ছাত্ররাজনীতির সংস্কার কেন প্রয়োজন
- মাহবুব আলম শাহিন
- প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ১১:০৭ PM
উপমহাদেশে যখন ছাত্ররাজনীতির গোড়াপত্তন হয়, তখন যেভাবে সাংগঠনিক কাঠামো ও কর্মপরিচালনা করা হয়েছে; সময়ের সাথে সাথে কালের পরিক্রমায় তা পরিবর্ধিত এবং পরিমার্জিত হয়েছে। সময়ের পরিক্রমায় প্রয়োজনীয়তা হারিয়েছে, আবার অনেক নতুন সংগঠনও আত্মপ্রকাশ ঘটেছে ভিন্নরূপে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে নানা সংকটের মুহূর্তে জনমুখী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার ইতিহাস রয়েছে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল অনন্য। রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতিগত শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি রাজপথেও এই সংগঠনটি জন্মলগ্ন থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ঘোষণায় বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া এবং উনার স্বহস্তে গড়া ছাত্রসংগঠন হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন দীর্ঘ এক দশকে অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্যই সমগ্র বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ছাত্রদের অধিকার আদায়ের পাশাপাশি রাষ্ট্রের যেকোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ ভূমিকা রেখেছিল।
৯০-এর ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের ভেতরে দীর্ঘ এক দশকে গড়ে ওঠা দৃঢ় ইস্পাতকঠিন ঐক্য এবং সময়োপযোগী ছাত্রবান্ধব কর্মসূচির পাশাপাশি সংগঠনের ভাবমূর্তিসহ সাংগঠনিক কাঠামোয় পরিপক্বতা থাকায় ছাত্রদল ডাকসুতে জয়লাভ করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রসমাজের সাথে মিলিত হয়ে আন্দোলনের মূল লিড রোল প্লে করতে সক্ষম হয়েছিল।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—আমাদের জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে এবং পরবর্তী সময়েও ছাত্রসংগঠনগুলো কখনো অহিংস পদ্ধতিগত আন্দোলন-প্রতিবাদ, আবার কখনো সশস্ত্র বিপ্লবী ভূমিকায় আবির্ভূত হয়ে জাতীয় রাজনীতিকে কখনো মত ও পথ দেখিয়েছে, আবার কখনো নিজেরাই নেতৃত্ব দিয়ে নায়কোচিত বীরের সম্মানে অধিষ্ঠিত হয়েছে।
ছাত্ররাজনীতি কেন প্রয়োজন?
ছাত্ররাজনীতি দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতা তৈরির কারখানা। ছাত্ররাজনীতির ইতিহাস এক গৌরবময় ইতিহাস। দেশের সকল ঐতিহাসিক অর্জন ছাত্রদের এনে দেওয়া। দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজন রয়েছে। সুষ্ঠু, গুণগত মানসম্পন্ন ছাত্ররাজনীতিই পারে দেশের রাজনৈতিক কালচার পরিবর্তন করতে। ছাত্ররাজনীতি চর্চা করতে না পারলে দেশের রাজনীতির মান হবে আরও খারাপ।
ছাত্ররাজনীতির অবর্তমানে কেন অপরাজনীতির চর্চা বৃদ্ধি পাবে?
ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করলে দেশের মেরুদণ্ডে আঘাত আসবে। ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা হলে দেশ মুখপাত্র হারাবে। দেশের জনগণের তথা ছাত্রসমাজের যেকোনো ন্যায্য অধিকার আদায়ের প্রশ্নে কিভাবে ছাত্রসমাজ দলমত নির্বিশেষে একত্রিত হয়ে লড়াই করেছে, তা নিকট ভবিষ্যৎ এবং পূর্বেই এ জাতি দেখেছে। বারবার মুক্ত করেছে এই দেশকে স্বৈরাচারের কবল এবং অপরাজনীতির হাত থেকে। ছাত্ররাজনীতির অবর্তমানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সে শক্তি আর থাকবে না সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে। যেমনটা দেখা গিয়েছিল ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে— হলে হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ চাওয়া গোষ্ঠীই পরবর্তীতে একটা নির্দিষ্ট ছাত্রসংগঠনের হয়ে পারপাস সার্ভ করেছে।
এই স্বার্থবাদী গোষ্ঠীই ডাকসুতে সহজেই তাদের এজেন্ডা ডাকসু-২০২৫ তথাকথিত নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। অপরদিকে বিগত দেড় দশকে ছাত্রদল ক্যাম্পাস ও হল এলাকায় অবস্থান করতে না পারায় এবং অভ্যুত্থান-পরবর্তী তীব্র মিডিয়া ট্রায়াল ও মব জাস্টিসের সম্মুখীন হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল।
ছাত্ররাজনীতির সংস্কার কেন প্রয়োজন
যেসব ছাত্রসংগঠন শিক্ষার্থী-বান্ধব রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাজনৈতিক পদ-পদবি নিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত, বা বুর্জোয়া রাজনীতিতে মত্ত—সেই গতানুগতিক রাজনীতি দিয়ে কতটুকু আশ্বস্ত হবে বর্তমান প্রজন্ম? অন্যথায় আগামীর ছাত্ররাজনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে! ছাত্ররাজনীতির আঁতুড় ঘর খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ছাত্ররাজনীতির পরিস্থিতি যেকোনো বিবেচনায় অসংকোচ! তাই ছাত্ররাজনীতির যৌক্তিক, সময়োপযোগী এবং গুণগত সংস্কার এখনই সময়ের দাবি।
উইনস্টন চার্চিল উক্তি এ ব্যাপারে সময়োপযোগী—“একজন ভালো রাজনীতিবিদ তাকেই বলা হয়, যিনি আগামীকাল কী ঘটবে তা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন এবং পরে ব্যাখ্যা করতে পারেন কেন তা ঘটেনি।”
ছাত্রদলের সাবেক শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এবং রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করে ছাত্রদলকে দিকনির্দেশনা প্রদান, অথবা ছাত্রদল নিজেই সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মতো ক্ষমতা, এমনকি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় থেকে তা নিশ্চিত করতে হবে। ছাত্রদলের নিজস্ব সক্রিয়তা বজায় রেখেই তাদেরকে গুণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে ছাত্রসমাজের মাঝে মেলে ধরতে হবে।
তাই এই সময়েই নিজেদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি মানুষের জীবন সম্পর্কিত সকল বিষয়ে পড়াশোনা করা একান্ত জরুরি। এই জন্য প্রয়োজন নিয়মিত ছাত্রদলের পাঠচক্র আয়োজন করা। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান (বীরউত্তম) বলেছেন—“প্রশিক্ষিত কর্মীই রাজনৈতিক দলের প্রাণ।” এই জন্য ছাত্রদলের নিয়মিত প্রশিক্ষণ বিষয়ক কর্মশালা আয়োজন করা উচিত।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের পালস বুঝে কর্মপরিধি ঠিক করা এবং গবেষণা সেল গঠন করে সময়োপযোগী তাদের কর্মকাণ্ড কী হওয়া উচিত, সেগুলো পরিবর্ধিত এবং পরিমার্জন করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে আব্রাহাম লিংকনের মতভেদ সময়োপযোগী এবং যথোপযুক্ত—“জনগণ রাজনীতিবিদদের জন্য নয়, রাজনীতিবিদরা জনগণের জন্য।”
লেখক: সাবেক সভাপতি, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হল শাখা ছাত্রদল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়