পারেননি। 

বছর দুই আগের ঘটনা। চান্ডিকা ঘরের মাঠে আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে নতুন ‘বাজি’ ধরেন। রিশাদকেও জাতীয় দলের জার্সি তুলে দেওয়া হয়। চট্টগ্রামে আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে অভিষেক হয় রিশাদের। অভিষেক ম্যাচে তার যাত্রা ছিল সাধারণ; অনেকেই ভেবেছিলেন, রিশাদও হয়তো আরেকজন হারিয়ে যাওয়া প্রতিভা হয়ে থাকবেন।

চন্ডিকা হতাশ হননি, হালও ছাড়েননি। তিনি রিশাদকে আরও সুযোগ দেন। নিউজিল্যান্ড সফরে রিশাদ ভালো পারফর্ম করেন। তারপর দেশের মাটিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে যেন এক নতুন জন্ম হয় তার। শ্রীলঙ্কা সিরিজের পরই ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরে যায় রিশাদের। ব্যাট হাতেও তিনি দেখান দারুণ ঝলক, তারপর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তো অন্যতম সেরা বোলার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

বর্তমানে রিশাদ টি-টোয়েন্টি দলে প্রায় অটো-চয়েজ। ওয়ানডেতেও নিজের সামর্থ্য প্রমাণ করে চলেছেন। আশা করা যায়, শিগগিরই টেস্টেও দেখা যাবে তার জাদু। জাতীয় দলে একজন লেগ স্পিনার কতটা গুরুত্বপূর্ণ, ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে তা অজানা নয়। একজন লেগ স্পিনার হয়তো অনেক সময় মার খান, তবে অধিকাংশ সময়ই তারা ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন। প্রয়োজনের মুহূর্তে উইকেট শিকার করতে পারেন। 

ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজেকে ঝালাই করে নেওয়ার, সক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগ বাংলাদেশের কোনো লেগ স্পিনার তেমন পান না। একই দশা ছিল রিশাদেরও। তিনিও ডাগআউটে বসে দিনাতিপাত করেছেন লম্বা সময়। দেশি ক্লাবগুলো ইকোনমিক্যাল বাঁ-হাতি অফ স্পিনার খেলায় নির্দ্বিধায়। আক্রমণাত্মক লেগ স্পিনারকে একাদশে সুযোগ দেওয়া যেন ঘোরতর অপরাধ। রিশাদ জাতীয় দলের জার্সি গায়ে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। তবেই তিনি ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত খেলার সুযোগ পেয়েছেন। 

রিশাদ খুবই সম্ভাবনাময় লেগ স্পিনার, ভবিষ্যতের জনপ্রিয় ক্রিকেটার। উচ্চতা, ফিটনেস, বোলিং, ফিলিং, ব্যাটিং মিলিয়ে তিনি যেন   একজন সত্যিকার স্পোর্টসম্যান। তবে তার এখনও অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়া বাকি, এখনও অনেক কিছু শেখার বাকি। এখনও তার অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হওয়া বাকি। 

রিশাদের যেমন অনেক শক্তির জায়গা আছে, তেমন আছে নানা দুর্বলতা। তার স্পিনের ঝুড়িতে এখনো খুব বেশি অস্ত্র নেই। তাকে আরও নিখুঁত গুগলি আয়ত্ত করতে হবে, ফ্লিপার ও টপ স্পিনে আনতে হবে ধার ও বৈচিত্র্য। তবে তার মানসিক দৃঢ়তা, শৃঙ্খলা ও আত্মবিশ্বাসই বড় মূলধন। তিনি জানেন, প্রকৃত লেগ স্পিনার হতে হলে এটিকে যেন ‘ইবাদত’ হিসেবে গ্রহণ করতে হয়। বাংলাদেশের কোচিং স্টাফ, ক্লাব ক্রিকেটের হর্তাকর্তারা যদি তাকে সঠিক যত্ন ও পরিচর্যা দেন, তবে রিশাদ হতে পারেন বাংলাদেশের ক্রিকেটে এক অমূল্য সম্পদ। 

একজন ধ্রুপদি লেগ স্পিনার হতে হলে, ব্যাটারদের মায়াবী ঘাতক হতে হলে রিশাদকে প্রতিদিনই আরও নিবিড়ভাবে অনুশীলন করতে হবে, নিজের বলের ভ্যারিয়েশন ও মানসিক দৃঢ়তা বাড়াতে হবে। শেন ওয়ার্ন বা অনিল কুম্বলের উচ্চতায় তিনি পৌঁছাতে পারবেন না হয়তো। তারপরও বিশ্বাস করি রিশাদ বাংলাদেশের ক্রিকেটে বিরল এক অধ্যায় লিখবেন, বহুদিন পরও তা আলো ছড়াবে, হয়ে উঠবে ক্রিকেটের মহাকাব্যিক রূপকথা।

নওশাদ জামিল: কবি, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক


সর্বশেষ সংবাদ