পরমাণুতে অসংকরায়িত অরবিটাল ও ধর্মীয় স্বকীয়তা

ড. মো. এরশাদ হালিম
ড. মো. এরশাদ হালিম  © টিডিসি সম্পাদিত

রসায়নের ভাষায় মৌলের পরমাণুগুলোকে বিভাজন করলে পাওয়া যায় ইলেক্ট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন নামক তিনটি মূল কণিকা। প্রোটন ও নিউট্রনগুলো অবস্থান করে কোন পরমাণুর কেন্দ্রে যা নিউক্লিয়াস নামে অভিহিত। অন্যদিকে ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াসের চতুর্দিকে বিভিন্ন শক্তিস্তর বা কক্ষপথগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন শক্তি সম্পন্ন কতকগুলো পারমাণবিক অরবিটালে ঘূর্ণায়মান থাকে। রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটনকালে পরমাণুগুলোর মধ্যে বন্ধন গঠিত হয়। শক্তির তারতম্যজনিত কারণে সমযোজী বন্ধন গঠনকালে অরবিটালগুলোর মধ্যে অধিক্রমণের ফলে গঠিত বন্ধনগুলোর বন্ধন দৈর্ঘ্য, কোণ ও শক্তি সবই আলাদা হয় যা অরবিটালগুলোর শক্তির তারতম্যজনিত স্বকীয়তার প্রমাণ বহন করে।

অন্যদিকে, এই অরবিটালগুলো যখন সংকরায়িত হয়ে সমশক্তি সম্পন্ন কতকগুলো অরবিটালে রূপ নেয়, এবং নিজেদের মধ্যে অথবা তৃতীয় কোন অরবিটালের সাথে অধিক্রমণ ঘটিয়ে সিগমা ও পাই বন্ধন গঠন করে তখন বন্ধনগুলোর দৈর্ঘ্য ও কোণ একই হয়। বন্ধন শক্তিরও কোন তারতম্য সেখানে থাকেনা।  কারণ, অরবিটালগুলো হারিয়ে ফেলে তাদের নিজস্বতা। একইভাবে সমাজবদ্ধ জীবনে ধর্মীয় স্বকীয়তার দেয়ালগুলো ভেঙ্গে দিলে সম্প্রদায়গুলোর মাঝেও নিজস্বতা বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না যেভাবে কোন পরমাণুতে অরবিটালগুলোর সংকরায়ণের ফলে ইলেক্ট্রনগুলোর বিন্যাসের আমূল পরিবর্তন ঘটে। এমনকি ইলেক্ট্রনগুলো যুগ্ম থেকে অযুগ্ম অবস্থায় চলে আসে, তাদের স্পিন পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়ে যায়। ঠিক এভাবেই সাম্প্রদায়িক রীতিনীতির সংকরায়ণের ফলে তৈরি হয় এক জগাখিচুড়ি যা অপ্রত্যাশিতভাবে ডেকে আনতে পারে সাম্প্রদায়িক বিপর্যয় ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা। ঠিক তখনই তোতা পাখির ন্যায় মুখে আওড়ানো "ধর্ম যার যার, উৎসব সবার" বুলির আড়ালে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার ছদ্মাবরণে প্রতিষ্ঠিত হয় ধর্মহীনতা। আর স্রষ্টার মনোনীত দ্বীন বিদ্বেষীরা সেটাই মনেপ্রাণে কামনা করে।

পৃথিবীর যেকোনো অঞ্চলে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জনগণ নিজ নিজ দেশের সম্মানিত নাগরিক। তারা তাদের সকল রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাদি ও নাগরিক অধিকারগুলো রীতিমতো ভোগ করবে। ধর্মীয় অনুশাসনগুলোও যে যার মত করে মেনে চলবে -- এটাই স্বাভাবিক। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে উপাসনা পর্বোত্তর আনন্দ উৎসবগুলোতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষজন একে অন্যকে নিমন্ত্রণ করবে সহজাত সৌজন্যবোধ থেকে। তবে কে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করবে, আর কে করবে না এটা সম্পূর্ণরূপেই কারো ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। নিজের ধর্মীয় অনুশাসনগুলো এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ালে সেটা বিবেচনার দায়িত্ব মেহমানের নিজের উপর বর্তায়। মেযবান অথবা অন্য কারো তরফ থেকে কোন ধরনের জোর-জবরদস্তি আরোপ বা "ধর্ম যার যার, উৎসব সবার" নামক মনগড়া কোন ফতোয়া প্রদানের সুযোগ ইসলামী শরীয়তে আদৌ নেই।

এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, "লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন। অর্থঃ তোমাদের দ্বীন তোমাদের, আর আমার দ্বীন আমার" [সূরাঃ কাফিরূন, আয়াতঃ ৬]। তবে মেহমানের অপারগতা প্রকাশের ভাষা হতে হবে বিনয়ের সাথে মেযবানের প্রতি যথার্থ সম্মান বজায় রেখে যা আমাদেরকে উপহার দিবে ধর্ম নিরপেক্ষতার এক বাস্তব প্রতিবিম্ব। অন্যথায় কেউ যদি মনগড়া কোন ফর্মূলার মাধ্যমে নতুন কোন মতাদর্শ বাস্তবায়নের চেষ্টা করে তবে সেটা হবে বিদ'আত ও জুলুম। উপরন্তু, সংকরায়িত এই তত্ত্ব জন্ম দেবে অসুস্থ এক পরিবেশ যেখানে ভেঙ্গে যাবে সম্প্রদায়গুলোর ধর্মীয় স্বকীয়তার দেয়াল। ফলশ্রুতিতে তৈরি হবে নিত্য নৈমিত্তিক অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা যা ইসলামের মূল চেতনার পরিপন্থী; বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক।

সংবিধান মতে বাংলাদেশে বসবাসরত হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান ও বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসহ সবার জাতীয়তা বাংলাদেশী। সংস্কৃতি বাঙালি কিন্তু ধর্ম আলাদা আলাদা। স্বাধীন দেশে যে যার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে। কেউ কারো ধর্মীয় অধিকার ও অনুভূতিতে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ কিংবা আঘাত করবে না। প্রত্যেকে যে যার মত করে ধর্মীয় স্বকীয়তা ও বিধিনিষেধগুলো মেনে চলবে। বিভিন্ন ধর্মের রীতি রেওয়াজগুলোও বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। পাশাপাশি একটি অনুষ্ঠানে সবাই যদি অতিথি বনে যায় তবে কে হবে মেহমান আর কে-ই বা হবে মেযবান। তাই ধর্ম যার যার, উপাসনা ও উৎসবও তার তার। এখানে থাকবে না কোনো প্রকারের জোর-জবরদস্তি। 

যুগে যুগে সারা বিশ্বেই ফিৎনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী ও সুবিধাবাদী বিভিন্ন গোষ্ঠী রয়েছে যারা স্থান-কাল-পাত্র ভেদে মনগড়া বহু মতবাদ সমাজে প্রচার করে আসছে। অনেক ক্ষেত্রেই এগুলো তাদের অন্তরের কথা নয় বরং লোক দেখানো কিংবা মানুষকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে মুখে আওড়ানো বুলি মাত্র যার নেই কোন শরিয়ত সম্মত ভিত্তি বা অনুমোদন। কখনো রাজনীতির ময়দানে আবার কখনো-বা কোনো সংগঠনের নেতৃত্বে অবস্থান করে সকল সম্প্রদায়ের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের মনোরঞ্জনের নিমিত্ত এগুলো প্রচার করা হয় সম্পূর্ণরূপে নিজেদের স্বার্থান্বেষী চিন্তা-ভাবনা থেকে যা বস্তুতপক্ষে গর্হিত একটি অপরাধ।

আমাদের দেশে পূজার মৌসুমে "ধর্ম যার যার, উৎসব সবার" এটাও মূলত এরকমই একটি প্রচারণা যার নেপথ্যে রয়েছে হীন স্বার্থ প্রসূত কূটকৌশল। কোন রাষ্ট্র বা সমাজে সৃষ্টিকর্তা মনোনীত দ্বীন অনুসারীদের ধর্মচ্যুত করার প্রাথমিক ধাপ হিসাবে এভাবেই ধর্মনিরপেক্ষতার চটকদার প্রচারণা ও তথাকথিত উদারপন্থার ভাওতাবাজি প্রতিষ্ঠিত হয়, ঠিক যেভাবে একটি দেশের স্বাধীনতা আদায়ের প্রাথমিক ধাপ হিসাবে স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন কিংবা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নিরেট ভূমিকা রাখে।

অতএব, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতেও আমরা সকল সম্প্রদায়ের নাগরিকবৃন্দকে সম্মান করে চলব যেখানে যে যার ধর্মীয় উপাসনা ও উৎসবগুলো নিজ নিজ নিয়ম মাফিক পালন করবে। কেউ কারো প্রতি কোনো রকমের হেয় অথবা বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব প্রদর্শন করবে না।

প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজ নিজ ধর্মীয় স্বকীয়তা বজায় রেখে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করবে যেভাবে সংকরায়ণের পূর্বে মৌলের পরমাণুগুলোর অরবিটালে ইলেক্ট্রনগুলোর বিন্যাস অটুট থাকে। বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলমান। মহান আল্লাহ মুসলিমদেরকে সৃষ্টি করেছেন মধ্যপন্থী এক জাতি হিসাবে যেখানে কোন ধরনের চরম পন্থা অবলম্বনের সুযোগ আদৌ নেই।

ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ইসলাম ধর্মে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। অতীতে এ ধরনের বাড়াবাড়ির কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে অনেক জাতি ও সম্প্রদায়। তাই মন্দিরে হামলা তো বহুদূর, মূর্তিকে গালি দেয়া পর্যন্ত ইসলামে নিষেধ। এটাই দ্বীন ইসলামের সৌন্দর্য; ধর্ম নিরপেক্ষতার বাস্তব প্রতিচ্ছবি। অতএব, অসংকরায়িত ইসলামী শরীয়তই দ্বীন-ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করে যেভাবে হাইব্রিডাইজেশনের পূর্বে পরমাণুর অভ্যন্তরে অরবিটালগুলোর স্বকীয়তা অক্ষুণ্ন থাকে।

লেখক: অধ্যাপক ও গবেষক, রসায়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ