৫ দিনেই অনার্স এবং মাস্টার্স পাস!
- মুহাম্মদ আল্-হেলাল
- প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৩, ০২:৫১ PM , আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৩, ০২:৫১ PM
২০০৪ সাল, দুটি ভিন্ন ভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী আমি ও আমার এক ভাই। ঐ ভাইটা বেশ প্রাইভেট পড়ে রেগুলার। আমি ভাবি হয়তো ক্লাসের পড়া বুঝতে অসুবিধা হয় তাই একদিন বললাম আমি তো প্রাইভেট পড়িনা বা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষার্থীকেও প্রাইভেট পড়তে দেখিনা বা অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ প্রাইভেট পড়ে এমন কথা শুনিনি কখনো। কিন্ত তোমাকে তো দেখি রেগুলার এবং সিরিয়াসলি প্রাইভেট পড় এর কারণ কি? কারণ হিসেবে সেদিন সে আমাকে আরেকটি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেছিল আরে তুই জানিসনা জাতীয় বিশ্বদ্যিালয়ে ক্লাস হয়না? আসলেই আমি জানিনা যে এই বিশ্বদ্যিালয়ে ক্লাস হয়না। আমার মনে প্রশ্ন জাগল তাহলে এত শিক্ষক, শিক্ষয়িত্রী, কর্মকর্তা-কর্মচারি এত ভবন কি কাজের জন্য? উনারা কি শুধু বসে বসে গবেষণা করেন ওখানে? তাহলে সেই গবেষণার ফলাফল কৈ বা জাতীর ভাগ্য পরিবর্তনে কোথায় তাদের দৃশ্যমান অবদান অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্ষেত্রে খুব যে অবদান আছে তা কিন্তু নয় সময় সুযোগ পেলে অন্য কোন এক লেখায় সেটি তুলে ধরা যেতে পারে।
আমার এবং আমার ঐ ভাইয়ের শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে দুজনেই কর্মজীবনে ব্যাস্ত। ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসেছি আড্ডার এক পর্যায়ে শিক্ষাজীবনের কথা উঠলে সে বল্ল আমি তো আমার স্নাতক এবং স্নাতকত্তোর লেভেলের কোন টিচারদের চিনিনি কখনো। জানতে চাইলাম কিভাবে মাস্টার্স পাস করলে তাও আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত ঢাকা কলেজ থেকে? আমি আরো বললাম আমি শুনেছি যে তোমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস কম হয় তাই বলে তুমি তোমার নিজের বিভাগের টিচারদের চিননা! এক্ষেত্রে আমার বিভাগের আতাউর রহমান খান স্যারের কথা ভিন্ন মাস্টার্স এ পড়াকালীন তাঁর কাছে গেলে বলতেন তোমরা কোন বর্ষে পড় বা প্রথম বর্ষে নাকি? এর কারণও আছে তিনি ক্লাস করার সময়ে ক্লাসের শিক্ষার্থীদের মুখের দিকে তাকাতেননা। আমার ধারণা তিনি নিজেকে স্বজনপ্রীতি থেকে বাচিয়ে রাখতে এমনটি করতেন। আমার জানামতে তিনি বাংলাদেশে এবার্ডিন বিশ্বদ্যিালয় থেকে আন্তজার্তিক সম্পর্কের উপর প্রথম পিএইচডি। স্যার আবার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নজরুল-রবীন্দ্র পুষ্প উদ্যান করেছেন। তথ্যমতে যেখানে শুধু এমন ফুলগাছ পাওয়া যাবে বা লাগানো যাবে যেটি উক্ত কবিদ¦য় তাদের কোন না কোন লেখায় উল্লেখ করেছেন।
যাইহোক আমার ঐ ভাই আমাকে আরো অবাক করল যখন সে বলল অনার্স এবং মাস্টার্স পড়াকালে ৪/৫ বছরের মধ্যে সর্বসাকুল্যে ৪/৫ দিন কলেজে গিয়েছি তাও আবার প্রশাসনিক কাজে যেমন পরীক্ষার ফরম পূরণ বা প্রবেশপত্র সংগ্রহ ইত্যাদি। তার এই বক্তব্য আমাকে দারুনভাবে অবাক করেছে কিন্তু সে স্বাভাবিকভাবেই গল্প করছিল এবং বলছিল। আমার এই ভাই ছিল হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আমি তাকে ব্যতিক্রম মনে করেছিলাম। কিন্তু বিষয়টি আমার কাছে আরো বেশি আশ্চর্যজনক মনে হয় যখন আরেকজন ভাতিজা বলে একই কথা যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তিতুমির কলেজ, ঢাকা থেকে সমাজ বিজ্ঞানে মাস্টার্স পাশ করেছে। কথা প্রসঙ্গে একদিন তাকে বলছিলাম তুই গ্রামের এত মানুষ কিভাবে চিনিস আমিতো চিনিনা। সে বলল কাকা আপনি তো ঢাকা পড়াশুনা করেছেন এবং ঢাকা শহরেই থেকেছেন। আমি বললাম তুইও ঢাকা তিতুমির কলেজে পড়েছিস। তার উত্তর ছিল আমি ঢাকা তিতুমির কলেজে পড়েছি কিন্তু গ্রামেই থেকেছি পরীক্ষার সময় শুধু ঢাকা গিয়েছি আমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে তো ক্লাস হয়না কাকা।
তার এই উত্তর আমাকে অুসন্ধিৎসু করে তুলে ফলে আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত ঢাকা কলেজ থেকে অর্থনীতি, যশোর এম এম কলেজ থেকে সমাজ কল্যান, নড়াইল সরকারী ভিক্টোরিয়া কলেজ, সদ্য সরকারী লোহাগড়া কলেজ থেকে হিসাব বিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে অনার্স, মাস্টার্স সম্পন্ন করা বেশ কিছু শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে একই ধরনের জবাব পেয়েছি যাদের সম্বন্ধে আমি নিজেও জানি যে তাদের কলেজ এবং শ্রেনিকক্ষের সাথে বেশ একটা দুরত্ব সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল বা আছে।
তথ্যগুলো অবাক করার কারণে আমি বিপরীত পক্ষ থেকে একটু জানতে চাইলে ড. আব্দুর রাজ্জাক মিউনিসিপ্যাল কলেজ, যশোর এর ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সহকারি অধ্যাপক বেলাল থানী জানান ডিগ্রি(পাস) লেভেলে ক্লাসের সংখ্যা ০% তবে অনার্স লেভেলে ২/৫ টি ক্লাস হলেও হতে পারে।
তবে একই প্রশ্নের উত্তরে সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক আব্দুল আহাদ ভিন্নমত পোষণ করে বলেন সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ, সিলেটে এটা সম্ভব না। অন্য কোন উপজেলা কলেজে হতে পারে।
তাহলে কি আমাদের এই বৃহত্তম বিশ্বদ্যিালয়টি শুধুমাত্র কিছু মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে জন্মগ্রহন করেছে ১৯৯২ সালে? কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য কৃষি প্রকল্প গ্রহন, শিল্প কারখানা স্থাপন ইত্যাদি করা যেতে পারে। কিন্তু এই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে ক্লাসের সংস্পর্ষ, টিচারদের পরিচর্যা থেকে দূরে রেখে সম্পূর্ণ জাতীকে উচ্চ শিক্ষিত করার যে মহতী পরিকল্পনা সেটি কি সফল হচ্ছে আজ বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর পর মূল্যায়ণের যথেষ্ট সময় হয়েছে। বা গোটা জাতীকেই প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করা কি খুব প্রয়োজন সেটিও একটি প্রশ্ন?
একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের কয়েকটি রুম বন্ধ ছিল তার মধ্যে অন্যতম জাহাঙ্গীরগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মওলানা ভাসানী হলের একটি রুম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরে বাংলা হলের একটি রুম। শেরে বাংলা হলের এক আবাসিক শিক্ষার্থী একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা গেইট থেকে রিক্সায় করে হলে যাচ্ছিলেন পথিমধ্যে রিক্সা চালককে বললেন মামা আজ কাজলা গেইটের সিকিউরিটি কর্মী মামার হাত-পাগুলো দেখলাম উল্টাদিকে তখন রিক্সা চালক বললেন দেখেনতো মামা আমার হাত-পায়ের মত কিনা? তখন উক্ত শিক্ষার্থী দেখে ভয়ে একটি চিৎকার দিয়ে দৌঁড়ে হলের রুমমেইটকে একইভাবে বললেন জানিস আজ কাজলা গেইটের সিকিউরিটি মামার হাত-পাগুলো দেখলাম উল্টোদিকে আবার গেট থেকে যে রিক্সায় করে হলে আসলাম ঐ রিক্সা চালক মামার হাত-পাগুলোও একই রকম উল্টা দিকে ছিল। তখন রুমমেইট বললেন দেখতো বন্ধু আমার হাত-পা ঠিক আছে কিনা? তখন উক্ত শিক্ষার্থী দেখতে পেলেন তার রুমমেইটের হাত-পা ও একইরকম উল্টা তখন তার আর যাওয়ার জায়গা ছিলনা তিনি একটি চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারা হলেন। বিষয়টি হলো উক্ত শিক্ষার্থী দৃষ্টিভ্রম কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছিলেন।
এখন প্রশ্ন হলো আসলে সবকিছু কি ঠিক আছে না কি দৃষ্টিভ্রম কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে আমিই জ্ঞাণ হারা হয়েছি? সংশ্লিষ্ট মহলকে ভেবে দেখতে হবে প্রতিষ্ঠানটি কি এভাবেই চলবে?
যদি শ্রেণিকক্ষের সংস্পর্ষ ছাড়া, টিচারদের সরাসরি পরিচর্যা অনার্স/মাস্টাসের্র মত সার্টিফিকেট পাওয়া যায় তাহলে আমাদের সরকার বিশ্বের নামী/দামী বিশ্ববিদ্যালয় যেমন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বা ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে কি গোটা জাতীকে উচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারেনা?
লেখক: এমফিল গবেষক (এবিডি)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল: alhelaljudu@gmail.com