বিল পরিশোধের ছয় বছরেও মালামাল বুঝে পায়নি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৪৫ PM , আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ০১:২৫ PM
মালামাল বুঝিয়ে না দিয়েই পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর থেকে চুক্তির পুরো টাকা তুলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অধিদপ্তরের পরিচালক (এমআইএস) মো. তসলিম উদ্দিন খান এবং প্রাক্তন পরিচালক (এমআইএস) মো. শাহাদাত হোসাইনের যোগসাজশে এমন অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিষ্ঠানটি চুক্তিমূল্য ১ কোটি ৭৭ লাখ ৯৯ হাজার ৯১০ টাকা পরিশোধ করা হলেও কোনো মালামাল বুঝে পায়নি। এ ছাড়া অন্য একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ২ কোটিরও বেশি অর্থে সম্পূর্ণ মালামালও এখনও বুঝে পায়নি অধিদপ্তর।
অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ‘পরিবার কল্যাণ সহকারী রেজিস্টার (৯ম সংস্করণ), সাপ্লিমেন্টারি রেজিস্টার ও বিভিন্ন ধরনের এমআইএস ফরম’ সরবরাহের জন্য নিপুন প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি হয় পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের। ২০১৮ সালের ৬ জুন এ চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার ছয় দিনের মাথায় অর্থাৎ ৩০ জুন পুরো টাকা পরিশোধ করা হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটিকে।
এ অনিয়মের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠিয়েছি। তাতে যাদের বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে—মো. সাইফুল্লাহিল আজম, মহাপরিচালক, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর।
চুক্তি অনুযায়ী, আট সপ্তাহের মধ্যে পুরো মালামাল সরবরাহ করার কথা ছিল। নিয়ম অনুযায়ী মালামাল বুঝিয়ে দেওয়ার পরই পুরো অর্থ পরিশোধের কথা; কিন্তু তা না করেই বিলের সব টাকা পেয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিপুন প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব বরাবর একটি অভিযোগও করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (এমআইএস) মো. তসলিম উদ্দিন খান ও সাবেক পরিচালক (এমআইএস) মো. শাহাদাত হোসাইনের দুর্নীতিতে এমন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী ৮ সপ্তাহের মধ্যে সব মালামাল দেওয়ার কথা থাকলেও তা গ্রহণ না করেই মো. তসলিম উদ্দিন খান মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে মালামাল বুঝে পাওয়ার প্রত্যয়ন এবং এতে সমুদয় বিল পরিশোধ করেন।
আরও পড়ুন: প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে ৩০ কোটিরও বেশি অর্থ আত্মসাৎ বহিষ্কৃতদের
নিপুন প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে কাজটি পেতে সহযোগিতা করার অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির উপকরণ ও সরবরাহ ইউনিটের তৎকালীন উপপরিচালক (বৈদেশিক সংগ্রহ) মো. শাহাদাত হোসাইন এবং পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (সংযুক্ত-উপকরণ ও সরবরাহ ইউনিট) মো. রফিকুল ইসলাম। তখন শাহাদাত হোসাইন দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি ও রফিকুল ইসলাম দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন। এতে সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়ার পরও ইন্টার-গ্রাফিক লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, নিপুন প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সঙ্গে ২০১৮ সালের ৬ জুন চুক্তি করে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। চুক্তির শর্তমতে, পরিবার কল্যাণ সহকারী রেজিস্টার (৯ম সংস্করণ) ৩০ লাখ ১০ হাজার কপি সাপ্লিমেন্টারি রেজিস্টার এবং ৪৯ লাখ ৯৯ হাজার ৮৭২ কপি বিভিন্ন ধরনের এমআইএস ফরম সরবরাহ করার কথা ছিল। চুক্তিতে প্রতিষ্ঠানটিকে এসব মালামাল বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য আট সপ্তাহের সময়সীমা উল্লেখ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: এবারও শিক্ষায় বরাদ্দকৃত বাজেটের বড় অংশই অব্যবহৃত থাকবে
এরপর চুক্তির ছয় দিনের মাথায় সম্পূর্ণ অর্থ পরিশোধ করা হয় নিপুন প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে। কিন্তু ছয় বছরের বেশি সময় পার হলেও চুক্তিভুক্ত মালামালগুলো বুঝে পায়নি অধিদপ্তর। আর এই অর্থ বুঝে পেতে প্রত্যয়ন দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে মো. তসলিম উদ্দিন খানের বিরুদ্ধে।
অন্যদিকে নিপুন প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কাছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর এখনও ৪ হাজার ৫০০ কপি পরিবার কল্যাণ সহকারী রেজিস্টার (৯ম সংস্করণ), ২ হাজার ৫০০ কপি সাপ্লিমেন্টারি রেজিস্টার এবং ৩৯ লাখ বিভিন্ন ধরনের এমআইএস ফরম পাওনা রয়েছে। এ ছাড়া রেজিস্ট্রারসহ এসব প্রয়োজনীয় মালামাল না পাওয়ায় তখন মাঠপর্যায়ের কাজে চরমভাবে সংকটে পড়েন প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা।
আরও পড়ুন: ৪০ লাখ টাকায় রেজিস্ট্রার নিয়োগের অভিযোগ ইসলামি আরবির ভিসির বিরুদ্ধে
এ ছাড়া আওয়ামী সরকারের সময় দলটির বিভিন্ন শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের পরিচয়ে প্রভাব বিস্তার করা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তৎকালীন এই পরিচালকের (ড্রাগস এন্ড স্টোরস) বিরুদ্ধে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে আরেকটি প্রত্যয়ন প্রদানেরও অভিযোগ উঠেছে। এসএইচ সার্জিক্যাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে এসব অটোক্লেভ মেশিন কিনতে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের খরচ হয় ২ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
এর মধ্যে মাত্র ৭০টি মেশিন পাওয়ার পরই প্রতিষ্ঠানটিকে সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এতেও সহায়তা করেন তসলিম উদ্দিন খান। ফলে টাকা পরিশোধ করা হলেও অদ্যাবধি বাকি মেশিনগুলো বুঝে পায়নি প্রতিষ্ঠানটি।
আরও পড়ুন: ফাঁস হওয়া প্রশ্নে দেশে দেড় হাজার ডাক্তার
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং কেন্দ্রীয় পণ্যাগারের এক কর্মকর্তা অভিযোগগুলোর সত্যতা স্বীকার করেছেন। তারা জানিয়েছেন, দায়িত্ব পালনকালে অভিযোগ ওঠা কর্মকর্তারা অনেক বেশি প্রভাবশালী ছিলেন। তাদের এসব অনিয়মের বিষয়ে সবাই জানলেও তাদের বিরুদ্ধে বলার সাহস হয়নি কারোর। সে জন্য তসলিম উদ্দিন খানের ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত অতিরিক্ত পরিচালকের (ড্রাগস এন্ড স্টোরস) দায়িত্বকালীন কার্যবিধি তদন্তের দাবিও করেন তারা।
অভিযোগগুলোর বিষয়ে জানতে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (এমআইএস) মো. তসলিম উদ্দিন খান এবং উপকরণ ও সরবরাহ ইউনিটের তৎকালীন উপপরিচালক (বৈদেশিক সংগ্রহ) মো. শাহাদাত হোসাইনের সঙ্গে একাধিকবার বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করেও তাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
তবে বিষয়টি নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. সাইফুল্লাহিল আজম। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘এ অনিয়মের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠিয়েছি। তাতে যাদের বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধও করা হয়েছে।’