শিক্ষকরা মেয়েকে পড়াতে না চাওয়ায় নিজেই স্কুল খোলেন মা

চিলমারীতে রিকতা আখতার বানুর গড়ে তোলা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা
চিলমারীতে রিকতা আখতার বানুর গড়ে তোলা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা  © সংগৃহীত

কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সিনিয়র স্টাফ নার্সের প্রতিবন্ধী কন্যাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল স্কুল থেকে। সেই বেদনা থেকেই রিকতা আখতার বানু মেয়ের জন্য গড়ে তোলেন স্কুল।

রিকতার মেয়ে তানভীন দৃষ্টি মনি বাকপ্রতিবন্ধী। ২০০৮ সালে ইউপি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেয়েকে ভর্তির চেষ্টা করেন রিকতা। অনেক অনুরোধে তানভীন দৃষ্টি মনিকে ভর্তিও নেয়া হয়েছিল। কিন্তু ভর্তির কিছু দিন পর তাকে আর পড়াতে চাননি শিক্ষকরা।

সেই বেদনা থেকেই নিজ উদ্যোগে ২০১০ সালে প্রতিবন্ধীদের জন্য ‍স্কুল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন রিকতা। এগিয়ে আসেন তাঁর স্বামী। স্কুলের নামে দান করেন ২৬ শতক জমি। এরপর নিজেদের অর্থায়নেই দোচালা একটি টিনের ঘর তোলেন। ৬৩ জন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও চারজন শিক্ষককে নিয়ে যাত্রা শুরু করে রিকতা বানুর স্বপ্নের স্কুল।

বর্তমানে প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী আর অভিভাবকের ভরসার স্থান হয়ে উঠেছে রিকতা আখতার বানুর (লুত্ফা) বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্কুল। এরই মধ্যে এটি এমপিওভুক্ত হয়েছে। ২১ জন শিক্ষক-কর্মচারী বেতন-ভাতা পান।

রিকতা বানু বলেন, খোঁজ নিয়ে জানতে পারি প্রতিটি স্কুলে প্রতিবন্ধীদের জন্য পাঁচটি আসন রয়েছে। অনেক জোরাজুরি করে মেয়েকে ভর্তি করাতে পারলেও কয়েক দিন পরে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় স্কুল থেকে। ভাবলাম, আমার মতো অনেক অভিভাবক তাঁর সন্তানকে নিয়ে এমন বিপদে নিশ্চয়ই পড়েছেন। তাই নিজেই স্কুল করার উদ্যোগ নিলাম।

শুরুতে শিক্ষার্থীদের দুপুরের টিফিনের টাকা এবং অন্যান্য খরচ জোগাতে রিকতা বানু সংসারের বাজেট কাটছাঁট করেছিলেন। স্কুলটি এমপিওভুক্ত হওয়ার পর শিক্ষক-কর্মচারীরা সেই দায়িত্ব নিয়েছেন। তাঁরা চাঁদা দিয়ে শিক্ষার্থীদের দুপুরের নাশতা দেন। তবে এখনো সপ্তাহের এক দিন আর বিশেষ দিনে টিফিন কিংবা দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করেন রিকতা বানু। শিশুদের তিনি মায়ের আদরে বড় করছেন। 

থানাহাট, ডাওয়াইটারি, জোড়গাছ, গুরাতিপাড়া, সরকারপাড়াসহ ব্রহ্মপুত্রপারের বিভিন্ন গ্রাম থেকে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা আসে এখানে। কেউ কেউ আসে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূর থেকে। তাদের আনা-নেওয়ার জন্য রয়েছে তিনটি ভ্যান। প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয় স্কুলটিতে।

শাহীন শাহ, রুজিনা, মহসিন ও লতিফা আক্তার নামের চারজন শিক্ষক স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে একসময় প্রতিবন্ধীদের প্রাথমিক পাঠ দিতেন। এখন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ২১ জন শিক্ষক-কর্মচারী শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে কাজ করছেন। নানা কৌশলে শেখাচ্ছেন পড়াশোনা। পাশাপাশি ফেসিয়াল মাসাজ, স্পিচ থেরাপিসহ নানা থেরাপির মাধ্যমে এগিয়ে নিচ্ছেন এই শিশুদের।

 প্রধান শিক্ষক শাহীন শাহ জানান, খেলার সামগ্রী এবং আরো কিছু সরঞ্জাম দরকার। প্রয়োজন নিয়মিত প্রশিক্ষণেরও। এখানে বিশেষ ধরনের শিক্ষা দেওয়া হলেও এদের একীভূত শিক্ষার ব্যবস্থা না করলে সমাজের মূলধারায় জায়গা করে নিতে সমস্যা হবে। তাই কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি জরুরি।

রিকতা বানুর মেয়ে দৃষ্টি মনি এখন পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। কথা বলতে না পারলেও সব সময় মিষ্টি হাসি লেগে থাকে তার ঠোঁটে। এখন নিজের কাজ, বাড়ির কাজ আর পড়াশোনার কিছু কাজ নিজেই করতে পারে। অন্য শিশুশিক্ষার্থীদেরও অনেকেই ধীরে ধীরে জড়তামুক্ত হচ্ছে, শিখছে কথা বলা। 

রিকতা বানু স্বপ্ন দেখেন তাঁর স্কুলটি হবে আবাসিক। দূর-দূরান্ত থেকে শিশুরা এখানে আসবে। হাতে-কলমে শিক্ষা নিয়ে সমাজের মূলস্রোতে মিশবে তারা। বর্তমানে চাকরি আর সংসারের বোঝা টানতে চরম বেগ পেতে হচ্ছে রিকতা বানুকে। এরপরেও হাল ছাড়তে চাননা তিনি। মৃত্যুর আগে স্বপ্নের স্কুলটির আরো প্রসার চান, হাসি ফোটাতে চান আরো অনেক মলিন মুখে।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence