বিবিসি’র সঙ্গে সাক্ষাৎকার: নেতৃত্বে লিজেন্ডারি প্রমাণ করলেন তারেক রহমান
- প্রফেসর ড. সাইফুল ইসলাম
- প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:৩৯ PM , আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৪১ PM
রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও জাতীয় চেতনার মধ্যকার সম্পর্ক বরাবরই বহুমাত্রিক ও জটিল। বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিক অস্থিরতায় জর্জরিত প্রেক্ষাপটে এই সম্পর্ক আরও ঘনীভূত হয়। বিশেষত, বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাম্প্রতিক বিবিসি বাংলার সাক্ষাৎকার বিষয়টি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এটি নিছক একটি গণমাধ্যম-ঘটনা নয়—বরং রাজনৈতিক নির্বাসন, নেতৃত্বের নৈতিক জায়গা ও গণতান্ত্রিক পুনর্নবীকরণের সম্ভাবনা নিয়ে গভীর আলোচনা উসকে দেয়। ১৭ বছর পর, হাজার মাইল দূর থেকে তারেক রহমানের কণ্ঠস্বর যখন জাতীয় পরিসরে আবারও প্রতিধ্বনিত হয়, তখন তা শুধু নস্টালজিয়ার আবেগে সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং তা দলীয় সীমা, ব্যক্তিগত বেদনা ও জাতীয় স্মৃতির বাইরেও প্রসারিত হয়। রাজনৈতিক নির্বাসনের ঘটনাবলি ইতিহাসে সর্বদাই এক ধরনের প্রতীকী ক্ষমতার ইঙ্গিত বহন করে। তারেক রহমানের দীর্ঘকাল বিদেশে অবস্থান এবং সেখান থেকে ফিরে আসা—এটি যেন জাতীয় চেতনায় এক নতুন মাত্রা যোগ করল।
২.
বিবিসি বাংলার মাইক্রোফোনে তার স্বর, "আমি দূরে থাকলেও দেশের সঙ্গে আমার মানসিক সম্পর্ক কখনো ছিন্ন হয়নি"—এটি কেবল প্রচলিত রাজনৈতিক বুলি নয়, বরং এক গভীর, আন্তরিক ও আবেগঘন সংযোগের প্রকাশ। বাংলাদেশে, যেখানে শারীরিক অনুপস্থিতিকে অনেক সময়ই রাজনীতি ছেড়ে দেওয়া হিসেবে দেখা হয়, সেখানে এই বক্তব্য নির্বাসনকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করে; এটি কেবল বিচ্ছিন্নতা নয়, বরং ত্যাগ-তিতিক্ষা ও অবিচল প্রতিশ্রুতির স্থান। এখানে উল্লেখযোগ্য, তারেক রহমানের দেশপ্রেমের বয়ান কখনোই চিৎকার-চেঁচামেচি, বাগাড়ম্বর বা আত্ম-প্রচারমূলক নয়। বরং, তাঁর কথায় উঠে আসে দুঃখের দীর্ঘশ্বাস, দায়িত্ববোধের দৃঢ়তা এবং আত্মসংযমের বার্তা। "নেতৃত্বের সত্যতা নির্ধারিত হয় ভৌগোলিক অবস্থান নয়, বরং অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ও ধারাবাহিক নিষ্ঠা দ্বারা"—এই ধারণাটি তার বক্তব্যে স্পষ্ট। এই দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে ‘নির্বাসিত নেতার মধ্যে অদম্য বাংলাদেশ’-এর প্রতীকে পরিণত করেছে। জাতীয় ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়, যেখানে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন ও প্রবাসী আকাঙ্ক্ষার প্রবাহ বারবার ফিরে আসে, সেখানে তারেক রহমানের মতো নেতার বক্তব্য সমাজের গভীরে অনুরণিত হয় এবং নতুন করে ভাবনার খোরাক যোগায়। তাঁর নির্বাসনের অভিজ্ঞতা এবং প্রতিদিনের সংগ্রাম—এই অংশে এক ধরনের আধ্যাত্মিকতা ও আত্মসংযমের ছোঁয়া পাওয়া যায়। তাঁর কথায়, প্রতিটি দিন যেন একেকটি ‘নির্বাসনের ডায়েরি’। নিজেকে কষ্টের গল্পের নায়ক হিসেবে নয়, বরং ক্ষমতার লোভকে প্রত্যাখ্যানকারী নীতিবান হিসেবে উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, "আমি শারীরিকভাবে দূরে থাকতে পারি, কিন্তু আমার মন ও বুদ্ধি বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম এবং মানুষের সাথে বাঁধা।" এই বক্তব্য কেবল আবেগের বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং নেতৃত্বের মানদণ্ডে নৈতিক স্থিতিস্থাপকতার গুরুত্বকে সামনে আনে। এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয়, তারেক রহমানের রাজনৈতিক দর্শন এবং দেশপ্রেম প্রধানত তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্য, বিশেষ করে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের উত্তরাধিকার থেকে উৎসারিত। তাঁর বক্তব্যে জাতীয় ইতিহাস, গ্রামীণ দৃশ্যপট এবং ব্যক্তিগত স্মৃতি একাকার হয়ে যায়। এইভাবে ব্যক্তিগত দুর্ভাগ্য জাতীয় অনুপ্রেরণার উৎসে রূপান্তরিত হয়। এতে বোঝা যায় নেতৃত্ব মানে কেবল উত্তরাধিকার নয়; নৈতিক দৃঢ়তা, জেদ এবং অধ্যবসায়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াও বটে। বিবিসি বাংলার এই সাক্ষাৎকার শুধুমাত্র একটি মিডিয়া ইভেন্ট নয়; এটি রাজনৈতিক নির্বাসনের নব্য সংজ্ঞা, নেতৃত্বের নৈতিকতা এবং জাতীয় স্মৃতির পুনর্নির্মাণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তারেক রহমানের কথাগুলো বাংলাদেশি রাজনীতিতে নতুন করে আলোচনার দ্বার খুলে দিয়েছে, যেখানে নির্বাসন মানে পরিত্যাগ নয় বরং প্রতিশ্রুতি, আত্মনিবেদন এবং জাতির প্রতি অবিচল ভালোবাসা। এই সাক্ষাৎকার রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং জাতীয় চেতনার ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে—এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
৩.
বিবিসি-তে তারেক রহমানের জুলাই ২০২৪-এর আন্দোলন নিয়ে কথা বলার সময়, একটা গ্যাপ-মোমেন্ট আসে—সোজা-সাপ্টা, “এটা শুধু বিএনপি’র আন্দোলন না, পুরো জাতির জাগরণ।’’ শুনলেই বোঝা যায়, ওনাকে শুধু নিজের দলের মঞ্চে আটকে রাখা যাচ্ছে না, পুরো দেশের কথা ভাবছেন। নিজেকে নেতা না, বরং “জনগণের অংশ’’ বলাটা—বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক’জন পারে এমন বিনয় দেখাতে? পুরা লাইনটা একটা সংহতির ছবি আঁকে, যেটা আমাদের দেশে সত্যি বলতে বিরলই। আরেকটু মুক্ত মন দেখান, ছাত্র আন্দোলনের কথাও টানেন, শিশু হত্যার কথা বলেই একদম কাঁপিয়ে দেন—“রাজনীতি কোনোদিনও শিশুদের রক্তে রঞ্জিত হতে পারে না।” এটা তো পুরা ঝড়ের মাঝে শান্তির ডাক। অহিংস, সহানুভূতিশীল—উদারনৈতিক আচরণের vibe পাওয়া যায়, বলতেই হবে। ওনার কথাবার্তাগুলো যেন একটা নৈতিক হিসেব-নিকেশের জায়গা বানিয়ে দেয়, যেখানে সবাই—সমর্থক আর বিরোধী—নিজের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে একটু হলেও ভাববে। আরো গুরুত্ববহ বিষয়, ওনার কাছে নির্বাচন মানে—“গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি।” বলছেন, “নির্বাচন সব সমস্যার সমাধান না, তবে আশা তৈরি করে।’’ মানে, একদম না হেঁটে, বাস্তবতা বুঝে, ভোটের প্রক্রিয়াটাকে ঠিক যতটা গুরুত্ব দেওয়া দরকার, ততটাই দিচ্ছেন। চোখ বুজে নির্বাচন মানে গণতন্ত্র, আবার একেবারে হতাশাও নন—একটা ব্যালান্স আছে। তারেক রহমানের আরেকটা জবরদস্ত লাইন—“আমাদের লড়াইটা কেবল ক্ষমতার জন্য না, জনগণের আস্থা ফেরানোর জন্য।’’ শুনেই বোঝা যায়, জিরো-সাম রাজনীতির দিন শেষ, এখন রিকভারির রাজনীতি দরকার। খালেদা জিয়ার “ভিশন ২০৩০”-এর কথাও আনেন—বাংলাদেশকে ২০৩০-এর মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে নিতে হবে, এই স্বপ্নটা শুধু কাগজে-কলমে না, বরং মানুষের প্রত্যাশায় গেঁথে ফেলতে চান। এই ভাবনা আস্থা, মর্যাদা আর অন্তর্ভুক্তির ওপর দাঁড়িয়ে—একটা “হিউম্যান প্রমিস’’ বলতে পারেন। পারিবারিক বিষয় নিয়ে বলার সময়, তারেক রহমানের কথায় গর্বও আছে, আবার একধরনের আত্মসমালোচনাও আছে। বাবার “স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন’’ আর মায়ের দৃঢ়তা—সব মানেন, তবে জোর দিয়ে বলেন, “পরিবার না, যোগ্যতা আসল।’’ এটা কিন্তু আমাদের দেশে রাজনীতিতে বেশ সাহসী কথা—যেখানে বংশ মানেই নেতা হওয়ার লাইসেন্স। ওনার লিডারশিপ মেধা আর নৈতিকতার ওপর দাঁড়িয়ে—এটা ট্র্যাডিশনাল রাজনীতির চেয়ে একটু আলাদা, মানতেই হবে। আর হ্যাঁ, ব্যক্তিগত দুর্বলতার কথা তুললে, হাসিমুখে বললেন, “আমার শরীর দুর্বল হতে পারে, কিন্তু ইচ্ছাশক্তি না।’’ এক ঢিলে দুই পাখি—নিজের লড়াইটা দেখান, আবার পুরো জাতিকে বলেন, “ভয় পেও না, শক্ত থাকো।’’ এই কথাগুলো—কেমন যেন একটা ইমোশনাল কানেকশন তৈরি করে। ব্যক্তিগত কষ্টকেও জাতীয় অধ্যবসায়ের গল্প বানিয়ে ফেলেন। সব মিলিয়ে, সাক্ষাৎকারটা—শুধু কথার কথা না, বরং একটা নৈতিক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়, কে কোন দলে সেটা বড় কথা না, সবাইকেই ভাবতে বাধ্য করে—রাজনীতি আসলে কার জন্য?
৪.
তারেক রহমানের আধুনিক নেতৃত্বের বিশ্লেষণে, তাঁর ডিজিটাল যুগ-সংক্রান্ত অবস্থান বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি শুধু প্রযুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে উচ্ছ্বাস দেখান না, বরং এর অন্তর্নিহিত বিপদের দিকটিও খোলাখুলি স্বীকার করেন। তাঁর ভাষ্যে—"সোশ্যাল মিডিয়া মানুষকে সচেতন করেছে, কিন্তু এটি ভুল তথ্যও ছড়ায়। দায়িত্ব আমাদেরই"—এই স্বীকারোক্তি আসলে এক প্রকার সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতার স্বীকৃতি। বর্তমান বিশ্বে, ডিজিটাল গণমাধ্যম যেমন ব্যক্তিকে ক্ষমতাবান করে, তেমনি বিভ্রান্তি, গুজব, মেরুকরণও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তারেক রহমানের এই দ্বৈত স্বীকৃতি তাঁকে এমন এক নেতার প্রতিচ্ছবি দেয়, যিনি প্রযুক্তি ব্যবহারের নৈতিকতা ও সামাজিক দায়িত্বকে গুরুত্ব দেন। এখানে তাঁর অবস্থান কেবল রাজনৈতিক সুবিধাবাদী নয়; বরং তিনি নাগরিকদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্বও স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে সচরাচর দেখা যায় না। বিএনপির অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা নিয়ে তাঁর স্বীকারোক্তি—"কিছু সদস্য ভুল করেছে, কিন্তু বিএনপি কখনও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়নি"—এটিকে নিছক আত্মপক্ষ সমর্থন কিংবা দলীয় প্রচার হিসেবে দেখলে ভুল হবে। বরং এটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক নতুন মাত্রার ইঙ্গিত দেয়, যেখানে স্বচ্ছতা ও আত্মসমালোচনা নেতৃত্বের অংশ হওয়া উচিত। তারেক রহমানের বক্তব্যে এক ধরনের আত্মবিশ্লেষণী নেতৃত্বের ছাপ স্পষ্ট, যা রাজনীতিতে জবাবদিহিতা ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার জন্য জরুরি। এই ধরনের সাহসী স্বীকারোক্তি ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রেও একটি দিকনির্দেশনা দেয়। শাসনব্যবস্থা ও রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে তাঁর মন্তব্য, "যদি আইন নিরপেক্ষ না হয়, তবে ন্যায়বিচার কখনও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না,"—এটি শুধু একটি রাজনৈতিক স্লোগান নয়; বরং গভীর নৈতিক ও দার্শনিক ব্যঞ্জনা বহন করে। এখানে তিনি শাসনের মৌলিক ভিত্তি হিসেবে আইনের শাসনের শ্রেষ্ঠত্বকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্যও গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রায়ই প্রশ্নবিদ্ধ। তারেক রহমানের বক্তব্য রাজনৈতিক ন্যায়বিচার ও রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার মধ্যকার সম্পর্ককে নতুনভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে—যেখানে অনিয়ম ও পক্ষপাতিত্ব রাষ্ট্রের ভিত নড়বড়ে করে দেয়।
৫.
সাক্ষাৎকারের সবচেয়ে আবেগঘন মুহূর্ত আসে তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সংকট নিয়ে কথোপকথনে। তিনি যখন "অরাজনৈতিক, মানবিক ট্র্যাজেডি"র অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন, তখন তা শুধু তাঁর পরিবারের নয়, বরং বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক পরিবারের সম্মিলিত কষ্টকে সামনে নিয়ে আসে। তাঁর বক্তব্য—"আমরা হাল ছাড়িনি; আমরা এখনও মানুষ হিসাবে দাঁড়িয়ে আছি"—এখানে আত্মসমর্পণের পরিবর্তে এক ধরনের স্থিতিশীলতা ও মানবিক মর্যাদার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। এই বক্তব্য শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার পরিবারগুলোর জন্য ক্যাথারসিস নয়, বরং বৃহত্তর সামাজিক স্তরেও প্রতিধ্বনি তোলে। ব্যক্তি ও পরিবারের দুর্ভোগের ভেতর দিয়ে তিনি জাতির সামনে স্থিতিশীলতা ও আশার বার্তা পৌঁছে দেন, যা রাজনৈতিক সংস্কৃতির মানবিকীকরণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। সাক্ষাৎকারটি শেষ হয় এক ধরনের আশাবাদী প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে—"জনগণের শক্তিই চূড়ান্ত শক্তি। আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশ আবার জেগে উঠবে।" এখানে তারেক রহমান শুধু রাজনৈতিক নেতা হিসেবে নয়, বরং জাতীয় আশার প্রতীক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন। এই বক্তব্যে তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাস, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের প্রতিফলন স্পষ্ট, যা জাতীয় চেতনায় নতুন উদ্দীপনা যোগায়। বিবিসি বাংলার মূল্যায়নে, এই সাক্ষাৎকার "শুধু রাজনৈতিক বিবৃতি নয়, বরং একটি মানবতাবাদী দলিল।" তারেক রহমানের যুক্তি, ধৈর্য ও দেশপ্রেম—এসব মিলিয়ে তাঁর সংযত ও শান্ত আচরণ বাংলাদেশের বিদ্বেষপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশে একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ স্থাপন করে। তাঁর সমাপনী ঘোষণা, "আমি ফিরে আসব, গণতন্ত্র ফিরে আসবে"—এটি একাধারে রাজনৈতিক ইশতেহার, আবার জাতীয় আকাঙ্ক্ষার কাব্যিক ভাষ্যও বটে। এখানে তিনি পরিবর্তনশীল বাংলাদেশের স্বপ্ন ও প্রত্যাশাকে ধারণ করেন। সুতরাং, এই সাক্ষাৎকারের তাৎপর্য কেবল তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াতেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি জাতীয় স্মৃতি ও রাজনৈতিক কল্পনাকে নতুন করে নির্মাণের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। তারেক রহমানের বিনয়, নৈতিক স্পষ্টতা, ও দূরদর্শী আশাবাদ—এসবের সম্মিলিত উপস্থিতি তাঁর সাক্ষ্যকে দায়িত্বশীল নেতৃত্বের একটি মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, বিশেষত যখন জাতি অনিশ্চয়তা ও মেরূকরণের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। তাঁর নেতৃত্বের এই বৈশিষ্ট্য, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চর্চার ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম।
৬.
তারেক রহমানের বিবিসি বাংলা সাক্ষাৎকারটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে উপস্থিত হয়েছে—এটা নিছক একটি মিডিয়া ইভেন্ট নয়, বরং দেশের রাজনৈতিক আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করা এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। তারেক রহমানের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভবিষ্যৎ-কেন্দ্রিক রাজনৈতিক দর্শন—এগুলো সাক্ষাৎকারে এমনভাবে সংমিশ্রিত হয়েছে, যা বাংলাদেশের জাতীয় কল্পনা ও রাজনৈতিক চর্চার কাঠামোকে নতুনভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। বিশেষভাবে লক্ষণীয় নির্বাসনের অভিজ্ঞতাকে তিনি কেবল ব্যক্তিগত দুর্দশা হিসেবে উপস্থাপন করেননি; বরং সেটিকে রাজনৈতিক সচেতনতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও নেতৃত্বের বিকাশের অনন্য এক পর্যায় হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তার বক্তব্যে বারবার উঠে এসেছে—যোগ্যতাভিত্তিক নেতৃত্ব এবং কার্যকর জবাবদিহিতার কথা, যা বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে এক ধরনের তীব্র বৈপরীত্য সৃষ্টি করে। তিনি ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ও নৈতিক পুনর্জাগরণের প্রতি যে অবিচল প্রতিশ্রুতির কথা বলেছেন, তা বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশে হতাশা, অনাস্থা কিংবা গোঁড়ামি—এসবের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী বক্তব্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এই সাক্ষাৎকারটি শুধুমাত্র একমুখী প্রচার নয়; বরং এখানে একটি সংলাপমূলক স্পেস তৈরি হয়েছে, যেখানে অতীতের বিভাজন ও ক্ষয়-ক্ষতি স্বীকার করা হয়েছে, বর্তমানের দায়িত্ব গ্রহণ করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দলীয় বিদ্বেষ ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার প্রেক্ষাপটে, তারেক রহমানের কণ্ঠস্বর—যেখানে ব্যক্তিগত কষ্ট, তীক্ষ্ণ বিশ্বাস ও আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি মিশে গেছে—তা এক ধরনের নৈতিক স্পষ্টতা ও নাগরিক কল্পনার জন্য নূতন দিশা দেয়।
এখানে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—সাক্ষাৎকারে কখনও তিনি অতীতের ব্যর্থতাগুলোকে এড়িয়ে যাননি; বরং সেগুলো স্বীকার করে ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তনের ডাক দিয়েছেন। এ ধরনের আত্মসমালোচনার প্রবণতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বে খুব কমই দেখা যায়। এতে বোঝা যায়, তিনি কেবল প্রচলিত রাজনীতির গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং বৃহত্তর গণতান্ত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধকে সামনে রেখে নতুন এক রাজনৈতিক ভাষ্য নির্মাণের চেষ্টা করছেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা ও স্বৈরাচারী প্রবণতার দ্বন্দ্বে এক সংকটময় ক্রসরোডে দাঁড়িয়ে আছে। এ অবস্থায় তারেক রহমানের এই সাক্ষাৎকার দেশের গভীর উদ্বেগ, প্রত্যাশা ও স্বপ্নগুলোর প্রতিফলন ঘটিয়েছে। একই সঙ্গে, এটি একটি মশালের মতো সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথও দেখিয়েছে—যেখানে রাজনৈতিক পুনর্জাগরণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক নেতৃত্ব এবং মানবিক মূল্যবোধই হবে ভবিষ্যৎ রাজনীতির চালিকা শক্তি। শেষ পর্যন্ত, যদি বাংলাদেশের রাজনীতিতে সত্যিকারের রেনেসাঁ আসে, ইতিহাস সম্ভবত এই সাক্ষাৎকারকে স্মরণ করবে—এখান থেকেই শুরু হয়েছিল নতুন দিনের সম্ভাবনা, এবং এই কণ্ঠস্বরই ছিল সেই পরিবর্তনের অন্যতম সূচনা বিন্দু। বলাবাহুল্য, বিবিসি’র সঙ্গে তারেক রহমানের সাক্ষাৎকারে এবং তার উপস্থাপিত বক্তব্যে তিনি যে ‘‘লিজেন্ডারি লিডার’’ তা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়।
লেখক : সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়