চিকিৎসার টাকা নেই, কিস্তি শোধের চিন্তায় ঘুম নেই দ্বীন মোহাম্মদের

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন

 বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত দ্বীন মোহাম্মদ
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত দ্বীন মোহাম্মদ  © টিডিসি ফটো

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হন অটো রিকশাচালক দ্বীন মোহাম্মদ। এখনও তার চোখের ভেতর ছররা বুলেট আছে ৩টি, মাথায় ১টি, কানের গোড়ায় ১টি, পেটে ৪টি, বাম হাতে ৩টি এবং কাঁধে ১টি। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে নিজের সহায় সম্বল বিক্রি করেছেন। একদম নিঃস্ব হয়ে গেছেন। তাতেও পুরোপুরি সুস্থ্য হননি। বাধ্য হয়ে চিকিৎসার জন্য এনজিও থেকে কিস্তিতে নিয়েছেন ৫০ হাজার টাকা। প্রতি সপ্তাহে সেই কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে হয়। সাপ্তাহিক কিস্তি দিতে না পারায় হেনস্তার শিকার হয়েছেন। কীভাবে চিকিৎসা করবেন, কীভাবে সংসার চালাবেন, কিস্তির টাকা শোধ করবেন— চিন্তায় ঘুম নেই দ্বীন মোহাম্মদের।

হতভাগ্য দ্বীন মোহাম্মদের বাড়ি কক্সবাজার সদরের পশ্চিম পাহাড়তুলিতে। বয়স তার পঁয়ত্রিশ ছুঁইছুঁই। দুই সন্তান, স্বামী-স্ত্রী মিলিয়ে চারজনের সংসার। নিজের অর্থসম্পদ বলতে ছিল দুটি ছাগল, একটা ব্যাটারিচালিত অটো রিকশা। হাতে ছিল কিছু নগদ টাকা। এখন কিছুই নেই। দুই সন্তানের একজন গুরুতর অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য সন্তানকে ডাক্তার কিংবা হাসপাতালে নেওয়ার সামর্থ্যও নেই। সম্প্রতি ঝড়ের কবলে পড়ে মাথা গোঁজার ঘরটাও ভেঙে গেছে তার। এখন আর থাকার জায়গাটুকু নেই দ্বীন মোহাম্মদের। 

দ্বীন মোহাম্মদ গত ৪ অক্টোবর থেকে রাজধানীর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি আছেন। সেখানেই তার সঙ্গে কথা হয়। কাতর কণ্ঠে তিনি জানান, ইতোমধ্যে চিকিৎসা এবং আনুষঙ্গিক ব্যয় মেটাতে ধার করেছেন প্রায় এক লাখ টাকা। এ ছাড়াও চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে একটা এনজিও থেকে কিস্তিতে নিয়েছেন ৫০ হাজার টাকা। প্রতি সপ্তাহে সেই কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে না পারায় সেখানেও হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে তাকে।

আরও পড়ুন: আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা নিয়ে সরকারের দীর্ঘসূত্রিতা কেন, জানতে চান সারজিস

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ১৮ জুলাই পুলিশের গুলিতে মারাত্মক আহত হন দ্বীন মোহাম্মদ। চোখের ভেতর বুলেট থাকায় কক্সবাজার থেকে চিকিৎসকেরা তাকে চট্টগ্রাম কিংবা ঢাকায় যাওয়ার পরামর্শ দেন। তবে টাকা না থাকায় তিনি প্রথমে চট্টগ্রামে আসতে পারেননি। পরে বাড়ি গিয়ে নিজের পালিত দুটি ছাগল বিক্রি করে প্রথমে চট্টগ্রামে আসেন।

দ্বীন মোহাম্মদ জানান, ছাগল বিক্রির পর চট্টগ্রামে ১০ দিন চিকিৎসা নিলে আবারও টাকা শেষ হয়ে যায়। এদিকে দুটি ছাগলের যে বাজার মূল্য ছিল. সেটাও তিনি পাননি। বরং নিজের চিকিৎসা ভার বহন করতে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন। তিনি বলেন, ‘আমার একেকটি ছাগলের বাজার মূল্য অন্তত ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা ছিল। কিন্তু বাধ্য হয়ে দুটি ছাগল ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিই।’

২২ জুলাই চট্টগ্রাম মেডিকেলে এসে ভর্তি হন, সেখানে ১০ দিন চিকিৎসা শেষে আবার বাড়ি ফিরে যান দ্বীন মোহাম্মদ। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামে এক পয়সাও ছাড় দেননি ডাক্তররা। বরং শেখ হাসিনার সরকারের পতনের আগে সেই সময়ে ১০ দিন চিকিৎসা নিতে গিয়ে পুলিশি হেনস্তা এবং নানা রকম বঞ্চনার মুখে পড়েছি।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ১৮ জুলাই পুলিশের গুলিতে মারাত্মক আহত হন দ্বীন মোহাম্মদ। চোখের ভেতর বুলেট থাকায় কক্সবাজার থেকে চিকিৎসকেরা তাকে চট্টগ্রাম কিংবা ঢাকায় যাওয়ার পরামর্শ দেন। তবে টাকা না থাকায় তিনি প্রথমে চট্টগ্রামে আসতে পারেননি। পরে বাড়ি গিয়ে নিজের পালিত দুটি ছাগল বিক্রি করে প্রথমে চট্টগ্রামে আসেন।

দ্বীন মোহাম্মদ বলেন, ‘অসুস্থ শরীর নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসতে আমাকে ৬টি গাড়ি পরিবর্তন করতে হয়। একটা অ্যাম্বুলেন্স নিতে চাইলে সেটাও পাইনি। তখন কারফিউ থাকায় কোন গাড়ি চলাচল করছিল না। একটা অ্যাম্বুলেন্স নিতে চাইলে ৮ হাজার টাকা দাবি করে। পরে বাধ্য হয়ে বিভিন্ন গাড়ি পরিবর্তন করে আসি।’ 

চিকিৎসকের বরাত দিয়ে তিনি জানান, এখনও তার চোখের ভেতর ছররা বুলেট রয়েছে ৩টি, মাথায় ১টি, কানের গোড়ায় ১টি, পেটে ৪টি, বাম হাতে ৩টি এবং কাধে ১টি। বুলেটের যন্ত্রণার কথা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘মনে হয় মাথার মগজটা লাফাতে থাকে। এখানে ডাক্তাররা যেটুকু পেরেছেন চিকিৎসা করেছেন। কিন্তু বুলেটগুলো বের হয়নি। হাঁটতে গেলে মাথার উপর হাত দিয়ে চেপে ধরে হাঁটতে হয়। এটা অসহ্য যন্ত্রণার, আপনাকে মুখে বলে বোঝাতে পারব না।’ 

আরও পড়ুন: ‘হাসিনার পতনে সব যন্ত্রণা ভুলে গেছি’

আন্দোলনে আহত হয়ে আংশিক চিকিৎসাশেষে গত জুলাইয়ের শেষে যখন দ্বীন মোহাম্মদ বাসায় ফেরেন তখন কিস্তিতে নেয়া ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার কিস্তি পরিশোধ করতে পারছিলেন না। তখন সেই অটো রিকশাটাও ফেরত নিয়ে যান মালিক। জীবিকা নির্বাহের শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে এখন পথে বসেছেন তিনি।

আহত ও ব্যথিত এ যোদ্ধা বলেন, ‘শুনেছি অনেকে আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। বিভিন্ন এনজিও কিংবা সমন্বয়করা অনেককে সহযোগিতা করেছেন বলে জেনেছি। কিন্তু এ পর্যন্ত আমার কাছে কেউ সাহায্য নিয়ে আসেনি। আমার খোঁজও কেউ নেয়নি। সবাই আসে, তালিকা করে। কিন্তু আমার এই মুহূর্তে যেই সাপোর্টটা দরকার, পরিবার চালানোর মতো সহযোগিতা কেউ দেয়নি। অনেকের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি, কিন্তু কোন সাড়া পাইনি।’

আমার যা কিছু ছিল তাই দিয়ে সংসার চলে যেতো। অথচ আহত হয়ে হাসপাতালে থাকায় এ সময়ে উল্টো লাখ টাকার ঋণের বোঝা মাথায় চেপেছে। সাথে দিনের পর দিন অসহ্য শারীরিক যন্ত্রণা সয়ে যাচ্ছি। উপদেষ্টারা আমাদের জীবনের বিনিময়ে চেয়ার পেয়েছেন, কিন্তু আমরা কি শুধু যন্ত্রণাই সয়ে যাব? সবই তো হারিয়েছি, এখন শুধু সুস্থভাবে বেঁচে থাকার আকুতি করছি — দ্বীন মোহাম্মদ

দ্বীন মোহাম্মদ জানান, গত ৪ অক্টোবর থেকে তিনি রাজধানীর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। তার চোখের অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। এখানে চিকিৎসা পেলেও শরীরের বুলেটগুলো বের না হওয়ায় যন্ত্রণা নিয়ে দিন পার করছেন তিনি। এখন সবচেয়ে বড় বাধা দেনা পরিশোধ করা এবং পারিবারিক ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে তিনি বলেন, ‘আমার প্রতি সপ্তাহে কিস্তির দেড় হাজার টাকা দিতে হয়। এর বাইরে ঝড়ে ঘর ভেঙে যাওয়ায় থাকার জায়গা নেই। পরিবার চলার কোন ব্যবস্থা নেই। আমি অনুরোধ করছি আপনাদের কাছে, দয়া করে কিছু করুন। আমরা দেশের জন্য লড়েছিলাম। একটু সুস্থ হয়ে নিজের জন্যও লড়তে পারব। কিন্তু অবহেলা, অসম্মান সহ্য করা কঠিন। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের মরে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।’

তিনি আরও যোগ করেন, ‘আমার যা কিছু ছিল তাই দিয়ে সংসার চলে যেতো। অথচ আহত হয়ে হাসপাতালে থাকায় এ সময়ে উল্টো লাখ টাকার ঋণের বোঝা মাথায় চেপেছে। সাথে দিনের পর দিন অসহ্য শারীরিক যন্ত্রণা সয়ে যাচ্ছি। উপদেষ্টারা আমাদের জীবনের বিনিময়ে চেয়ার পেয়েছেন, কিন্তু আমরা কি শুধু যন্ত্রণাই সয়ে যাব? সবই তো হারিয়েছি, এখন শুধু সুস্থভাবে বেঁচে থাকার আকুতি করছি।’


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence