দ্রব্যমূল্য অসহনীয়, মন্ত্রী বলছেন ‘অপেক্ষা করুন’

দ্রব্যমূল্য অসহনীয়, মন্ত্রী বলছেন ‘অপেক্ষা করুন’
দ্রব্যমূল্য অসহনীয়, মন্ত্রী বলছেন ‘অপেক্ষা করুন’  © ফাইল ছবি

দিন দিন জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে, বাড়ছে না আয়। সংসারের খরচ সামাল দিতে অনেকেই হিমশিম খাচ্ছেন। মন্ত্রী বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

একটি বেসরকারী ব্যাংকের কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। সিনিয়র অফিসার পদে চাকরি করে মাস শেষে কেটেকুটে বেতন পান ৬০ হাজার টাকা। ১৮ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া দেন। বিদ্যুৎ বিলসহ বাসার খরচ এসে দাঁড়ায় ২০ হাজারের মতো। প্রতিমাসে গ্রামের বাড়িতে থাকা বয়স্ক বাবা-মায়ের খরচ বাবদ দেন ১০ হাজার টাকা। দুইটা বাচ্চা আর স্ত্রীকে নিয়ে তার সংসার।

এই চারজন মানুষের খাওয়ার খরচ কোনভাবেই ১৮ হাজার টাকার কমে হয় না। নিজের অফিসে আসা-যাওয়া খরচ ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। বাকী ৪ থেকে ৫ হাজার টাকার মধ্যে নিজেদের মোবাইল খরচ, চিকিৎসা, ইন্টারনেট, ডিশ কানেকশন, পোশাক, বাচ্চাদের খেলনাসহ আরও অনেক কিছুই আছে। এর বাইরে আত্মীয়-স্বজন কেউ বাসায় এলে শুধু খাওয়ার খরচই অনেক টাকা বেড়ে যায়। শুক্রবার মিরপুরের শেওড়াপাড়া কাঁচাবাজারে কথা হচ্ছিল এই ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে।

রফিকুল বলেন, ‘‘খরচের যে হিসাব আপনাকে বললাম, এর মধ্যে কী বাদ দেব? ফলে খাওয়ার খরচই কমাতে হয়। কিন্তু এখন জিনিসপত্রের যে দাম তাতে তিন বেলা ডাল-ভাত খাওয়াও কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। এখন আমি নিম্নবিত্ত না মধ্যবিত্ত কিছুই বুঝতে পারছি না। তারপরও অফিস থেকে ফেরার পথে কখনও টিসিবির ট্রাক সামনে পেলে তেল আর ডাল কিনে নিয়ে আসি। আবার সহকর্মী বা আত্মীয় স্বজনের কেউ যদি দেখে ফেলে টিসিবির ট্রাকে লাইন ধরে দাঁড়িয়েছি, সেটাও তো লজ্জার। এখন আসলে আমাদের সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকাই কঠিন।’’

এতো গেল একজন ব্যাংক কর্মকর্তার গল্প। যিনি বেতন পান ৬০ হাজার টাকা। এই বেতন তো এখন অনেক! এর থেকে কম বেতন পান বহু মানুষ, যাদের এখনও আমরা মধ্যবিত্ত বলছি। বছরের শুরু থেকে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়তে শুরু করে। এখন যে পর্যায়ে ঠেকেছে তাতে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে বললে ভুল হবে না। ঠিক দেড় মাস পরেই শুরু হবে রোজা। ফলে তখন পরিস্থিতি কী হবে সেটা ভাবাও কঠিন। দিন চলতে হিমশিম খাচ্ছেন মানুষ।

সরকারি বিপণন সংস্থা (টিসিবি) প্রতিদিন প্রকাশ করে বাজারদরের তালিকা। শুক্রবার পণ্যের তালিকা ঘেঁটে দেখা গেল, এক সপ্তাহের ব্যবধানে ২০টি পণ্যের মধ্যে ১৮টির দামই বেড়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে চাল, আটা, ময়দা, সয়াবিন তেল, পাম তেল, পেঁয়াজ, মুরগি, গরুর মাংস, খাসির মাংস, চিনি, ডিম, জিরা ইত্যাদি। চার দিন আগে পেঁয়াজের দাম ছিল ৩০ টাকা।

শুক্রবার সেটা বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি ৫০ টাকা। ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি বোতলজাত সয়াবিনের লিটারে আট টাকা বাড়িয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাজারে এক লিটারের বোতল বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়। কয়েক মাস স্থির থাকার পর আবার বেড়েছে চিনির দাম। এক সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি হয়েছিল ৭৫ থেকে ৭৬ টাকা। এখন সেটা ৮০-৮২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ডিমের ডজন এখন ১১০ টাকা।

অসহনীয় হয়ে উঠা ভোগ্যপণ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে এখানে তো বাড়বেই। খোঁজ নিয়ে দেখেন এক বছর আগে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কত ছিল, আর এখন কত? ব্যবসায়িরা তো আর বেশি টাকা দিয়ে পণ্য কিনে কম টাকায় বিক্রি করবে না। এখন আমাদের আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমার অপেক্ষা করতে হবে। পাশাপাশি আমরা টিসিবির মাধ্যমে এক কোটি মানুষকে পণ্য দেওয়ার চেষ্টা করছি। সেটা দেওয়া গেলেও অন্তত ৫ কোটি মানুষ কম মূল্যে পণ্য পাবেন।’’

আরও পড়ুন: কান্না না থামায় যমজ শিশুদের হত্যা করে পুকুরে ফেলে দেন মা

আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়লে দেশের বাজারেও কিছু পণ্যের দাম বাড়বে, এটা সত্যি। কিন্তু যে পণ্য দেশে উৎপাদন হয়, বাজারে কোন ঘাটতি নেই সেটার দাম কেন বাড়বে? কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ধান উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে তিন কোটি ৯৫ লাখ টন। আমন ও আউশ মৌসুমে ফলন হয়েছে ভালো। বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে আমদানিও করা হয়েছে চাল।

খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, চালের মজুতও রয়েছে রেকর্ড পরিমাণে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চালের মজুত ছিল ১৭ লাখ ১৫ হাজার মেট্রিকটন। এরপরও দামে কেন বাড়ছে? বাজারে মোটা চালের দাম এখন ৫০ টাকা। প্রতি কেজি মিনেকেট চাল ৬৪-৬৫ এবং নাজিরশাইল ৭০-৭২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

জাতিসংঘ উন্নয়ন প্রোগ্রাম বা ইউএনডিপি বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনোমিস্ট অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘‘আমাদের তো চালের উৎপাদন ভালো হয়েছে, তাহলে তো চালের দাম বাড়ার কথা না। তেলের দাম না হয় বুঝলাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে বেড়েছে? আসলে আমাদের ৫০-৬০টি চালকল এত বড় তারাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এটাকে আমি সিন্ডিকেট বলব না।

তিনি বলেন, ধানের বড় একটা অংশ তারা ভাঙায়, ফলে তারা যে দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে সেটাতেই বিক্রি হচ্ছে। এখানে সরকারকে ভুমিকা রাখতে হবে। কতিপয় মানুষের কাছে বাজারের নিয়ন্ত্রণ চলে গেলে তারা তো মুনাফা করতে চাইবেই। পাশাপাশি তেলে দাম বৃদ্ধির কারণে পরিবহন খরচও বেড়ে গেছে।'

এমন পরিস্থিতিতে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় শুরু হচ্ছে রমজান মাস। রোজায় পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে সরকার আগে থেকেই নড়েচড়ে বসেছে। তাই দেড় মাস আগেই ১২ সংস্থাকে মাঠে নামানো হচ্ছে। সরকারের এই সংস্থাগুলো আমদানি থেকে শুরু করে খুচরা, পাইকারি বাজার ও পণ্য পরিবহন এই চার স্তরে নজরদারি করবে, যাতে রমজানকে পুঁজি করে কেউ অতি মুনাফা করে ভোক্তাকে ঠকাতে না পারে।

এ সময় কোনো ধরনের অনিয়ম পেলে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির আওতায় আনার কথাও বলা হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল, শিল্প মন্ত্রণালয়, র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, টিসিবি, কৃষি বিপণন অধিদফতর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বিএসটিআই, সিটি করপোরেশন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর মনিটরিং টিম বাজার তদারকি করবে।

পাশাপাশি এই কার্যক্রমে জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্জন, মৎস্য কর্মকর্তা, পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি, স্যানিটারি ইন্সপেক্টর, শিল্প ও বণিক সমিতির প্রতিনিধি এবং ক্যাবের সদস্যরা সহায়তা করবে।

‘‘নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের গা দেয়ালে ঠেকে গেছে। কিন্তু সরকার শুধু তার পেটুক বাহিনীর চিন্তা করছে। দরিদ্র মানুষের ব্যাথা বুঝতে পারছে না।'' এমন মন্তব্য করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম।

শুক্রবার বাদ জুমা বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের উত্তর গেটে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, আমি নিজে দেখেছি, খাবারের অভাবে মানুষ বাজারে ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিনতে পারছে না। খালি ব্যাগ নিয়ে ফিরছে। কারণ তাদের কেনার সামর্থ্য নেই। এগুলো এখন সরকার দেখে না। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দাম সমন্বয়ের কথা বলে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। কিন্তু বাইরে কমার পরে তখন আর দেশে কমে না। কেরোসিনের দাম এখন আন্তর্জাতিক বাজারে কম, তাহলে কেন দেশে কমাচ্ছেন না!

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘‘সবার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। যারা বাজারে গিয়ে নিজেদের অসহায় মনে করে, তাদের সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। নতুবা সরকার শুনবে না। আমরা তো প্রতিদিনই এগুলো নিয়ে চিৎকার করছি, কিন্তু কেউ আমাদের কথা শুনছে না। জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কয়দিন পর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দাবি তুলবেন তাদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর জন্য। সরকার হয়তো তাই-ই করবে। সাধারণ মানুষের তো আয় বাড়ছে না। কষ্টটা তাদেরই বেশি হবে। সে জন্য নিত্যপণ্যের বাজারে এখনই লাগাম টানতে হবে। সরকার চাইলেই টিসিবির পরিধিও আরও বাড়াতে পারে, কিন্তু সেটাও তারা করছে না।’’

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী নতুন বছরের শুরু থেকেই নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন। গত জানুয়ারিতে খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার হয়েছে ৫ দশমিক ৬০ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বরে যা ছিল ৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ।

টিসিবির মুখপাত্র হমায়ুন কবির বলেছেন, বাজারের তুলনায় টিসিবির পণ্যের মান ভালো। দামের পাশাপাশি এ কারণেও লাইন বড় হচ্ছে। আবার এই সুযোগে একটি চক্র একাধিকবার লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য নিয়ে যাচ্ছে। তারা আবার সেসব খোলা বাজারে বিক্রি করছে বলে অভিযোগ পাচ্ছি। এসব প্রতারকদের ঠেকাতে বাড়তি জনবল টিসিবির নেই। সারাদেশে ৪৫০টি পয়েন্টে এখন ট্রাকে করে টিসিবির পণ্য বিক্রি হচ্ছে। শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহে প্রতিদিন প্রতিটি ট্রাকে দিনে ৬০০ লিটার তেল, ৪০০ কেজি ডাল, ৫০০ কেজি চিনি ও ৫০০ কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। [সূত্র: ডয়চে ভেলে বাংলা]


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence