কোটা সংস্কার আন্দোলন: ইতিহাসে ৮ এপ্রিল
- মুহাম্মদ রাশেদ খাঁন
- প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০১৯, ১২:০৪ PM , আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৯, ১২:২৫ PM
৮ এপ্রিল। এক ঐতিহাসিক দিন। যখন আমাদের মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা সরকার ও কর্তৃপক্ষের সাড়া পাচ্ছিলাম না, তখন আমরা রাস্তাঘাট অবরোধের সিদ্ধান্ত নিই। ২০১৮ সালের এইদিনে দেশের রাজপথগুলোতে ছাত্র জনতার ঢল নামে। যে যেখানে ছিল, প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সেদিন আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। কেন্দ্রীয় কমিটির মিছিলের পরিসর ছিল শাহবাগ হতে কাঁটাবন পর্যন্ত / এর থেকেও বেশি দূর বিস্তৃত।
আমরা যে রাস্তা অবরোধ করবো, এটি পুলিশ প্রশাসন বুঝতে পারেনা। সেদিন আমাদের কর্মসূচির নাম ছিল, ‘গণপদযাত্রা’। কিন্তু আমরা পরিকল্পনা সেট করে করে রেখেছিলাম, এই দিন রাস্তাঘাট অবরোধ করবো।
আমরা যখন শাহবাগ অবরোধ করি, সাথে সাথে সারাদেশে খবর পৌঁছে দিই। তারাও রাস্তায় অবস্থান নেয়। সারাদেশ একপ্রকার অচল হয়ে পড়ে। আমরা আশা করেছিলাম, কোন একজন মন্ত্রী এসে অন্তত আমাদের সাথে কথা বলে যাবেন ও শান্তনা দেবেন। কিন্তু এরকম কিছুই হয়নি। বরং শিক্ষার্থীদের উপর নির্যাতনের জন্য পুলিশ বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। আর তারা সারারাত ধরে শিক্ষার্থীদের দমন-পীড়ন, নির্যাতন করেছিল। তাদের সাথে যোগ দিয়েছিল সন্ত্রাসীরা।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আমাদের উপর নির্যাতন শুরু হয়। টিয়ারগ্যাস, রাবার বুলেটের মাধ্যমে আমাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়। কেউ অবস্থান নেয় পিজি হাসপাতালে, কেউ বারডেম, কেউ বা চারুকলা/টিএসসিতে। একটা পর্যায়ে আমরা আবার পিজি থেকে মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করি এবং চারিদিক থেকে সকলে জড় হয়ে আবার শাহবাগের দিকে আসতে থাকি। পুলিশ তখনো টিয়ারগ্যাস ও রাবারবুলেট ছুড়তে থাকে।
তখন ছাত্রলীগও আমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ৮ এপ্রিলের আগ পর্যন্ত অবশ্য তারা ততোটা বাধা দেয়নি, বরং ছাত্রলীগের একটা অংশ কোটা আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছিল ও কর্মসূচিতেও সরাসরি যোগদান করতো এবং ‘কোটা সংস্কার চাই’ ফেসবুক গ্রুপে লেখালেখি করতো।
সাড়ে ৮টার দিকে ছাত্রলীগের নেতারা আমাকে রাজু ভাস্কর্যের সামনে মারধর করে। অভিযোগ দেয়- আমি গাড়ি ভাংচুর করেছি। অথচ আমারই সামনে গাড়ি ভাঙে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। যার নির্দেশনা দেয়- ছাত্রলীগের তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক। সেখান থেকে আমার হলের এক বড় ভাই আমাকে রক্ষা করে, তিনি আমাকে হলে চলে যেতে বলেন।
কিন্তু, আমি হলে ফিরি না। ছাত্রদেরকে একত্রিত করতে থাকি। পরবর্তীতে সকল ছাত্র আবার একত্রিত হলে ছাত্রলীগ পিছু হটতে বাধ্য হয়। চলতে থাকে আন্দোলন। সাধারণ ছাত্র জনতার যেন ঢল নামে। রাজপথ প্রকম্পিত হতে শুরু করে।
সকল আবাসিক হল ও মেস থেকে ছাত্ররা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে প্রতিবাদ করতে থাকে। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন লাইট বন্ধ করে দেয়। ক্যাম্পাস অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। একটা পর্যায়ে পুলিশ ক্যাম্পাসের মধ্যে ঢুকে টিয়ারগ্যাস ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ শুরু করে। এতে ছাত্ররা আরো ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। চলতে থাকে ছাত্রদের সাথে পুলিশের ধাওয়া পাল্টাধাওয়া।
এভাবে সাড়ে ১২টা বেজে যায়। আমি তখন চারুকলায় অবস্থান করছি। আমার সাথে ছিল, এপিএম সুহেল। আর চারুকলার গেটের সামনে স্লোগান দিচ্ছিলো বাশার ভাই। আর এদিকে ভাইদের উপর নির্যাতনের খবর পেয়ে মেয়েরা হলের গেট ভেঙে বের হয়ে আসে। তারা বাইরে আসলে তাদের উপরেও হামলা করা হয়। অনেকের মাথা ফেটে যায়।
রাত যখন ১টা বাজে, তখন পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ শুরু করে। কিছুতেই আর ক্যাম্পাসে টেকা যায় না। তখন আমরা যারা চারুকলার গেটে ছিলাম, তারা ভেতরে প্রবেশ করি। সেখানেও টেকা যায় না। পরবর্তীতে আমরা বাঁশ বেয়ে চারুকলার গেট টপকিয়ে বিজনেস ফ্যাকাল্টির পিছনে আসি।
সারাদিন না খাওয়ার কারণে আমিসহ সকল ছাত্ররাই অসুস্থ হয়ে পড়ি। হাটার মত কোন শক্তি আর ছিলনা। তখন একবার ভাবি, হলে ফিরে যাই। কিন্তু, আমার সাথের সকলে হলে যেতে নিষেধ করে। এফবিএসের পিছন থেকে এসে গেটের রাস্তার দিকে তাকাতেই দেখি, আমাদের মাননীয় ভিসি স্যারের বাসায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে।
আর এদিকে সূর্যসেন হলের গেটের দিকে তাঁকিয়ে দেখি লাঠিসোঁটা নিয়ে অনেকে গেটে দাঁড়িয়ে আছে। যে কারণে আমরা ভিসি চত্ত্বরের দিকে আসি। সেখানে উপস্থিত সকলের কাছে ঘটনা জানতে চাই। কেউ সেভাবে কোন উত্তর দিতে পারেনা। সকলেই বলে, ভাই কি হচ্ছে আমরাও জানিনা, আমরা শুধু দেখছি। সুযোগ সন্ধানীরা আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এসব শুরু করেছে।
তখন আমার সাথে যারা ছিল, তারা বলে ভাই আপনি আপাতত ক্যাম্পাস ছেড়ে আশপাশের কোন আত্মীয়ের বাসায় চলে যান। তখন ২০/৩০ জন ছাত্রের সাথে আমি ব্রিটিশ কাউন্সিল হয়ে আজিমপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। এসএম হলের গেটে আসলে দু’জন ব্যতীত সকল ছেলেরা গেট দিয়ে হলে প্রবেশ করে। আমার সাথে তখন দুটি ছেলে থেকে যায়।
সেই দু’জন ছেলের একজন আখতার হোসেন, সমাজসেবা সম্পাদক, ডাকসু এবং আরেকজন আখতারের বন্ধু। আমি তাদের বলি, আমি তো একা হয়ে গেলাম, তোমরা আমার সাথে চলো। তারা দুজন আমাকে আমার আত্মীয়র বাড়ি মিরপুরে পৌঁছে দিতে আসে এবং রাতে আমার সাথে থেকে যায়। পরবর্তীতে সকালে তাদের সাথেই ক্যাম্পাসে গিয়ে আমরা ভিসি স্যারের বাসা ভাংচুর ও অগ্নিকাণ্ড এবং শিক্ষার্থীদের উপর হামলার প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলনে করি।
বলে রাখা ভাল, ভিসি স্যারের বাসা ভাংচুর যে একটি ব্লেম গেইম তা সকলেই জানে। মূলত আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ ও ধ্বংস করতে পরিকল্পিতভাবে এটি করা হয়েছিল। সাধারণ কোন ছাত্র এর সাথে জড়িহ হতে পারেনা, এটি প্রশিক্ষিত বাহিনীর কাজ, যা মাননীয় ভিসি স্যার নিজে বলেছেন।
এ নিয়ে বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে, তারপরেও কিছু না বললেই নয়। আমাদের যুগ্ম আহবায়ক ফারুকের মোবাইলে সাড়ে ১১টার দিকে একটা মেসেজ এসেছিল, যেটি ঢাকা কলেজের এক ছোট ভাই পাঠিয়েছিল। মেসেজে লেখা ছিল যে, ভাই, আপনাদের উপর হামলা করতে ঢাকা কলেজ থেকে সন্ত্রাসীরা হেলমেট পরে, রড, লাঠিসোঁটা, অস্ত্র নিয়ে যাচ্ছে। আপনারা সাবধানে থাকেন।
ঢাকা কলেজের সন্ত্রাসীদের ক্যাম্পাসে প্রবেশ করার ভিডিও ও ছবি অনেকে দেখেছেন। আরেকজনের তো রীতিমতো টিশার্টে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ লেখা। ভিডিও এবং ছবিতে দেখা যায়, তিনি হেলমেট পরে স্যারের বাসায় প্রবেশ করছেন। যা এটিএন নিউজ/বাংলায় প্রকাশিত হয়েছিল। ছবি এখনো আছে, কিন্তু ভিডিওটি তারা সরিয়ে ফেলেছে। আর ফারুকের কাছে আসা মেসেজটির স্ক্রীনশট আমরা উপ-উপাচার্য নাসরিন ম্যামের কাছে দিয়ে আসি।
আর কারা সেদিন আশিকুরের বুকে গুলি মেরেছিল, সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর লাঠিসোঁটা, রড নিয়ে হামলা করেছিলো, তা কে না জানে? কেন আশিকুরের বুক থেকে গুলি বের করা হলো না? সেটি কার পিস্তলের গুলি ছিলো? পুলিশ তো বলেছে, সেদিন তারা কোন গুলি ছোড়েনি। তাহলে গুলি ছুড়লো কে? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল, সেখানে আমাদেরও ডাকা হয়েছিল। আমরা বিস্তারিত বলেছি। সেখানে আরও অনেককে ডাকা হয়েছিল। কেন তদন্ত কমিটি এখনো তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করলো না? থলের বিড়াল বের হয়ে যাবে এজন্য?
আর মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের সভাপতি মেহেদী এমপি সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কি করতেছিলো? ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, চারুকলার সামনে সে পুলিশের সাথে শিক্ষার্থীদের মারধর করছে। সাংবাদিকরা তখন তাকে প্রশ্ন করে- আপনি কে? আপনি কেন শিক্ষার্থীদেরকে মারছেন? সে কি উত্তর দেয়?
‘আমি মেহেদী এমপি, আমি মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের সভাপতি?
ও আচ্ছা, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কমান্ডের সভাপতি হলে বুঝি হামলায় অংশ নেওয়া যায়, শিক্ষার্থীদের পেটানো যায়?
সে সেদিন আরও বলেছিল, আমি আমার দলবল নিয়ে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করেছি এবং সন্ত্রাসী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতিহত করতে এসেছি।
এর অর্থ কি বোঝায়? আমাদের ফাঁসাতে সে তার দলবল নিয়ে ভিসির বাসভবন হামলা করে?
ভিসির বাসভবন পরিকল্পিতভাবে অগ্নিকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। কারণ কোন সাধারণ শিক্ষার্থীর অবশ্যই জানার কথা নয় যে, সিসিটিভি ক্যামেরার হার্ডডিস্ক কোথায় থাকে। কোন সাধারণ শিক্ষার্থীর পক্ষে সুপরিকল্পিতভাবে অগ্নিসংযোগ করে পালিয়ে যাওয়াও সম্ভবপর নয়। এটি একটি দক্ষ ও পেশাদার সন্ত্রাসীদের দিয়েই করানো হয়েছে। যা ভিসি স্যার নিজেই বলেছেন।
তাহলে কেন আমাদের নামে ভিসির বাসভবন ভাংচুর ও অগ্নিকাণ্ডের মামলা দেওয়া হলো? কেন আমাকে ভিসির বাসা ভাংচুরের নির্দেশদাতা হিসেবে ১৫দিন রিমান্ডে রাখা হলো? কেন আমাকে গ্রেপ্তার করার কারণে পুলিশকে পুরস্কার দেওয়া হলো? আমি কি কোন কুখ্যাত সন্ত্রাসী? কেন আমার অসহায় মাকে দুই মাস ধরে রাস্তায় রাস্তায় কাঁদানো হলো? কেন আমাদের স্বপ্ন, পরিবারের স্বপ্ন এই মিথ্যা মামলার মধ্যে বন্দী করে রাখা হয়েছে?
জানি এসব প্রশ্নের কোন উত্তর নেই...
লেখকঃ মুহাম্মদ রাশেদ খাঁন, যুগ্ম আহবায়ক, বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ