যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্যের ইতি ও বহুকেন্দ্রীক নয়া বিশ্বব্যবস্থা

মো: তারেক হোসেন
মো: তারেক হোসেন  © সংগৃহীত

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন পলিসি ছিল ইউরোপীয় কিংবা বিশ্ব রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে রাখা। যুক্তরাষ্ট্রের নিজেকে গুটিয়ে রাখার এই নীতি ‘মনরো ডকট্রিন’ নামে পরিচিত। এই নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমেরিকা অর্থনৈতিক, সামরিক ও প্রযুক্তির দিক দিয়ে অভাবনীয় উন্নতি লাভ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর অনেক আগেই ১৮৯৮ সালে কিউবাকে কেন্দ্র করে আমেরিকা ও স্পেনের মধ্যে যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এই যুদ্ধে জয়ের মাধ্যমে আমেরিকা স্পেনের অধীনে থাকা এশিয়া ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের কিউবা, গুয়াম, পুয়ের্তরিকো ও ফিলিপাইন দখল করে নেয়। এর দুয়েক বছর পরই হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ ও পানামা খাল নিয়ন্ত্রণে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। নিজ ভূখণ্ডের বাইরে এসব অঞ্চলের দখল আমেরিকাকে পরাশক্তি হতে সহায়তা করে।  

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৯১৮) যুক্তরাষ্ট্রের অংশ গ্রহণের ফলে যুদ্ধের গতিবিধি পাল্টে যেতে থাকে। এই যুদ্ধে মিত্র শক্তির জয়ের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয় বাড়তে থাকে। পরাশক্তি হিসেবে তার প্রভাব আরো বিস্তার লাভ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। যুদ্ধোত্তর  আমেরিকার এই সুপার পাওয়ারে পরিণত হওয়ার পিছনে প্রধান ভূমিকা পালন করে তারই নেতৃত্বে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা, ব্রেটন উডস চুক্তির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের সূচনা যার ফলে স্বর্ণের পরিবর্তে ইউএস ডলারকে রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে গ্রহণ এবং ন্যাটোর মতো সামরিক জোট গঠন ইত্যাদি। আর এই ন্যাটো জোট গঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার মিত্র অপর পরাশক্তি  সোভিয়েত ইউনিয়নকে পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্র বিস্তারে বাধা দেওয়া।

দুই পরাশক্তির এই আদর্শিক দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতিতে সূচনা হয় স্নায়ু যুদ্ধের। যার সমাপ্তি ঘটে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্যে দিয়ে। যার দরুন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে একক হেজিমন বা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ লাভ করে। ফ্রান্সিস ফুকায়ামা যেটিকে ইতিহাসের সমাপ্তি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। সেখানে তিনি দেখাতে চেয়েছেন সোভিয়েতের ইউনিয়নের সমাজতন্ত্র পতনের মাধ্যমে সকল মতাদর্শের উপর পশ্চিমা লিবারেলিজম বা উদারনীতি বিজয় লাভ করেছে। আর আমেরিকা এই লিবারেল ডেমোক্রেসিকে হাতিয়ার বানিয়ে বিশ্বজুড়ে আধিপত্য বিস্তার অব্যাহত রেখেছে।

স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত ইউনিয়নই ছিল আমেরিকার একমাত্র বিরোধী শক্তি। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সোভিয়েত রাশিয়া অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু একুশ শতকের শুরু থেকে পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়া আবারও অন্যতম পরাশক্তির দাবিদার হয়ে উঠে।।

অপরদিকে চীন ইতোমধ্যে উদীয়মান পরাশক্তি হিসেবে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছে। এক্ষেত্রে চীন তার প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে তার ইকোনমিকে। চীন চায় বিভিন্ন দেশের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে নিজের প্রভাব বলয় বাড়াতে। এক্ষেত্রে চীন তৃতীয় বিশ্বের দেশ সমূহে কিংবা আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রে অবকাঠামোগত উন্নয়ন কর্মকান্ডে বিনিয়োগের মাধ্যমে বশে আনার চেষ্টা করছে।

চীনের অনুসৃত এই কৌশলটিকেই বলা হচ্ছে ‘চেকবুক ডিপ্লোমেসি’। বৈশ্বিক যোগাযোগ বৃদ্ধি, বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিজের নেতৃত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং হাতে নিয়েছে মেগা প্রজেক্ট বিআরআই (বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ)। এছাড়াও বিশ্ব রাজনীতিতে চীন আগের চেয়ে অনেক তৎপর। সৌদি-ইরান সম্পর্ক স্থাপনে মধ্যস্থতা ও রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ১২ দফা শান্তি প্রস্তাব ইত্যাদি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। 

চীনের এই উত্থানকে আমেরিকা মোটেই ভালো চোখে দেখছে না বরং, নিজের আধিপত্যের উপর হুমকি মনে করছে। চীনের এই ক্রমবর্ধমান উন্নতি কিভাবে থামানো যায় সেটিই তার প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্যই  ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল ঘিরে আমেরিকার এতো আগ্রহ। এই অঞ্চলে চীনের আধিপত্য রোধে জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতকে সাথে নিয়ে চতুর্দেশীয় নিরাপত্তা বলয় “কোয়াড”-এ (কোয়াড্রিলেটেরাল সিকিউরিটি ডায়লগ) নেতৃত্ব দিচ্ছে আমেরিকা। ভেটেরান জো বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের পর আমেরিকার ফরেন পলিসিতে অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের চোখ এখন মধ্যপ্রাচ্যের পরিবর্তে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে ঘিরে।

জো বাইডেনের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে গঠিত সামরিক জোট ‘অকাস'-এর উদ্দেশ্যও এ অঞ্চলে চীনের আধিপত্য রোধ করা। এছাড়াও দক্ষিণ চীন সাগরে জাপানসহ অন্যান্য মিত্রদের সাথে নিয়ে যৌথ সামরিক মহড়া বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্য দিকে রাশিয়াকে সাথে নিয়ে চীনও পাল্টা সামরিক মহড়া চালায় জাপান সাগরে। চীন-আমেরিকার এই প্রতিযোগিতা অনেক সময় কথার লড়াই ছাড়িয়ে অর্থনৈতিক স্যাংশনে রূপ নিয়েছে। আমেরিকা ও চীনের এই অঘোষিত যুদ্ধকে অনেকে ‘নিউ কোল্ড ওয়ার’ বলে অবহিত করছেন। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুই পরাশক্তি আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার শুরু হওয়া স্নায়ু যুদ্ধকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল দ্বিমেরুর বিশ্বব্যবস্থা। আমেরিকার পুঁজিবাদ ও লিবারেলিজমের বিপরীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতন্ত্রের আদর্শিক এই শীতল যুদ্ধ চলে বিংশ শতাব্দীর শেষ দশক পর্যন্ত। সেসময় রাষ্ট্রসমূহ এই দুই ব্লকে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে পরাশক্তি হিসেবে আমেরিকার আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী রইল না। যার ফলে ঐ সময়ে বিশ্ব জুড়ে গড়ে উঠে আমেরিকার একচ্ছত্র আধিপত্য বা ইউনিপোলার বিশ্বব্যবস্থা। তাদের ভাষ্যে তিন দশক তারা এই একক নেতৃত্ব দিয়েছে যদিও তা আর সম্ভবপর নয়।

আমেরিকার সামনে এখন চীন, রাশিয়া এমনকি গ্লোবাল সাউথ নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। গ্লোবাল সাউথের উদীয়মান অর্থনীতির দেশ ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল কিংবা সৌদি আরবের মতো দেশগুলো আর যুক্তরাষ্ট্রকে বিনা বাক্যে প্রভু হিসেবে মেনে নিতে রাজি না। চলমান রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধেই তা প্রতীয়মান হয়। তারা ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনকে অন্যায় মনে করে। তাই বলে তারা রাশিয়াকে একঘরে করার পশ্চিমা সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি বরং যথাসম্ভব নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করছে।

যুক্তরাষ্ট্রও যে মানবাধিকার কিংবা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান ও ভিয়েতনামের মতো দেশে সহিংসতা চালিয়েছে তা তাদের অজানা নয়। এছাড়াও উত্তর কোরিয়া ও ইরানের মতো দেশও আমেরিকার জন্য অন্যতম কনসার্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে কোভিড-১৯ প্রতিরোধ, আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার ও অর্থনৈতিক সংকট কিছুটা হলেও যুক্তরাষ্ট্রকে ভাবাতে শুরু করেছে। কাজেই বিশ্ব এখন আর যুক্তরাষ্ট্রের একক নেতৃত্বাধীন বা ইউনিপোলার নয়। 

আবার অনেকে মনে করছেন চীন-রাশিয়া বনাম পশ্চিমা জোট মিলে স্নায়ু যুদ্ধের সময়ের ন্যায় আবারও বাইপোলার বা দ্বিকেন্দ্রীক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠবে। তবে তার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে কেননা আজকের বিশ্ব স্নায়ু যুদ্ধের সময়ের সঙ্গে তুলনীয় নয়। বর্তমান বিশ্ব প্রযুক্তি, বাণিজ্য, অভিবাসন এবং ইন্টারনেট ইত্যাদি কারণে আগের চেয়ে অধিক পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। যা বিশ্বকে দুই ব্লকে বিভক্ত হতে নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি মাল্টিপোলার বা বহুকেন্দ্রীক বিশ্বব্যবস্থার দিকে উৎসাহিত করবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence