বিশ্ব শিক্ষক দিবস: একজন জেন-জি শিক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গি
- মো. সোলায়মান মিয়া
- প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৫৯ AM , আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১১ PM
প্রতিবছর ৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব শিক্ষক দিবস, যেটি শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং তাদের ভূমিকার গুরুত্ব তুলে ধরার একটি আন্তর্জাতিক দিন। এ দিবসের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়ন, তাদের অধিকার এবং শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া। বিশ্ব শিক্ষক দিবস-২০২৪ এর প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘Valuing teacher voices: towards a new social contract for education’। এ প্রতিপাদ্যের মূল লক্ষ্য হলো- শিক্ষকদের মতামতকে মূল্যায়ন করা এবং শিক্ষাব্যবস্থার জন্য একটি নতুন সামাজিক অঙ্গীকার প্রতিষ্ঠা করা- যা শিক্ষকদের ভূমিকা, তাদের অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োগ করবে।
১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে যারা জন্মগ্রহণ করেছেন, তাদেরকে জেন-জি বা ‘জেনারেশন জেড’ বলা হয়। অর্থাৎ জেন-জি বলতে যে প্রজন্মকে বোঝানো হচ্ছে, তাদের বয়স ১২ থেকে ২৭ বছরের মধ্যে। জেন-জি শুধু পড়াশোনা নয়, বরং তারা প্রযুক্তি, সৃজনশীলতা এবং সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেছে; তাদের জন্য নতুন সামাজিক অঙ্গীকার কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়। সে বিষয়ে আমি জেন-জি এর একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কিছু ভাবনা শেয়ার করতে চাই।
আমি লক্ষ্য করেছি যে বৈষম্য- বিশেষ করে জাতিগত, ধর্মীয়, লিঙ্গভিত্তিক এবং অর্থনৈতিক পার্থক্য, শিক্ষার্থীদের মানসিক এবং একাডেমিক উন্নতির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। জেন-জি প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা এসব বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলতে আগ্রহী এবং তারা পরিবর্তন চাইছে। এক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষকদের ভূমিকা হলো- এ পরিবর্তনের নেতৃত্ব দেওয়া এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা। আমি বিশ্বাস করি, শিক্ষা হলো এমন একটি হাতিয়ার যা শিক্ষার্থীদের মন-মানসিকতা এবং মূল্যবোধ গঠনে সাহায্য করে। পাশাপাশি বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে যেখানে প্রযুক্তি ও শিক্ষা সমানভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে শিক্ষকদের সঠিক প্রশিক্ষণ এবং মানোন্নয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে।
জেন-জি শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল প্রযুক্তি, সোশ্যাল মিডিয়া এবং সৃজনশীল ক্ষেত্রে চমৎকার দক্ষতা দেখিয়েছে। তারা নানা ধরনের সৃজনশীল কাজ, উদ্ভাবনী প্রকল্প এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনে অনেক এগিয়ে। তবে একাডেমিক ক্ষেত্রে তাদের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। কারণ প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো অনেক সময় তাদের আগ্রহ এবং প্র্যাকটিক্যাল দক্ষতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। এ অবস্থায় শিক্ষকের ভূমিকা হতে হবে তাদের একাডেমিক উৎকর্ষতা ও জীবন দক্ষতার মধ্যে একটি সেতুবন্ধন।
অন্যদিকে একজন শিক্ষকের দায়িত্ব শুধু পাঠদান নয়, বরং শিক্ষার সকল স্তরে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। শিক্ষকদের দায়িত্ব হলো- শিক্ষার্থীদের মনের গভীরে প্রবেশ করা, তাদের সমস্যা বোঝা এবং সেই অনুযায়ী কার্যকর পদ্ধতি গ্রহণ করা। একটি কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থা তৈরির জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে একটি উন্মুক্ত সংলাপ ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। শিক্ষকদের কথাবার্তা কেবল তত্ত্বগত বিষয় নিয়ে নয়, বরং শিক্ষার্থীদের জীবনের বাস্তবতা এবং সমস্যাগুলোর সমাধান নিয়ে হতে হবে। এ পথে গেলে শিক্ষার্থীরা কেবল শিখবে না, বরং তারা নিজেদের পরিচয় এবং সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্ব অনুভব করবে।
জেন-জি শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল প্রযুক্তি, সোশ্যাল মিডিয়া এবং সৃজনশীল ক্ষেত্রে চমৎকার দক্ষতা দেখিয়েছে। তারা নানা ধরনের সৃজনশীল কাজ, উদ্ভাবনী প্রকল্প এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনে অনেক এগিয়ে। তবে একাডেমিক ক্ষেত্রে তাদের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। কারণ প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো অনেক সময় তাদের আগ্রহ এবং প্র্যাকটিক্যাল দক্ষতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। এ অবস্থায় শিক্ষকের ভূমিকা হতে হবে তাদের একাডেমিক উৎকর্ষতা ও জীবন দক্ষতার মধ্যে একটি সেতুবন্ধন। আমাদের দায়িত্ব হলো- তাদের আগ্রহ এবং দক্ষতাকে পাঠ্যক্রমের সাথে সংযুক্ত করে এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করা, যা তাদের জন্য আরও আকর্ষণীয় ও অর্থবহ হয়।
শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে পুনর্গঠন করা উচিত, যাতে শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনের দক্ষতাগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। আমরা দেখতে পাচ্ছি, জেন-জি শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতের কর্মক্ষেত্রে যে ধরনের দক্ষতা প্রয়োজন, সেগুলোতে খুব ভালো। তারা উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা, সমস্যা সমাধান এবং টিমওয়ার্কে পারদর্শী, যা বর্তমান সমাজের জন্য প্রয়োজন। তাদের শিক্ষক হিসেবে আমাদেরকে এ দক্ষতাগুলো একাডেমিক জ্ঞানের সঙ্গে একীভূত করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা সামগ্রিকভাবে উন্নতি করতে পারে। আজকের শিক্ষার্থীদের শুধু পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করা নয়, বরং তাদের জীবনমুখী শিক্ষা দেওয়াও জরুরি। জেন-জি শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা একাডেমিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে, তাদের জন্য শিক্ষার নতুন উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ, প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষণ পদ্ধতি, হাতে-কলমে কাজের সুযোগ এবং প্রযুক্তি-নির্ভর শিক্ষা তাদের জন্য আরও কার্যকর হতে পারে। এ পদ্ধতির মাধ্যমে তারা কেবল জ্ঞান অর্জনই নয়, বরং তাদের ইতোমধ্যেই অর্জিত দক্ষতাগুলোকেও কাজে লাগাতে পারবে। শিক্ষকদের এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে, কারণ আমাদের কাজ শিক্ষার্থীদের জীবন-দক্ষতা ও একাডেমিক পারফরম্যান্সের মধ্যে সমতা বজায় রাখা। তাদের নিজস্ব দক্ষতাকে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি, তাদের একাডেমিক চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবেলায় সহায়তা করা।
আমাদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হলো একাডেমিক এবং বাস্তব জীবনের দক্ষতার মধ্যে যে ফাঁক রয়েছে, তা কমিয়ে আনা এবং শিক্ষার্থীদের এমন একটি পরিবেশ দেওয়া, যেখানে তারা উভয় ক্ষেত্রেই সমানভাবে পারদর্শী হতে পারে। আমরা দেখতে পাই যে, অনেক শিক্ষার্থী একাডেমিক বিষয়ে দুর্বল হলেও তাদের সৃজনশীলতা, টিমওয়ার্ক এবং নেতৃত্বের গুনাবলীতে অত্যন্ত সক্ষম। তাদের এই দক্ষতাকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং তা শিক্ষার মূল ধারায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। শিক্ষক হিসেবে আমার প্রতিশ্রুতি হলো, আমি আমার শিক্ষার্থীদের যে কোনও দুর্বলতা বা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পাশে থাকব। তাদের একাডেমিক জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি তাদের দক্ষতার বিকাশেও কাজ করব।
আরো পড়ুন: শিক্ষকরা হবেন পথপ্রদর্শক, বন্ধু ও অনুপ্রেরণার উৎস
জেন-জি এর শিক্ষক হিসেবে আমি ক্লাসরুমে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শেখার পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করি। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, ইন্টারেক্টিভ শিক্ষণ সরঞ্জাম এবং অনলাইন সংস্থানগুলোর মাধ্যমে আমরা শিক্ষার্থীদের আরো যুক্ত করে তুলতে পারি। তবে শুধু প্রযুক্তিই নয়, এর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা, সহযোগিতার মানসিকতা এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ শেখানোও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আমার লক্ষ্য, শিক্ষার্থীদের মধ্যে চিন্তা ও যুক্তি বিকাশের এমন পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে তারা কেবল পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান অর্জন নয়, বরং সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্বও বুঝতে পারে। জেন-জি এর শিক্ষকদের জন্য এ দায়িত্বটি আরো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমাদের কাজ শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করা এবং তাদের সামাজিক, নৈতিক ও বৈশ্বিক চেতনা গড়ে তোলা।
পরিশেষে, বর্তমানে অনেক শিক্ষকই তাদের কর্মক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। বিশেষ করে কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে শিক্ষাব্যবস্থায় অনলাইন এবং হাইব্রিড মডেলের কারণে শিক্ষকদের ওপর চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষকদের মতামত, তাদের কাজের পরিবেশ এবং মানসিক চাপের বিষয়গুলো এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশ্ব শিক্ষক দিবস-২০২৪ এর প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে এটা আশা করা যাচ্ছে যে, শিক্ষকদের কথা শোনা এবং তাদের পরামর্শের ভিত্তিতে নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে, যা দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষার মানোন্নয়ন করবে।
এ প্রতিপাদ্যটি পরিবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকদের ভূমিকার প্রতি সম্মান ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পাশাপাশি, একটি টেকসই শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার পথে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে। এটি শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা এবং শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের যথাযথ ভূমিকার মূল্যায়ন করবে, যা শিক্ষার ভবিষ্যৎকে আরও শক্তিশালী এবং উন্নত করবে। জেন-জি এর শিক্ষক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিবর্তনের বীজ বপন করা, যাতে তারা ভবিষ্যতে ন্যায়বিচার এবং সমতার জন্য লড়াই করতে পারে। জেন-জি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে, আমি তাদের সক্ষমতা এবং দক্ষতাকে মূল্যায়ন করব। একটি সমতাপূর্ণ এবং মানবিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করব। আমাদের শিক্ষকেরা আমাদের শিক্ষার্থীদের সমর্থন করে একটি পরিবর্তনশীল সমাজ গঠনে অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
লেখক: সহকারি অধ্যাপক, সিএসই বিভাগ
গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
ইমেইল: solaiman@cse.green.edu.bd