ইনোভেশন হাব: বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টেকসই উন্নয়নের পথে

শরিফুল ইসলাম সেলিম 
শরিফুল ইসলাম সেলিম   © টিডিসি সম্পাদিত

তারুণ্যের উদ্ভাবনী সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে একটি স্বনির্ভর উন্নয়নশীল বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে সরকারের এটুআই ও ইউজিসির মধ্যকার সম্পাদিত চুক্তির আওতায় কমিশন দেশের সকল সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনোভেশন হাব (iHub) প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এ কর্মসূচির অধীনে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ইনোভেশন হাব হবে এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, গবেষকগণ একত্রিত হয়ে নতুন নতুন ধারণা, প্রযুক্তি বা গবেষণার ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে সহায়তা করবে। এছাড়াও ইনোভেশন হাবগুলোতে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ যেমন নতুন স্টার্ট-আপ, প্রযুক্তির উন্নয়ন, বা নতুন গবেষণার পথ তৈরির মাধ্যমে সমস্যা সমাধান ও তাদের উদ্ভাবনী ধারণাগুলিকে বাস্তবে রূপ দিতে সহায়তা করবে। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এর এক জরিপ অনুযায়ী বর্তমানে দেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী নবীন ও তরুণের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১৮.৬৭ শতাংশ এবং ২৫ থেকে ৩৯ বছর বয়সীর সংখ্যা ২২.২৮ শতাংশ। অর্থাৎ আমাদের দেশে নবীন, তরুণ ও যুবকের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৪০.৯৫ শতাংশ। দেশের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে এই বিপুলসংখ্যক নবীন, তরুণ ও যুবশক্তির ওপরে। আমাদের দেশে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে নেতৃত্বদানের অন্যতম চাবিকাঠি হতে পারে তরুণ প্রজন্মের জীবনবোধ, জীবনীশক্তি এবং প্রত্যাশা। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশের কাছাকাছি জনগোষ্ঠীর বয়স যেহেতু ২৫ বছরের নিচে, সেহেতু দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে যে কোনো পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্ম ও ছাত্রসমাজের প্রত্যাশা, জীবনবোধ এবং জীবনীশক্তিকে যথাযথ মূল্যায়ন করা আমাদের জাতীয় কর্তব্য।

বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের স্বার্থে বাংলাদেশকে বিশ্ববাজারের চাহিদা অনুযায়ী জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির অন্যতম হাতিয়ার হলো প্রযুক্তি। প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি হিসেবে তরুণদের নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। 

চলমান শিল্প বিপ্লব ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্তরোত্তর অগ্রগতি বহুসংখ্যক মানুষকে কর্মহীন করবে মর্মে বিভিন্ন গবেষণায়  প্রকাশিত হচ্ছে এবং তার বহিঃপ্রকাশ ইতোমধ্যে দৃশ্যমান।  প্রবহমান এ ধারার সাথে আমরা যদি তাল মিলাতে ব্যর্থ হই অর্থাৎ শ্রমনির্ভর অর্থনীতি হতে জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতির দিকে যথাসময়ে ধাবিত হতে না পারি তাহলে আমাদের দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মহীন হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা ইতোমধ্যে চালকবিহীন গাড়ি, ইন্টারনেট অব থিংস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিংসহ প্রযুক্তির নতুন নতুন আবিষ্কার বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বে একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে জ্ঞান ও দক্ষতা ভিত্তিক প্রাগ্রসর প্রযুক্তিগত শিক্ষা ও গবেষণা অনস্বীকার্য। প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকা সত্ত্বেও জ্ঞান ও দক্ষতা ভিত্তিক প্রাগ্রসর প্রযুক্তিগত শিক্ষা ও গবেষণাকে পুঁজি করে বিশ্বের অনেক দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করেছে। আমাদের দেশে প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে-বিদেশের কর্মবাজারে প্রবেশ করছে। আমাদের দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ বৈশ্বিক কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত থাকলেও তারা মূলত শ্রমনির্ভর বিভিন্ন কাজের সাথে সম্পৃক্ত।

চলমান শিল্প বিপ্লব ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্তরোত্তর অগ্রগতি এসব পেশার মানুষকে কর্মহীন করবে মর্মে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। সে বিবেচনায় শ্রমনির্ভর এসব জনগোষ্ঠীকে হয়তো দ্রুতই প্রযুক্তিনির্ভর পেশায় রুপান্তর সম্ভব না হলেও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রাগ্রসর জ্ঞান ও দক্ষতানির্ভর জনবল হিসেবে গড়ে তুলতে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ কাজ করে যাচ্ছে। মূলত চলমান শিল্প বিপ্লব ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্তরোত্তর অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে দেশের বিদ্যমান অর্থনীতিকে জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তরের জন্য মৌলিক গবেষণাসহ প্রাগ্রসর প্রযুক্তি যেমন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক্স ও অটোমেশন, বায়োটেকনোলজি, ইন্টারনেট অব থিংস, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, সাইবার সিকিউরিটি, শক্তি সঞ্চয় কিংবা কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, বিগ ডাটা, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইন্টারনেট অব থিংস, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স, পঞ্চম প্রজন্মের ওয়্যারলেস প্রযুক্তি, ন্যানো টেকনোলজি, থ্রিডি প্রিন্টিং, ব্লকচেইন, স্বয়ংক্রিয় যানবাহন ইত্যাদির উপরে গবেষণাসহ নূতন নূতন উদ্ভাবনী কার্যক্রম ব্যাপকভাবে গ্রহণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন কাজ করছে। এরই অংশ হিসেবে কমিশন Improving Computer and Software Engineering Tertiary Education Project (ICSETEP) এবং Higher Education Acceleration and Transformation (HEAT) প্রকল্পে উদ্ভাবনী কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইকোসিস্টেম তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়াও, ইনোভেশন হাব (iHub) কর্মসূচির আওতায় আগামী এক বছরে সেরা দশটি উদ্ভাবন পরীক্ষামূলকভাবে বাস্তবায়নের জন্য প্রতিটিতে সর্বোচ্চ পাঁচ লক্ষ করে মোট পঞ্চাশ লক্ষ টাকা উদ্ভাবনী ফান্ড প্রদান করা হবে। 

বাংলাদেশের বিপুল তরুণ জনগোষ্ঠীই আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ। এই সম্পদকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হলে তাদের জ্ঞান, দক্ষতা ও উদ্ভাবনী শক্তিকে বিকশিত করা অপরিহার্য। প্রযুক্তি ও গবেষণাভিত্তিক জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে হতে হবে উদ্ভাবনের কেন্দ্রবিন্দু। সরকারের এটুআই ও ইউজিসির সম্মিলিত উদ্যোগে গড়ে ওঠা ইনোভেশন হাবগুলো তরুণদের নতুন ধারণা ও প্রযুক্তি বাস্তবায়নের এক অনন্য সুযোগ সৃষ্টি করবে। এ কর্মসূচি শুধু স্টার্ট-আপ ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে অবদান রাখবে না, বরং দেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সঠিক দিকনির্দেশনা, উপযুক্ত নীতি সহায়তা এবং প্রয়োজনীয় তহবিলের সমন্বয়ে তরুণ প্রজন্ম একদিন বাংলাদেশকে শ্রমনির্ভর অর্থনীতি থেকে জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতির দিকে নিয়ে যাবে এবং একটি স্বনির্ভর, উন্নয়নশীল ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ বিনির্মাণ করবে।

লেখক: সিনিয়র সহকারী পরিচালক, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)


সর্বশেষ সংবাদ

X
APPLY
NOW!