খালেদ মুহিউদ্দীনের জন্মদিনে স্মৃতির ঝাঁপি থেকে কিছু অজানা কথা
- রাজীব হাসান
- প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:১৪ PM , আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:১৫ PM
খ্যাতিমান সাংবাদিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব খালেদ মুহিউদ্দীনকে আপনারা অনেকেই চেনেন। তবে আমি চিনেছিলাম অন্যভাবে। অনেকের কাছে তিনি রহস্যময় চরিত্র। এক্ষুনি আওয়ামী লীগকে ধুয়ে দিচ্ছেন, তো পরের কথাতেই এমনভাবে অন্য বক্তাকে চেপে ধরছেন, মনে হচ্ছে লোকটা তো আওয়ামী লীগের!
খালেদ মুহিউদ্দীনের ম্যাজিকটা আসলে কী?
খালেদ ভাই তখন ‘ঢাকায় থাকি’ নামে প্রথম আলোর সিটি পেজের এডিটর। বন্ধু দেবব্রত মুখোপাধ্যায় চার পাতার সাপ্লিমেন্টে দু হাতে লেখেন। খালেদ ভাই তখনই রীতিমতো তারকা, অহংকারী এবং স্মার্ট। ক্যাবলাকান্ত আমি ভয়ে সেদিকে ঘেঁষি না।
তবু কীভাবে যেন ঢাকায় থাকি-তে আমার কয়েকটা লেখা ছাপা হয়ে গেল। এর মধ্যে তিনটা লেখার কথা স্পষ্ট মনে আছে। দুটির শিরোনামও বলতে পারব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর গেস্টরুম কালচারের বিষয়ে জাতীয় পত্রিকায় আমি প্রথম লিখেছিলাম। মন্তব্যধর্মী সেই লেখার শিরোনাম ছিল: ‘এই দাসপ্রথা’র অবসান কি হবে না?
ছাত্রদের মিছিলে যেতে বাধ্য করা, টিভি রুমে ইচ্ছামত রিমোট ঘুরানো, হলের নেতাদের মাংসের পিস বাড়তি জোগান দিতে গিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের টুকরোর সাইজ ছোট হয়ে আসাকে কোট-আনকোটে হলেও ‘দাসপ্রথা’ লিখেছিলাম।
গুলিস্তানের ফুটপাতের কাপড়ের দোকানে একটা শার্ট দরদাম করতে গিয়ে ফাঁদে পড়েছিলাম। শার্টটা খুব মনে ধরেনি, দামেও বনিবনা হচ্ছিল না। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল করলাম আশপাশের সব দোকানি একজোট হয়ে আমাকে ছেঁকে ধরেছে। আমাকে শার্টটা কিনতেই হবে, আর দরদামের সুযোগ নেই। কারণ দোকানে ল্যামিনেটেড নোটিস ঝুলছে: একদাম ২৫০।
২৫০ আমার কাছে তখন অনেক টাকা—অন্তত তিন দিন দুবেলা খাওয়ার খরচ। কিন্তু বাধ্য হয়ে কমলা রঙের সেই শার্টটা কিনে ফিরি, ২৫০ টাকাতেই। অথচ দোকানি কিছুক্ষণ আগেই ২০০ টাকা দিতে রাজি হয়ে ছিল।
টাকা উসুল করার একমাত্র উপায় ছিল লেখা। একটা বড় ফিচার লিখলে তখন ৩০০ টাকা পাওয়া যেত। ঢাকায় থাকি-তে যে লেখাটা লিখি, তার শিরোনাম খালেদ ভাইয়েরই দেওয়া: ‘সাবধান, ছোঁবেন না!’
হলে তখন ছারপোকার মারাত্মক উৎপাত। জীবন দুর্বিসহ। একে তো ডাবলিং করে সিঙ্গেল খাটে ঘুমাতে হয়, তার ওপর ছারপোকার কামড়। এটা নিয়ে স্যাটায়ারধর্মী একটা লেখা লিখেছিলাম, ছারপোকার সঙ্গে যুদ্ধ করতে কার কী-কেমন প্রস্তুতি ও আয়োজন; এ নিয়েই লেখা। ব্যাঙ্গাত্মক সুরে লিখতে চেয়েছিলাম, ‘এই ছারপোকা তবু ছোট, চোখে দেখা যায় না।’
লেখাটা পড়ে আমি পড়লাম বিপদে। কোনো কারণে খালেদ ভাইয়ের এই লেখা সবচেয়ে পছন্দ হলো। এতদিন ধরে হলে ছারপোকা আছে, কিন্তু বিষয়টা নিয়ে কেউ লেখেনি, জিনিসটা তার কাছে ইমপ্রেসিভ লাগল।
অনেকবারই ঘটেছে—অফিসে কোথাও যাচ্ছি, খালেদ ভাই কারও সাথে গল্প করছেন, হুট করে আমাকে ডাকলেন। উচ্ছ্বসিত হয়ে কলিগকে বললেন, ‘সেদিন আপনাকে বলছিলাম না স্টোরিটির কথা। এই যে, এই সেই ছারপোকার রাজীব।’
লাইফস্টাইল পাতায় ‘মোজার গন্ধ কীভাবে দূর করবেন’ লিখে তখনকার এক প্রদায়ক (এখন প্রভাবশালী সিনিয়র কূটনৈতিক-প্রতিবেদক, নাম প্রকাশ করিনি) নামের আগে ‘মোজা’ পদবি জুড়ে দিয়েছিল। আমার ভয় হচ্ছিল, ছারপোকা নামটা না স্থায়ীভাবে আমার সঙ্গে জুড়ে যায়!
জীবনে কারও কাছ থেকে কিছু শিখলে তাকে শিক্ষক মানি। কোনো ঘটনাকে ভিন্ন পারস্পেকটিভ থেকে দেখার এই শিক্ষা খালেদ ভাইয়ের কাছেই পেয়েছি। খালেদ ভাই পরবর্তী জীবনে ভিন্ন পারস্পেকটিভে ঘটনাকে দেখতে পারাকেই তার তীরের তূণ বানিয়ে সুখ্যাত হয়েছেন।
আমার শিক্ষক খালেদ ভাইয়ের আজ জন্মদিন। মাঝে মাঝে সাংবাদিকতায় ফিরে আসার ইচ্ছা কিংবা পাগলামি মাথা বাড়িয়ে ওঠে—এ কেবল তারই জন্য। রক্তচোষা ছারপোকাদের কথা দিয়ে থেঁতলে দেওয়ার আপনার এই যাত্রা চলতে থাকুক, খালেদ ভাই।
রাজীব হাসান: কথাসাহিত্যিক ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক