বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সফলতার পর কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাই
- ড. মো. মোর্ত্তূজা আহমেদ
- প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০২৪, ১০:১০ AM , আপডেট: ১৩ আগস্ট ২০২৪, ১০:৩০ AM
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সফলতার পর বাংলাদেশে যে পরিবর্তনগুলো প্রয়োজন, তা দেশটির রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং প্রশাসনিক কাঠামোকে মৌলিকভাবে উন্নত করতে সহায়ক হবে। প্রথমত, সংবিধানের মৌলিক নীতিগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন অপরিহার্য। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, এবং ধর্মনিরপেক্ষতা—এই চারটি মৌলিক নীতি দেশের উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি করে।
জাতীয়তাবাদ দেশের অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করবে এবং জাতীয় স্বকীয়তা রক্ষায় সাহায্য করবে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের জাতীয়তাবাদী পদক্ষেপগুলির মাধ্যমে তাদের বৈচিত্র্যময় জনগণের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে যেখানে বৈষম্য ও শোষণ কমবে, যেমন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলির সামাজিক নীতি যা উচ্চ মানের সামাজিক সুরক্ষা প্রদান করে।
গণতন্ত্রের মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পাবে, যা প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং যোগ্য নেতৃত্ব নিশ্চিত করবে; যেমন সুইজারল্যান্ডের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিটি ধর্মের প্রতি সমান সম্মান প্রদর্শন করবে এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি করবে, যেমন কানাডায় ধর্মনিরপেক্ষ নীতি সমাজের শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রেখেছে।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনেরযে প্রধান দাবি মেধাভিত্তিক নিয়োগ তা যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। মেধা ভিত্তিক নিয়োগ ও নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের দক্ষতা ও প্রতিযোগিতামূলকতা বৃদ্ধি পাবে। সিঙ্গাপুরের মেধা ভিত্তিক প্রক্রিয়াটি প্রশাসনিক দক্ষতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য ন্যূনতম স্নাতক যোগ্যতার শর্ত কর্মক্ষমতাকে প্রাধান্য দেবে, যেমন জাপানে সংসদ সদস্যদের জন্য উচ্চ শিক্ষার শর্ত বর্তমান সদস্যদের গুণগত মান বৃদ্ধি করেছে।বয়স ও মেয়াদ সীমার প্রবর্তন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং নেতৃত্বের সুষম বিকাশ নিশ্চিত করবে।
উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে দুইবারের বেশি নির্বাচিত হওয়ার সীমা রাখা হয়েছে, যা রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও নবীনত্বের ভারসাম্য বজায় রাখে। রাষ্ট্রের প্রধান পদে থাকা অবস্থায় দলের প্রধানের পদ ছাড়ার নিয়ম রাজনৈতিক বিভাজন কমাতে এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে, যেমন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী প্রধান দলীয় পদ ছাড়েন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সময়।
উত্তরাধিকার নীতি বাতিল করে পরিবারতন্ত্রের পরিবর্তে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া স্থাপন করা হবে, যেমন দক্ষিণ কোরিয়ায় পারিবারিক রাজনীতি কমেছে এবং গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। স্পেশাল পাওয়ার এক্ট বাতিল করা মানবাধিকার লঙ্ঘন কমাবে এবং একটি আইনি সুশাসন নিশ্চিত করবে, যেমন ব্রিটেনে স্পেশাল পাওয়ার এক্ট বাতিলের পর মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।দ্বী-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থা কার্যকারিতা বৃদ্ধি করবে এবং প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করবে। হাউজ অব সিনেট সমাজের জ্ঞানী-গুণীজনদের নিয়ে গঠিত হবে, যা বাস্তব অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান সমন্বয়ের সুযোগ দেবে।
হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সাংসদদের নিয়ে গঠিত হবে, যেমন যুক্তরাষ্ট্রের সংসদীয় ব্যবস্থা কার্যকর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনা দেশের ইতিহাস ও জাতীয় পরিচয় রক্ষা করবে, যেমন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলাদেশে একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়তে হলে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, সামাজিক সংহতি এবং সকল ধর্মের প্রতি সমান সম্মান নিশ্চিত করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রথমত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং বিভিন্ন ধর্মের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে তরুণ প্রজন্ম বিভিন্ন ধর্মকে সম্মান করতে শিখে। দ্বিতীয়ত, ধর্মীয় বিভেদ দমনের জন্য কার্যকর আইন প্রণয়ন এবং এসব আইন বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রমে বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে সবার মতামত শোনা যায়। এছাড়া, সকল ধর্মের উৎসব ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও সমর্থন প্রদান করতে হবে, যা ধর্মীয় সমন্বয়কে উৎসাহিত করবে।
একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। প্রথমত, ধর্মীয় উন্মাদনা ও সংঘাত কমিয়ে এনে সামাজিক শান্তি এবং জাতিগত সংহতি নিশ্চিত করবে, যেমন কানাডার বহুসাংস্কৃতিক নীতি সমাজে শান্তি বজায় রাখছে। দ্বিতীয়ত, ধর্মীয় বৈষম্য ও সংঘাত আর্থিক প্রবৃদ্ধির জন্য বাধা সৃষ্টি করে; অসাম্প্রদায়িক সমাজ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করবে, যেমন নরওয়ে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও অন্তর্ভুক্তির নীতি মাধ্যমে উন্নতি অর্জন করেছে।
তৃতীয়ত, মানবাধিকার সুরক্ষিত হবে, যেমন সুইডেনের মানবাধিকার নীতি ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বজায় রেখে নাগরিকদের অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করছে। সর্বশেষে, একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ দেশের মধ্যে সামগ্রিক ঐক্য ও জাতীয় পরিচয় গড়ে তুলবে, যেমন ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিভিন্ন ধর্মের সমন্বয় বজায় রেখে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছে। এসব পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশে ধর্মীয় বৈষম্য হ্রাস পাবে, সামাজিক শান্তি ও সমন্বয় বৃদ্ধি পাবে, এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও জাতীয় ঐক্য শক্তিশালী হবে।
আস্থা ভোটের ব্যবস্থা সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধি করবে, যা সুইজারল্যান্ডের আস্থা ভোট ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা সরকারি স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করবে, যেমন সিঙ্গাপুরের দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন। এসব পরিবর্তন বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি সুসংগঠিত, সুশৃঙ্খল, এবং ন্যায্য সমাজ গঠন করতে সক্ষম হবে।
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সফলতার পর বাংলাদেশের যে পরিবর্তনগুলো প্রয়োজন, তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট ভাঙা। ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট মূলত বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলোর একত্রিত প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণকে বোঝায়, যা সাধারণ জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করে। এই সিন্ডিকেটগুলোর প্রভাব কমানোর মাধ্যমে একটি স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি করা হবে, যা ছোট ও মাঝারি ব্যবসার উন্নতি এবং অর্থনৈতিক সমতা বৃদ্ধি করবে।উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাজ্যে ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট বিরোধী নীতির মাধ্যমে বাজারে স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলোর নিয়ন্ত্রণ সীমিত করার মাধ্যমে ছোট ব্যবসার সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। সিঙ্গাপুরে ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট বিরোধী পদক্ষেপগুলির মাধ্যমে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা উন্নত হয়েছে।এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করা হলে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আরও সুষ্ঠু, প্রতিযোগিতামূলক, এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়ে উঠবে, যা সাধারণ জনগণের স্বার্থ রক্ষা করবে এবং একটি ন্যায্য অর্থনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করবে। ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট ভাঙার মাধ্যমে শুধুমাত্র ব্যবসার পরিবেশ উন্নত হবে না, বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক ন্যায্যতা উন্নত হবে।
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সফলতার পর বাংলাদেশের জন্য একটি সুশৃঙ্খল, ন্যায্য, এবং উন্নত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে যে পরিবর্তনগুলো প্রয়োজন, তা দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং প্রশাসনিক কাঠামোকে ব্যাপকভাবে উন্নত করবে। সংবিধানের মৌলিক নীতিগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন, মেধা ভিত্তিক নিয়োগ এবং নির্বাচনের মাধ্যমে প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি, শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত আরোপ, বয়স ও মেয়াদ সীমা নির্ধারণ, এবং পরিবারের উত্তরাধিকার নীতির পরিবর্তন। এই সব পদক্ষেপ একটি আরও ন্যায্য এবং স্বচ্ছ শাসনব্যবস্থার দিকে অবদান রাখবে।রাষ্ট্রীয় প্রধানদের দলীয় পদ ছাড়ার নিয়ম, স্পেশাল পাওয়ার এক্ট বাতিল, দ্বী-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থা, আস্থাভোটেরব্যবস্থাএবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনা দেশের সুশাসন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে। এসব পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি দুর্নীতিমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, এবংপ্রগতিশীল সমাজ গড়তে পারবে, যা নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করবে এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নে সহায়ক হবে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।