বাংলাদেশে ১১ এপ্রিল ঈদ হচ্ছে কেন?

অধ্যাপক ড. যুবাইর মুহাম্মদ এহসানুল হক
অধ্যাপক ড. যুবাইর মুহাম্মদ এহসানুল হক  © ফাইল ফটো

বাংলাদেশের পূর্বে ১০ এপ্রিল ঈদ উদযাপিত হচ্ছে, বাংলাদেশের পশ্চিমেও। বাংলাদেশে ১১ এপ্রিল ঈদ উদযাপিত হবে। এমনটা কেন হচ্ছে? পৃথিবীর প্রায় সকল মুসলিমপ্রধান দেশে ১০ এপ্রিল ঈদ উদযাপিত হচ্ছে। বাংলাদেশে হবে আগামীকাল ১১ এপ্রিল। এমন একটি পোস্ট দেওয়ার পর বহু বন্ধু তা শেয়ার করেছেন। অনেকে নানা তথ্য ও ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে জানাচ্ছি যে, আপনারা আমাকে যা জানাতে চেয়েছেন তা আমি পূর্বেই জানি। আপনাদের তথ্যগুলো জিজ্ঞাস্য বিষয়ে তেমন কাজে আসবে না।

ঈদ পালনে দিবস ভিন্নতার একটি বড় কারণ তো রাষ্ট্রীয় বিভক্তি। আগে কোন দেশ একত্রে ঈদ পালন করতো, এখন দুভাগ হয়ে গেছে, দুই দিনে ঈদ পালন করে। বিষয়টি যেন এমন, তর্কের খাতিরে ধরে নিচ্ছি, বাংলাদেশের কোন অংশ যদি আগামী বছর স্বাধীন হয় দেশ দুটি ভিন্ন ভিন্ন দিনে ঈদ উদযাপন করবে।

আরেকটি কারণ, মুসলিম শাসনের অনুপস্থিতি। ভারতে দুদিনে ঈদ উদযাপিত হচ্ছে। মুসলিম শাসনাধীনে থাকলে এমনটি হয়ত হতো না। তবে এগুলো মূল কারণ নয়, মুখ্য কারণ হল, চাঁদ দেখার পদ্ধতিগত ভিন্নতা। মুসলিম দেশগুলোতে তিনটি পদ্ধতিতে চাঁদ দেখার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। এর ওপর ভিত্তি করে দিবসভিন্নতা ঘটে যায়:

১. নিরেট ক্যালকুলেশন: চন্দ্রকলার হিসাবে পূর্বনির্ধারিত ক্যালেন্ডার ফলো করা হয়, চাঁদ দেখে না, চাঁদ দেখার ঘোষণাও দেয় না, কেবল রোজা ও ঈদের তারিখ ঘোষণা করে। এ পদ্ধতি বেশ কয়েকটি দেশে অবলম্বন করা হয়, প্রণিধানযোগ্য। দুটি দেশ হল: তুরস্ক ও মিশর। তুরস্কে চাঁদ দেখার বালাই নেই। তারা পূর্বনির্ধারিত ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে। তবে এটি মনগড়া নয়, ফলে পাশ্ববর্তী দেশগুলোর চাঁদ দেখার সাথে তা মিলে যায়।

মিশরের চন্দ্রদর্শনপদ্ধতি সবচেয়ে সহজবোধ্য: চন্দ্রোদয় হবে সূর্যাস্তের পূর্বে, চন্দ্রাস্ত হবে সূর্যাস্তের পর, এক সেকেন্ড পরে হলেও চলবে, খালি চোখে চাঁদ দেখা যেতে হবে, এমন কোন বিষয় নেই। মিশরের ঘোষণাও পরিষ্কার, দেশটির ঘোষণা এমন: জোতির্বৈজ্ঞানিকভাবে চাঁদ দেখা সাব্যস্ত হয়েছে, অতএব অমুক তারিখে ঈদ উদযাপিত হবে। আশাকরি আপনারা ঝাপিয়ে পড়বেন না, এটি হাদীসবিরোধী  বলে। না, তা নয়। এতে নির্ভুলভাবে হাদীস পালন করা যায়।

২. ক্যালকুলেশন ও টেলিস্কোপিক দর্শনের সমন্বয়: কয়েকটি দেশ ক্যালকুলেশনের পাশাপাশি টেলিস্কোপিক দর্শনের মাধ্যমে তা প্রত্যায়িত করে। যেমন, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া। দেশ দুটি ক্যালকুলেশন করে। পাশাপাশি টেলিস্কোপিক দর্শনের সম্ভাবতার সহায়তা গ্রহণ করে। অর্থাৎ ভিজিবিলিটি কার্ভে টেলিস্কোপিক দর্শনের অঞ্চলে আছে কী না তা যাচাই করে।

শুয়ুখ রাগ করবেন না, সৌদি আরবও এ পদ্ধতি অনুসরণ করে। এ বছর সৌদি আরবে রোজার ঘোষণা ছিল ক্যালকুলেশনভিত্তিক, তবে মারসাদে শক্তিশালী টেলিস্কোপ ব্যবহার করে তারা চাঁদ দেখে নিয়েছিল। এ কথা বলে কেউ ঝাপিয়ে পড়বেন না যে, টেলিস্কোপে তো অমাবশ্যারও চাঁদ দেখা যায়! হা, তা যায়, তবে অমাবশ্যার চাঁদ ও নতুন চাঁদের মাঝে পার্থক্য করার মত জ্ঞান টেলিস্কোপ ব্যবহারকারীদের আছে। সূর্যাস্তের পর যে চাঁদ দেখা যায় সেটা নতুন মাসের চাঁদ।

পাকিস্তান কয়েক বছর ধরে টেলিস্কোপ ব্যবহার করছে। আরো বহু দেশ ওপরের পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করে, যেমন ওমান ব্যতীত সকল উপসাগরীয় দেশ, মরক্কো ব্যতীত উত্তর আফ্রিকার সকল দেশ।

৩. খালি চোখে চাঁদ দেখা: খালি চোখেই চাঁদ দেখতে হবে, টেলিস্কোপ ব্যবহার করা যাবে না, ক্যালকুলেশনে নির্ভর করা যাবে না। এটা আমাদের বাংলাদেশের পদ্ধতি। তবে এবারের ঈদ উদযাপনে আমরা নিঃসঙ্গ হলেও এ পদ্ধতি ব্যবহারে আমরা সঙ্গীহীন নই।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমান ও উত্তর আফ্রিকার দেশ মরক্কো এ পদ্ধতি অনুসরণ করে। তাই ওই দুটি দেশে রোজা আমাদের সাথে হলেও ঈদ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর সঙ্গে। আমাদের পদ্ধতিতে ভুলত্রুটি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

আকাশে চাঁদ থাকা সত্ত্বেও চাঁদ না দেখা: যেমন কয়েক বছর আগে আকাশ মেঘলা ছিল, ভিজিবিলিটি কার্ভে বাংলাদেশ গ্রিন জোনে থাকলে চাঁদ দেখা যায়নি। অথচ আসামে চাঁদ দেখা গিয়েছিল খালি চোখেই, বার্মায়ও খালি চোখেই চাঁদ দেখা গিয়েছিল। পূর্বের দেশে খালি চোখে চাঁদ দেখা গেলে পশ্চিমে চাঁদ দেখার প্রয়োজন থাকে না।

গতকাল বাংলাদেশ ব্লু জোনে ছিল, চাঁদ দেখার সম্ভাবনা ছিল খালি চোখেই, তবে টেলিস্কোপ ব্যবহার করলে নিশ্চিতভাবে চাঁদ দেখা যেত। আমি ব্যক্তিগতভাবে ক্যালকুলেশনের পক্ষে। তবে এখনই তা সুপারিশ করি না। যেদেশে টেলিস্কোপ ব্যবহারেই আপত্তি, সেদেশে ক্যালকুলেশনের বচন অরণ্যে রোদন।

আমি জোরালোভাবে সুপারিশ করি চাঁদ দেখায় টেলিস্কোপের সহায়তা নিন, ঈদ রোজা পালনে দিবসভিন্নতা অর্ধেকে নেমে আসবে। নিচের বিষয়গুলো বিবেচনা করুন: খালি চোখেই চাঁদ দেখতে হবে, এটি হাদিসে নেই। বলতে পারেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) টেলিস্কোপ ব্যবহার করেননি, তাই আমরাও ব্যবহার করব না। তা বলতে পারেন, তবে সবক্ষেত্রে কি তা পারবেন?

রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম চশমা ব্যবহার করেননি, এখন আপনারা চশমা বাদ দেবেন? সূর্যাস্ত হলে ইফতার করতে হয়, রাসূলুল্লাহ (সা.) ঘড়ি ব্যবহার করেননি, আপনারা ঘড়ি বাদ দেবেন? সত্তর-আশি বছর পূর্বে বাংলাদেশের নানা এলাকায় এমন ঘটনা ঘটেছে যে, বর্ষাকালে সূর্যাস্ত হয়েছে মনে করে মানুষ ইফতার করে ফেলেছে, কিছুক্ষণ পর দেখা গেল আকাশে সূর্য। এখনো কি এমনই করবেন? সুবহে সাদিক দেখে কে সাহরি বন্ধ করে? ছায়া আসলি দেখে কে আসর সালাত আদায় করে?

সবখানে প্রযুক্তিবান্ধব, কেবল চাঁদ দেখায় প্রযুক্তির সাথে দুশমনি। আর কতভাবে বোঝানো লাগবে? আবারো বলছি, হাদিসে বলা হয়নি যে, খালি চোখেই চাঁদ দেখতে হবে। আমি প্রায় চল্লিশ বছর ধরে চাঁদ দেখি। পূর্বে যে আকারের চাঁদ খালি চোখে দেখা যেত এখন তা যায় না। কারণ পরিবেশ দূষণের কারণে দিগন্তের অপরিচ্ছন্নতা।

আমরা পরিবেশ দূষণ করে আকাশ ময়লাযুক্ত করব, আবার যন্ত্রসহায়তাও নেব না, এটাই কি হাদিসভিত্তিক কাজ? ভাই, বইয়ে লেখা না থাকলেও কি চশমা লেখা দেখাবে? আকাশে চাঁদ না থাকলে টেলিস্কোপ কি চাঁদ বানিয়ে দেখাবে।

কতভাবে আর বোঝানো যায়? এ জড়তা আমাদেরকে দুনিয়াবিচ্ছিন্ন ও হাস্যকর বানাচ্ছে, এটুকু বুঝার ক্ষমতা নেই? আমার পোস্ট কাউকে আক্রমণ করার জন্য নয়, বোঝানোর প্রচেষ্টা মাত্র। দয়া করে কোন ব্যক্তিকে বা কমিটিকে আক্রমণ করবেন না। আরেকটি বিষয় হলো আনন্দ উদযাপন দেশে সম্মিলিতভাবে করা উচিত।

লেখক: চেয়ারম্যান, আরবি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence