একজন কয়েদির আর্তনাদ!
- ফারুক হাসান
- প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০১৯, ০২:৫৪ PM , আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৯, ০২:৫৪ PM
‘রাখিব নিরাপদ দেখাবো আলোর পথ’ এটি হচ্ছে বাংলাদেশ জেলের স্লোগান। দেশের প্রতিটি কারাগারের প্রধান ফটকে এই মহান স্লোগান টি লেখা রয়েছে। আমি বলি, এই স্লোগানের পরিবর্তে এটা দিলে বোধহয় সঠিক এবং যুক্তিযুক্ত হতো ‘রাখিব অনিরাপদ, দেখাবো অন্ধকারের পথ’। আপনারা যারা কারাগারে গিয়েছেন অপরাধ করে হোক বা না করেই হোক, তারা কারাগারের অবস্থাটা বুঝেন।
ইতোমধ্যে আমরা পেপার-পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পেরেছি, দেশের কারাগারগুলোতে বন্দী ধারণ ক্ষমতার ১০ গুণেরও বেশি। আমার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রায় ২ মাস থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেখানে দেখেছি কারাগারের ভিতরে অপরাধের রণাঙ্গন এবং মাদকের স্বর্গরাজ্য।
এবার আসি কারাগারের ভিতরে কি চলে: ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকার সুবাদে সেখানে দেখেছি, বন্দী ধারণ ক্ষমতার ১০-১২ গুণ বেশি বন্দী রয়েছে। তাদের সবাই কিন্তু অপরাধী নন। অপরাধীর থেকে নিরপরাধ মানুষের সংখ্যাটাই বেশি। আমি থাকতাম কর্ণফুলি বিল্ডিং এর তৃতীয় তলায়। আমরা যে ওয়ার্ডে থাকতাম সেটা মোটামুটি কিছুটা ভাল ছিল, পরিবেশের দিক দিয়ে।
আমরা একটা রুমে গাদাগাদি করে থাকতাম ৪৫-৫০ জন। রাতে সারি সারি হয়ে সবাই ঘুমাতাম আর সকালে নিজেকে আবিস্কার করতাম অদ্ভুত এক অবস্থায়। একজনের পা আরেক জনের মাথার উপর, কারো মাথা আরেক জনের ঘাড়ে, কার শরীর আরেকজনের শরীরের উপরে।
ছোট একটি রুমে সারারাত ৪৪-৫০ জন রূদ্ধশ্বাস অবস্থায় থাকতে হতো আমাদের। ৫০ জনের জন্য টয়লেট ছিল মাত্র একটি, অথচ এতো বড় বিল্ডিং অনেক বড় করিডোর রয়েছে, রয়েছে লম্বা বারান্দা। বন্দীরা একটু শান্তিতে থাকতে চাইলেও তা দেওয়া হয় না।
এবার আসি কারারক্ষীদের কথায়: কারাগারগুলোর ভিতরে যারা রয়েছে তাদের অধিকাংশই দুর্নীতির সাথে জড়িত। সেটা জেলার থেকে শুরু করে একজন সাধারণ কারারক্ষী পর্যন্ত। কিছুদিন আগে আমরা দেখেছি, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান রক্ষক মাদক এবং নগদ টাকাসহ পুলিশের হাতে আটক, এটিই হচ্ছে কারাগারগুলোর আসল চিত্রের একটি বাস্তব দৃষ্টান্ত।
মাদকের অবস্থায় এবার আসি: কারাগারগুলোকে বলা হয় অপরাধ সংশোধনাগার। এখানে অপরাধীদের অপরাধ সংশোধন করার জন্য নানান কর্মসূচি নেওয়ার কথা কিন্তু বাস্তব চিত্র ঠিক তার উল্টো। কথায় আছে টাকা থাকলে বাঘের দুধ পাওয়া যায়। এটি যেন কারাগারগুলোর জন্য অমিয় সত্য একটি বাণী। বাইরে মাদক যতটা না দুষ্প্রাপ্য, কারাগারের ভিতরে ঠিক ততোটা সহজলভ্য। টাকা থাকলেই আপনি হাতের নাগালে পাবেন, যেকোন ধরনের মাদক। মাদকের রমরমা ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে কারাগার গুলো।
এবার আসি খাবারের তালিকায়: আমি যতটুকু জেনেছি, একজন কয়েদির প্রতিদিন বরাদ্দ ৮৫-৯০ টাকা (সঠিক নাও হতে পারে)। তবে একজন মানুষের জন্য ৮০-৯০ টাকা যথেষ্ঠ নয়। কারণ আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মৌলিক চাহিদা অনুযায়ী একজন ব্যক্তিকে অবশ্যই প্রতিদিন ১৮০০-২২০০ কিলোক্যালরী খাবার দিতে হবে।
সেখানে আমার মনে হয় না ৩০-৩৫ টাকার বেশি একজন কয়েদির পিছনে ব্যয় করা হয়। সকালে দেয় জিন্সের কাপড়ের মতো দেখতে এবং লোহার মতো শক্ত একটি রুটি আর এক চিমটি গুড়। দুপুরে এক প্লেট ভাত আর এক বাটি ডাল, রাতের মেন্যুতে থাকে একটি অর্ধসিদ্ধ সবজি আর এক টুকরো মাংস অথবা মাছ, তাও প্রতিদিন নয় মাঝেমধ্যে।
আমি প্রতিদিন বিভিন্ন ভবনে যেতাম প্রকৃত অবস্থাটা জানার জন্য। কারাগারগুলোতে দেখেছি কতশত নিরপরাধ মানুষকে বছরের পর বছর মিথ্যা মামলায় পচতে। তাদের অনেকেরই আপনজনের কথা মনে নেই, অনেকের বাড়ি ঘরের কথাও মনে নেই। তাদের বাড়িঘর যেন এই কেন্দ্রীয় কারাগার, এখানকার কয়েদিরায় আপনজন তাদের।
একজন কয়েদির সাথে কথা হলো, নাম তার হান্নান (ছদ্মনাম)। একটি মিথ্যা মামলায় ২২ বছর ধরে জেলে রয়েছেন। মনের দুঃখে তিনি তার জীবনের কাহিনীটা আমাদের শোনালেন, আমরা শুনতে থাকলাম আর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকল।
একরাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল, কি যেন একটা আওয়াজ আমার কানে বারবার ভেসে আসছিল। আমি কিছুক্ষণ আওয়াজটা শোনার পর আবিষ্কার করলাম, এটি মানুষের কান্নার আওয়াজ। আমি ঘুম থেকে ওঠে দরজার কাছে গিয়ে কান লাগিয়ে শুনতে থাকলাম, এক ব্যক্তি তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে মুনাজাত করতেছে আর কাঁদতেছে।
এই হচ্ছে আমাদের কারাগারগুলোর হালচাল। দুনিয়ার আদালতে অনেককিছু ওলটপালট হয়, কিন্তু উপর তলার আদালতে ওলট-পালট হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। তাইতো নিরপরাধ মানুষজন তাদের সকল অভিযোগের ফাইলগুলো উপর তলার আদালতে পাঠিয়ে দেয়, সঠিক বিচারের জন্য।
‘রাখিব নিরাপদ, দেখাবো আলোর পথ’ এই স্লোগানটি যাতে বাস্তবে কার্যকর হয় দেশের প্রতিটি কারাগারে। অপরাধখানা নয়, অপরাধ সংশোধনাগার হিসাবে কারাগার গুলোকে প্রতিষ্ঠা করুন......!
লেখক: যুগ্ম-আহবায়ক,
বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ।