বন্যা পরিস্থিতি সামলাতে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা জরুরি

বনভাসি মানুষ ও লেখক
বনভাসি মানুষ ও লেখক  © সম্পাদিত

যখন কোনো গণতান্ত্রিক দেশ কোনো উদ্ভূত পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, তা মোকাবিলায় সর্বদলীয় বৈঠক আহ্বান করা হয় রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী দুঃশাসনের অবসান হলে, উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলা এবং দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়।

আওয়ামী সরকারের পতনের পর দেশের আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থার অবনতি ঘটে। বিশেষ করে আওয়ামী সরকারের সহযোগী হিসাবে কাজ করা পুলিশ বাহিনী জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এছাড়াও পুলিশের অধিকাংশ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আত্মগোপনে চলে যান। পরবর্তীতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পুলিশ বাহিনীতে সংস্কার কাজ শুরু করে এমনকি পোশাক ও লোগো পরিবর্তনেরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এছাড়াও সরকারের অন্যান্য রাষ্ট্রযন্ত্রের সংস্কার কাজও অব্যাহত রাখে। এরই মধ্যে দেশে স্থিতিশীলতা ফেরার পূর্বেই দ্বিতীয় স্বাধীনতা উত্তর সপ্তাহ-দুইয়ের মধ্যেই পাহাড়ি ঢল ও পূর্ব বার্তা ছাড়া ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ খুলে দেওয়ায় দেশের ১১টি জেলার প্রায় অর্ধ-কোটি মানুষ স্মরণকালের ভয়াবহ আকস্মিক বন্যার শিকার হয়। হাজারো পরিবারের বাড়িঘর পানিতে ভেসে গেছে, ফলে আশ্রয়হীন পড়ে হয়ে পড়ে লাখো মানুষ।

বন্যাকবলিত এলাকায় খাদ্য, শিশু খাদ্য, জরুরি ওষুধ সেবাসহ চরম আশ্রয়হীনতা দেখা দিয়েছে। এছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলের যারা ঘরছাড়া হয়ে পানিবন্দি অবস্থায় উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে এবং অনেককে দেখা গেছে ঘরের ছাদে আশ্রয় নিতে। শুধু জান নিয়ে বেঁচে থাকা এসব মানুষকে উদ্ধার ও দুর্গম অঞ্চলে পৌঁছে মানুষকে সাহায্য করারও চরম সীমাবদ্ধতা দেখা গিয়েছে।

আরও পড়ুন: সজিব ওয়াজেদের দাবির সঙ্গে রাহনুমার মৃত্যুর প্রাসঙ্গিকতা কি

যদিও সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার ও ত্রাণ বিতরণের কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বানভাসি মানুষের জন্য ত্রাণ সংগ্রহ ও উদ্ধার কাজ নিজ নিজ জায়গা থেকে করে যাচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরও বানভাসি মানুষের জন্য ত্রাণ সংগ্রহ করতে দেখা গেছে। এই সবকিছু বানভাসি মানুষের সাহায্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসা শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

এত সব আয়োজনের মাঝেও ভয়াবহ আকস্মিক বন্যায় পানিবন্দি মানুষের কাছে ত্রাণ যথাযথভাবে পৌঁছে দেওয়া ও উদ্ধার কাজের সীমাবদ্ধতার বিভিন্ন অভিযোগ উঠে এসেছে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়। এর মধ্যে যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ তাদের ত্রাণ না পাওয়া, অনেকে দুই-তিন দিন ধরে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি পায়নি বলে অভিযোগ এসেছে। এছাড়া যারা উদ্ধার কাজ পরিচালনা করেছে, তারা দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে যথাসময়ে পৌঁছাতে পারেনি বলে মিডিয়ায় এসেছে। তারা বলছে, যারা ত্রাণ পেয়েছে ২-৩ বার পেয়েছে কিন্তু অনেকেই একবারও পায়নি। কারণ যারা ত্রাণ বা বিভিন্ন সহযোগিতা নিয়ে আসছে, তাদেরও অধিকাংশই জানে না কোথায় যাওয়া দরকার আর কোথায় যাওয়া দরকার নয়।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বন্যা চলাকালীন যে জনদুর্ভোগ তৈরি হয়েছে, তা পরবর্তী সময়ে কয়েক গুণ বেশি আকার ধারণ করতে পারে। অনেকের ঘরবাড়ি পানিতে ভেসে গেছে, অনেকের ফসলি জমি নষ্ট হয়েছে, গবাদিপশু মারা গেছে এবং মজুত করা খাদ্যপণ্য নষ্ট হয়ে গেছে। এর ফলে যারা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত, তাদের জীবন বন্যা-পরবর্তী সময়ে চরম সংকটের মধ্যে পড়তে পারে। এছাড়াও আমাদের সমাজে মধ্যবিত্ত অনেক ফ্যামিলি আছে, যারা সমাজে মর্যাদার দিক দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলেও, অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল নয়, তারা মানুষের কাছে হাতও পাততে পারে না। এছাড়া অনেক স্কুল ও মাদ্রাসা শিক্ষক আছেন, যারা চাকরি করে নিত্যদিনের জীবিকা নির্বাহ করেন। বন্যা-পরবর্তী তাদের অনেকের পারিবারিক জীবন পুনর্বাসন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। 

ইতোমধ্যে বানভাসি মানুষের সহায়তার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ‘প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল’ নামে ফান্ড তৈরি করেছে। এছাড়াও ব্যক্তিগত ও বিভিন্ন ফাউন্ডেশন থেকেও বানভাসি মানুষকে ত্রাণ সরবরাহ ও বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসনের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোও বন্যাকবলিত এলাকায় নিজ নিজ জায়গা থেকে ত্রাণ সরবরাহ করছে। এদিকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন' ব্যানারে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগকে আলাদাভাবে ত্রাণ সরবরাহ করতে দেখা গেছে। ছাত্রদের বিভিন্ন গ্রুপ যেমন জেলা সমিতি, আবাসিক হল ছাড়াও নানা উদ্যোগে ত্রাণ সরবরাহ করেছে।

এভাবে সবাই যার যার জায়গা থেকে ত্রাণ সরবরাহ করায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ, প্রকৃতপক্ষে যাদের জন্য ত্রাণ জরুরি, তারাই ত্রাণসহ অন্যান্য সহযোগিতা পাচ্ছে না। এমনটা চলতে থাকলে বন্যা-পরবর্তী সময়ে বন্যাকবলিত অনেক পরিবার ন্যায্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে।

এছাড়া সেনাবাহিনীকে হেলিকপ্টার থেকে ত্রাণ দিতে দেখা গেছে। তবে এটা খুব জরুরি মুহূর্তে হতে পারে। এক্ষেত্রে ত্রাণ নিচে ফেললে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে, কার আগে কে নেবে প্রতিযোগিতা চলে। ফলে অনেকে বেশি পায়, আবার কেউ খালি হাতে ফিরে যায়। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, ওপর থেকে ত্রাণ পড়ছে আর নিচে ত্রাণ সংগ্রহের জন্য হুড়োহুড়ি। এসবের মাঝে সমাজের অনেকে আসেন না। যদিও বন্যার বেলায় সবার অবস্থা একই। 

তাই চলমান বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং বন্যা-পরবর্তীতে বানভাসি মানুষের পুনর্বাসন সহযোগিতা সবার কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তৎপরতায় কেন্দ্রীয়ভাবে সর্বদলীয় অন্তর্ভুক্তিমূলক সমন্বয় দরকার। তাদের কাজ হবে বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকায় প্রতিনিধি ঠিক করা, যারা তাদের এলাকায় ত্রাণ পাচ্ছে কি না বা কোথায় যাওয়া জরুরি, এলাকাভিত্তিক সবার ক্ষয়ক্ষতি ও চাহিদার তথ্য কেন্দ্রে নিশ্চিত করবেন।

এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারীরা এলাকাভিত্তিক স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও মাঠ প্রশাসনের সহায়তা নিতে পারেন। যারা ত্রাণ সরবরাহ করছেন, তাদের সাথে সমন্বয় করবেন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারীরা এবং তারা চাহিদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট এলাকায় তাদের পাঠাবে এবং এলাকাভিত্তিক প্রতিনিধিদের মাধ্যমে বণ্টন করবেন। যারা এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছে এবং যেসব এলাকায় এখনো পানি নেমে যায়নি, সেসব এলাকায় সরাসরি খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বয় ছাড়া বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসনের সহযোগিতা সমভাবে সবার কাছে পৌঁছানো সম্ভব নয়।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যারা দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, তাদের কেউই রাজনৈতিক ব্যক্তি নন, তাদের কেউ কাজ করেছেন সরকারি অফিসে, কেউ কাজ করেছেন সামরিক বাহিনীতে। তাদের অধিকাংশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের সাথে সম্পর্কের সুযোগ হয়নি। তাদের স্থানীয় কোনো প্রতিনিধিও নাই। তাই সময় এসেছে সর্বদলীয় বৈঠক ডেকে বর্তমান বন্যা পরিস্থিতি এবং পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলা করার।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence