নির্যাতিতের গল্প: নিঃশব্দের আওয়াজ
- আমানুর রহমান
- প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:৫৬ PM , আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:৪২ PM
আমার নাম আমানুর। এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। ছোট শহরে বেড়ে ওঠা, বাবা-মা দুজনেই শিক্ষিত। বাবা ছিলেন একজন শিক্ষক, আর মা একজন গৃহিণী। ছোটবেলা থেকেই আমার মায়ের স্বপ্ন ছিল, আমি একদিন বড় হয়ে শহরের বিখ্যাত কলেজে পড়াশোনা করব। তাদের সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্য নিয়েই আমি পড়াশোনায় সবসময় মনোযোগী ছিলাম। একসময় কঠোর পরিশ্রমের ফলে শহরের নামকরা একটি কলেজে সুযোগ পেলাম। শুরু হলো আমার জীবনের নতুন অধ্যায়ের।
কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রথম দিনটা ছিল রোমাঞ্চকর। বিশাল ক্যাম্পাস, হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী, পরিচিত-অপরিচিত অনেক মুখ। সবকিছু যেন স্বপ্নের মতো লাগছিল। আমার মনে হচ্ছিল, অবশেষে আমি আমার গন্তব্যে পৌঁছেছি। মা-বাবা গর্বিত, আমিও গর্বিত। হোস্টেলে উঠলাম, নতুন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে শুরু করলাম। তবে জানতাম না, সামনে ঠিক কী অপেক্ষা করছে।
“তোমরা নতুন, তাই তোমাদের নিয়ম শিখতে হবে। আমরা যা বলব, সেটা করতে হবে। না করলে তোমাদের অবস্থা খুব খারাপ হবে।”
হোস্টেলে প্রথম সপ্তাহটা ভালোই কাটল। কয়েকজন সহপাঠী বন্ধু হলো, সিনিয়রদের সাথেও পরিচয় হলো। প্রথমদিকে সিনিয়ররা বেশ ভালো ব্যবহার করেছিল। তাদের হাসি, কথা—সবকিছুই স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের আসল রূপ প্রকাশ পেতে শুরু করল। একদিন রাতে, হোস্টেলের কক্ষের দরজায় জোরে কড়া নড়লো। দরজা খুলতেই তিনজন সিনিয়র ঢুকে পড়ল। তাদের চোখে-মুখে অদ্ভুত এক ধরনের আনন্দ। তারা বলল, “তোমরা নতুন, তাই তোমাদের নিয়ম শিখতে হবে। আমরা যা বলব, সেটা করতে হবে। না করলে তোমাদের অবস্থা খুব খারাপ হবে।”
আমরা যারা নতুন, তখনও তেমন কিছু বুঝিনি। প্রথমদিকে কিছু ছোট কাজ করানো হতো—যেমন তাদের জন্য খাবার আনা, জামা-কাপড় ধোয়া। মনে করেছিলাম, হয়তো এটা একটা রীতি, যা সবার সাথে হয়ে থাকে। কিন্তু আসল সমস্যা শুরু হলো কিছুদিন পর। এক রাতে আবার তারা আমার ঘরে এলো। এবার তারা আমাকে এবং আমার এক বন্ধুকে বলল, তোমাদের এখন থেকে আমাদের নিয়ম মেনে চলতে হবে। আর তা না করলে অনেক খারাপ হবে। তাদের কথার ভয় দেখানো সুর এবং চোখে-মুখে বিকৃত হাসি দেখে বুঝতে পারলাম, কিছু একটা অস্বাভাবিক হতে যাচ্ছে।
তারা জোর করে আমাকে সিগারেট খেতে বাধ্য করল। কখনো হাত-পা জ্বালিয়ে দেওয়া হতো সিগারেটের আগুনে। আমি বাধ্য হয়ে সব সহ্য করেছিলাম। ভয়ের কারণ ছিল যে তারা অনেক প্রভাবশালী।
এরপর থেকেই শুরু হলো তাদের নির্যাতনের পর্ব। প্রথমে তারা আমাকে রাত জেগে বিভিন্ন অমানবিক কাজ করাতে লাগল—কখনো সারারাত দাঁড় করিয়ে রাখা, কখনো আবার রুম পরিষ্কার করা কিংবা তাদের চাহিদামত কাজ করা। একবার তারা জোর করে আমাকে সিগারেট খেতে বাধ্য করল। কখনো হাত-পা জ্বালিয়ে দেওয়া হতো সিগারেটের আগুনে। আমি বাধ্য হয়ে সব সহ্য করেছিলাম। ভয়ের কারণ ছিল যে তারা অনেক প্রভাবশালী।
আমার বন্ধু শাকিলও তাদের নির্যাতনের শিকার ছিল। আমরা একসাথে এই মানসিক ও শারীরিক অত্যাচারের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলাম। প্রতিদিন রাতে একটা অজানা আতঙ্ক আমাদের গ্রাস করত। কখন আবার তারা আসবে, কখন আবার আমাদের ওপর অত্যাচার শুরু করবে—এই ভয়ে রাতে ঠিক মতো ঘুমাতে পারতাম না। ক্লাসে মনোযোগ বসত না, পড়াশোনা একপ্রকার বন্ধই হয়ে গিয়েছিল।
এক রাতে সিনিয়রদের অত্যাচারের মাত্রা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাল। সেদিন তারা আমাদের দুজনকে ডেকে নিয়ে গেল হোস্টেলের ছাদে। সেখানে আরও কয়েকজন সিনিয়র ছিল, যাদের মধ্যে কয়েকজন মদ্যপান করছিল। তারা আমাদের নিয়ে অশ্লীল কথা বলতে শুরু করল এবং জোর করে আমাদের দিয়ে অশ্লীল কিছু কাজ করানোর চেষ্টা করল। আমরা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হলো না। শারীরিক নির্যাতনের সাথে মানসিক নির্যাতনও চলতে লাগল। শাকিল আর সহ্য করতে পারল না। সে একসময় হঠাৎ করেই ভেঙে পড়ল। তার শরীরটা নিস্তেজ হয়ে গেল, আর সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
আমি ভয়ে হতবাক হয়ে গেলাম। দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। চিকিৎসকরা জানালেন, শাকিল মানসিকভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছিল যে তার শরীর সেই চাপ সহ্য করতে পারেনি। শাকিলকে আইসিইউতে ভর্তি করা হলো। তার অবস্থা ছিল সংকটাপন্ন। সেই মুহূর্তে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আর চুপ করে থাকা যাবে না। নিজের জীবনের পাশাপাশি বন্ধু শাকিলের জীবনও বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
হোস্টেলের ওয়ার্ডেন বললেন, “এগুলো সাধারণ ব্যাপার, জুনিয়রদের একটু মানিয়ে নিতে হয়। সিনিয়রদের কথা শুনতে শিখতে হবে।”
আমি ভয়ে কাঁপছিলাম, তবুও সাহস করে কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রথমে আমার ভেতর এক ধরনের দ্বিধা কাজ করছিল। যদি তারা আমার কথা না শোনে? যদি আমার অভিযোগ তাদের কাছে গুরুত্ব না পায়? কিন্তু এরপরও আমি সাহস করে হোস্টেলের ওয়ার্ডেনের কাছে গিয়ে সব খুলে বললাম। তিনি প্রথমে বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দিলেন না। তিনি বললেন, “এগুলো সাধারণ ব্যাপার, জুনিয়রদের একটু মানিয়ে নিতে হয়। সিনিয়রদের কথা শুনতে শিখতে হবে।”
আমি হতাশ হলাম, কিন্তু থামলাম না। এরপর সরাসরি প্রিন্সিপালের কাছে গিয়ে পুরো ঘটনা জানালাম। তার কাছে গিয়ে আমি শাকিলের অবস্থার কথা বললাম এবং সিনিয়রদের অত্যাচারের বিবরণ দিলাম। কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রথমে বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দিল না, কিন্তু যখন শাকিলের শারীরিক অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যেতে লাগল, তখন তারা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু করল।
কলেজে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো। তদন্তের পর দেখা গেল আমার অভিযোগ সত্যি। সিনিয়রদের অত্যাচার এতটাই অমানবিক ছিল যে তারা আর কলেজে থাকার উপযুক্ত নয়। সিনিয়রদের মধ্যে কয়েকজনকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হলো, আর বাকিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলো। হোস্টেলে নতুন নিয়ম চালু হলো যেন এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে।
ধীরে ধীরে শাকিল সুস্থ হয়ে উঠল ঠিকই কিন্তু তার ভেতরের সেই আতঙ্ক কখনোই পুরোপুরি দূর হলো না। আর আমার জীবনেও সেই সময়ের অভিজ্ঞতা একটি স্থায়ী ক্ষত হিসেবে রয়ে গেল। আমি যতই স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করি না কেন, সেই অমানবিক দিনগুলো আমাকে তাড়া করত। রাতে ঘুমাতে গেলেই সেই দুঃস্বপ্নগুলো ফিরে আসত—সিনিয়রদের বিকৃত হাসি, শাকিলের কান্না, আর আমাদের অসহায়ত্ব।
কিন্তু আমি একটি জিনিস শিখেছিলাম—নীরবতা কখনোই সমাধান নয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়, যত কঠিনই হোক না কেন। আমি যদি সেদিন চুপ করে থাকতাম, তাহলে হয়তো আজ শাকিলকে বাঁচানো যেত না। হয়তো আরও অনেক নির্যাতিত ছাত্রের একই পরিণতি হতো। সেই দিনগুলো আমাকে শেখালো, নিজের অধিকার রক্ষা করার জন্য সাহসী হতে হয়।
কলেজের সেই অধ্যায় শেষ হলেও আমার জীবনের ওপর সে প্রভাব আজও রয়ে গেছে। তবে এখন আমি জানি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাটা কেবল নিজের জন্য নয় বরং সমাজের জন্যও প্রয়োজন। নিজের জীবনের এই অভিজ্ঞতা আমাকে একজন সাহসী মানুষ হতে শিখিয়েছে।