আইসিসিতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে ভুল তথ্য 

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এবং লেখক ব্যারিস্টার সোলায়মান তুষার (ইনসেটে)
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এবং লেখক ব্যারিস্টার সোলায়মান তুষার (ইনসেটে)  © সম্পাদিত

জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে বিভিন্ন পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) রোম স্ট্যাটিউট বা চুক্তির ১৫ অনুচ্ছেদের অধীনে মামলাটি দায়ের করেন ব্রিটিশ বাংলাদেশি একজন আইনজীবীসহ আরো দুই ব্রিটিশ আইনজীবী।  

মামলাটি দায়ের করেছেন ‘থ্রি বোল্ট কোর্ট চেম্বার্স’র ব্যারিস্টার মো. আশরাফুল আরেফিন, যিনি ব্যারিস্টার এমএ আরেফিন আশরাফ নামেও পরিচিত। এ আইনজীবীর সঙ্গে রয়েছেন ব্যারিস্টার সারাহ ফোরে, ব্যারিস্টার এমিল লিক্সান্দ্রু। মামলা সম্পর্কে অবগত করতে লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনেরও আয়োজন করেন ব্যারিস্টার এম এ আরেফিন আশরাফুল ও তার সহযোগীরা।

এখন প্রশ্ন হলো আইসিসির নিয়ম ও রোম চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আইসিসিতে মামলা দায়ের করতে পারে কিনা। এক কথায় বললে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আইসিসিতে মামলা দায়ের করতে পারে না। তবে প্রসিকিউটর অফিসকে অপরাধ সম্পর্কে তথ্য দেয়া যায় বা তদন্তের জন্য অনুরোধ করা যায়। সে তথ্য অনুযায়ী, তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে কিনা, তা আইসিসির একান্ত এখতিয়ার।

আইসিসিতে তিনটি প্রক্রিয়ায় মামলা হতে পারে:
১. আইসিসির যেকোনো সদস্য রাষ্ট্র মামলা দায়ের করতে পারে। বর্তমানে ১২৪টি সদস্য রাষ্ট্র রয়েছে। (রোম চুক্তি, অনুচ্ছেদ ১৪) 
২.  আইসিসির প্রসিকিউটর অফিস নিজ উদ্যোগে তদন্ত পরিচালনা করতে পারে। এক্ষেত্রে pre-trial Chamber থেকে অনুমোদন নিতে হবে। (রোম চুক্তি, অনুচ্ছেদ ১৫) 
৩.  জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ রোম চুক্তির ৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত কোন অপরাধ তদন্ত করতে বললে। (রোম চুক্তি, অনুচ্ছেদ ১৩) 

উপরে উল্লেখিত তিনটি পদ্ধতি ছাড়া আইসিসিতে মামলা দায়ের করার কোন সুযোগ নেই। আইসিসি সাধারণত গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং আগ্রাসনের (রোম চুক্তি, অনুচ্ছেদ ৫) বিচার করে থাকেন। আমার বিশ্বাস সংবাদ সম্মেলনের তথ্য ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আর সংবাদ সম্মেলনে মামলা দায়ের করার কথা বলা হলে তারা আলোচনা আসার জন্য মামলা দায়েরের তথ্য দিয়েছেন সাংবাদিকদের। কেননা রোম চুক্তি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে মামলা দায়ের করার ক্ষমতা দেয়নি। 

এ ছাড়া আইসিসির ইতিহাসে এমন কোনো নজির অতীতে নেই। কেবল আইসিসির প্রসিকিউটর টিমকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করা যায় বা তদন্তের জন্য অনুরোধ করা যায় রোম চুক্তির অনুচ্ছেদ ১৫ অনুযায়ী। আইসিসিতে মামলা দায়ের সংক্রান্ত তথ্যটি ভুল। এটা এমন হতে পারে ওই তিন ব্যারিস্টার আইসিসির প্রসিকিউটর টিমকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন বা অনুরোধ করেছেন কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে মামলার কথা বলেছেন। অথবা ওই তিন ব্যারিস্টার আইসিসির নিয়ম-কানুন বা রোম চুক্তির শর্ত না বুঝেই মামলার কথা বলেছেন। আর সাংবাদিকরা তথ্য যাচাই না করেই খবরটি প্রকাশ করেছেন।

আরো পড়ুন: বিএনপির সাত আইনজীবীকে অব্যাহতি, আবেদনকারীকে জরিমানা

উল্লেখ্য যে, গত জুলাই-আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের সময় এক হাজারের বেশি মানুষকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। ৩০ হাজারের অধিক ছাত্র-জনতা আহত হয়েছেন ও ৫ শতাধিক মানুষ তাদের চোখ হারিয়েছেন। ওই ঘটনায় বাংলাদেশের বিভিন্ন থানা, আদালতে ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (বাংলাদেশ) সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী, এমপি, দলীয় নেতা-কর্মী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে কয়েক শতাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে। 

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ইতিমধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অন্যদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। উল্লেখ্য যে, জুলাই-আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে গত ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যান। তিনি বর্তমানে ভারতেই অবস্থান করছেন। 

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট ও আন্তর্জাতিক আইনের গবেষক।


সর্বশেষ সংবাদ