আলো আসতে না চাইলে তাকে টেনে আনতেই হবে

মাহবুব কবির মিলন
মাহবুব কবির মিলন   © টিডিসি ফটো

বিমান বন্দরে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে প্রবাসীদের। তাদের এই দুর্দশা দেখার যেন কেউ নেই। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের অনিয়ম নিয়ে ফেসবুকে এক স্ট্যাটাস দিয়েছেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলন। 

সেখানে তিনি লিখেন, প্রবাসী ভাইদের জন্য দুটি সত্য কাহিনী  উৎসর্গ করছি।কয়েকবছর আগে সফরে মালয়েশিয়া গিয়ে বেড়াতে গেলাম আইল্যান্ড হোপিং-এ। পাহাড় ,সমুদ্র এবং লেক পরিবেষ্টিত মনোরম এক পর্যটন স্পট। একটি কম দামের আবাসিক হোটেলে উঠেছি। ফেরার আগের রাতে পাশেই এক খাবার হোটেলে বসলাম। সেখানে পরিচয় হল আমাদের দেশের এক প্রবাসী ভাইয়ের। সে দিনে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে এবং সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত এই খাবার হোটেলে কাজ করে।

দেশের মানুষ পেয়ে এত ভাল লাগল যে, মনে হল সে কত আপন আমার। আমাকে জিজ্ঞেস করাতে বললাম, এই পাশের হোটেলেই উঠেছি। কুশলাদি বিনিময়ের পর তাঁকে বললাম, তুমি দেশে টাকা পাঠাও কিভাবে? হুন্ডি নাকি ব্যাংকিং চ্যানেলে? উত্তর দিল, স্যার ব্যাংকের মাধ্যমে। হুন্ডিতে তো লাভ বেশি। সেখানে নয় কেন? বলল, স্যার হুন্ডিতে দেশের ক্ষতি। আর এত কষ্টের ইনকাম আমার অবৈধ পথে পাঠিয়ে তা নষ্ট (হারাম) করে দিতে পারি না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম তাঁর দিকে।

আরও পড়ুন: এবার মায়ের জন্য পাত্র চেয়ে মেয়ের বিজ্ঞাপন

খাবার শেষে বিল নিয়ে আসতে বললাম। উত্তরে বলল, আপনি আপনার রুমে যান, আমি বিল নিয়ে আসছি। তখন বাজে রাত দশটার মত। হোটেলে গিয়ে শুয়ে থাকলাম। রাত ১১টা পার হল, ১১.৩০ এর দিকে আবার সেখানে গিয়ে ম্যানেজারকে আমার বিলে কথা বললে, তিনি জানালেন দীপু আপনার বিল দিয়ে চলে গেছে। হতবাক হয়ে তাঁকে জিজ্ঞাস করলাম, কখন আসবে সে? আগামি কাল সন্ধ্যা ৬টায়। পরেরদিন আমাদের প্লেন বিকেলে। আর দেখা হবে না দীপুর সাথে। ম্যানেজারকে টাকাটা নিতে বললাম, যেন দীপুকে তা দিয়ে দেয়। তিনি বললেন, টাকা নিতে দীপু নিষেধ করেছে।

হেরে গেলাম দীপুর কাছে। আজও বুকটা খচখচ করে। এ কেমন ছেলে সে! আমি আজও ভেবে পাইনা, সামান্য সময় (খাবারের সময়) কথা বলার মাঝে পরিচয় হওয়া ছেলেটি মালয়েশিয়ায় আমার খাবার বিলটি নিজে দিয়েছিল কেন!

২০১৩ সালে ওমরাহ করতে গিয়েছি। কাবাঘরের ঠিক সামনের হোটেলের ৩/৪ তলায় মার্কেট ছিল। আছর নামাজ পড়ে মাগরিবের আগে পর্যন্ত সেখানে গল্পগুজব করতাম। একটি আতরের দোকানে ছিলেন সালেহ ভাই (এখন সিলেটে বসবাসরত), তাঁর পাশের দোকানেই বশর ভাই (চটগ্রাম বাড়ি)। চা, কফি আর চীজ কেক নিয়ে প্রতিদিন সবাই মিলে ভাগাভাগি করে খেতাম। সাথে ছিল আমার স্ত্রী। 

সালেহ আর বশর ভাইকেও জিজ্ঞেস করেছিলাম, দেশে টাকা পাঠান কিভাবে? তাঁরা একই উত্তর দিয়েছিলেন। দেশের আর নিজের ক্ষতি করে সামান্য কিছু টাকার জন্য হুন্ডিতে টাকা পাঠাই না। অবৈধ পথ মানে হারাম টাকা।

ফেরার আগের দিন বশর ভাইয়ের দোকানে অনেকগুলো তসবি আর মেয়েদের ব্যবহার্য্য জিনিসপত্র কিনে টাকা দিতে গেলে তিনি বেঁকে বসলেন। কিছুতেই টাকা নেবেন না। তাঁর এক কথা, আপনি এত বড় পদে চাকুরি করে প্রতিদিন আমাদের সাথে বসে গল্পগুজব করেছেন, বসার কিছু দিতে পারিনি, দাঁড়িয়ে স্বামী-স্ত্রী দীর্ঘ সময় ছিলেন। আপনাদের টাকা কিছুতেই নিতে পারব না। মাল ফেরত দিতে চাইলাম, সেটাও তিনি নেবেন না। একরকম জোর করে ব্যাগ হাতে দিয়ে সিঁড়ি পর্যন্ত নামিয়ে দিয়ে গেলেন। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ দুইজন।

হেরে গেলাম আমরা দুইজন বশর আর সালেহ ভাইয়ের কাছে।সালেহ ভাইও অনেকগুলো আতরের দাম নেয়নি। এই ভালবাসা তো কোন মূল্য দিয়ে কেনা যায় না।টয়লেটেও দেশি ভাই পেলে সেখানে দাঁড়িয়ে তাঁদের ভালমন্দ খোঁজ নিতাম।আমরা তো ঋণী এই মানুষগুলোর কাছে। জাতিগতভাবেই ঋণী। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং সৌদিতে অনেক প্রবাসী ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরেছি। দোহা এয়ারপোর্টেও তাই।

ভাইয়েরা আমার। যত কষ্টই হোক আপনাদের, যত দুঃখই পান না কেন। আমাদের এই বিপদে আপনারা কি এগিয়ে আসবেন না? এই দেশ তো আপনাদের, আমাদের, সবার। ভালমন্দ ছিল, আছে এবং থাকবে। দিন পরিবর্তন হবেই ইনশাআল্লাহ।  আপনাদের কষ্টার্জিত উপার্জন বৈধপথে পাঠান দেশে। আলো আসতে না চাইলে, তাকে তো টেনে আনতেই হবে।

লেখা- ফেসবুক থেকে সংগৃহিত


সর্বশেষ সংবাদ