৭ মার্চের ভাষণ তারুণ্যের অনুপ্রেরণার উৎস

৭ মার্চের ভাষণ তারুণ্যের অনুপ্রেরণার উৎস
৭ মার্চের ভাষণ তারুণ্যের অনুপ্রেরণার উৎস  © ফাইল ফটো

যখন খুব ছোট ছিলাম তখন ক্ষমতার বাইরে ছিল বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই অগ্নিঝরা তেজোদ্দীপ্ত ভাষণকে কখনো ক্ষমতার বাইরে রাখা সম্ভব ছিল না।

তখনকার সময়েও গ্রাম থেকে শহর, নগর থেকে বন্দর, পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে স্পিকার, সাদাকালো টিভি আর রেডিও থেকে কানে ভেসে আসতো মুক্তিকামী জনগণকে স্বাধীনতার ডাক দেওয়া বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক বজ্রগর্ভ কণ্ঠধ্বনি- ‘‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

সেই ছোট্ট বেলা থেকে আজ অবধি ঐতিহাসিক এ ভাষণটি এখনও আমাকে এবং আমাদের তরুণ প্রজন্মকে ভীষণ অনুপ্রাণিত করে। যতবারই শুনি, কোনো বিরক্তির ছাপ অনুভব করি না বরং নব উদ্যমে এগিয়ে চলার প্রেরণা পাই।

প্রায় পাঁচ দশকের পুরাতন সেই ভাষণ শুনলে আজও গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। একটি চরম সংকটময় মুহূর্তে লক্ষ জনতার সামনে ভারসাম্য রক্ষা করে একটি ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু জাতিকে মুক্তির যে দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন তা সত্যিই অতুলনীয়।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। বর্তমানে দেশের সবকটি জাতীয় দিবস সমূহে দেশব্যাপী বঙ্গবন্ধুর সকল ভাষণই বেশ গুরুত্ব সহকারে প্রচার করা হয়। কিন্তু যুগের পর যুগ বাঙালি হৃদয়ে বহমান ৭ মার্চের সেই ভাষণ তাৎপর্যের দিক দিয়ে ব্যতিক্রমী এবং অনন্য। যা কোনো কালেই স্তব্ধ করা যায় নি আর যাবেও না।

ঐতিহাসিক সেই ভাষণ কোনো সরকার, ব্যক্তি কিংবা দলের নয়। বরং এটি সর্বজনীন বাঙালি জাতিসত্তার ভাষণ। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকা অবস্থায় যেমন মানুষ এ ভাষণ শুনেছে, মাইক আর স্পিকারে বাজিয়েছে। আওয়ামী লীগ যদি আগামীতে ক্ষমতায় নাও থাকে তখনও এই ভাষণ তার স্বকীয়তা হারাবে না এটাই বাস্তবতা।

এই ভাষণ তো কবির লেখা এক বিপ্লবী কবিতা, সুরকারের সুর করা এক অগ্নিঝরা গান আর বাঁশিওয়ালার বিদ্রোহী সুরের বাজনা। তরুণ প্রজন্মের অনুপ্রেরণার বাতিঘর বিশ্ব প্রামাণ্য এ দলিল স্বাধীনতার ৫০ বছরেও পুরাতন হয়নি আর কোনোদিন হবেও না।

দেলওয়ার হোসেন মান্না

৭ মার্চ ১৯৭১ (রবিবার)। ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বেলা প্রায় পৌনে ৩টায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভাস্থলে উপস্থিত হন। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি ও কালো কোট (মুজিব কোট) পরিহিত শেখ মুজিব মঞ্চে এসে দাঁড়ালে উপস্থিত স্বাধীনতাকামী লাখো জনতা করতালি আর (১) ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর, (২) তুমি কে, আমি কে/ বাঙালি, বাঙালি(৩) তোমার আমার ঠিকানা/ পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ‘জয় বাঙলা’ ইত্যাদি শ্লোগানের মধ্যদিয়ে তাঁকে অভিবাদন জানায়।

আরও পড়ুন: ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে ঢাবির নানা কর্মসূচি

বিকেল ২টা ৪৫ মিনিটে শুরু হওয়া ঐতিহাসিক সেই ভাষণ ৩টা ৩ মিনিটে শেষ করেন তিনি। ১৮ মিনিটের এই ভাষণে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের বোধশক্তিতে ৭ কোটি মানুষকে একসূত্রে গেঁথেছিলেন। এই ভাষণ থেকেই মুক্তিকামী জনতা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। জীবন, রক্ত, আত্মত্যাগ আর সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে এসেছিল আমাদের লাল সবুজের পতাকা।

বঙ্গবন্ধুর যে কয়টি ভাষণ তরুণ প্রজন্মকে আলোড়িত করে তার মধ্যে ৭ মার্চের ভাষণটি অন্যতম। কালজয়ী সেই ভাষণ আমরা তরুণ প্রজন্ম যদিও সরাসরি শুনার সুযোগ পাইনি তবুও তার রেকর্ডটি আমাদের কাছে এক উজ্জীবনী শক্তি হিসেবে কাজ করে।

এই ভাষণটি তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ রাখার পাশাপাশি তাদেরকে ইতিহাস বিকৃতিকারী ও দেশবিরোধী অপশক্তি থেকে দূরে থাকতে প্রেরণা যোগায়।

৭ মার্চের ভাষণ আমাদের এই প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখায় সত্যের পক্ষে এবং অসত্যের বিপক্ষে অবস্থানের। ভাষণটি আমাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার এবং ত্যাগের শিক্ষা দেয়। পেশীশক্তির বিপক্ষে মাথা নত না করে জুলুমের বিপক্ষে সংগ্রামী হওয়ার শিক্ষা দেয়।

বঙ্গবন্ধুর সেই বজ্রধ্বনি আমাদেরকে অগণতান্ত্রিক শক্তির বিপক্ষে আন্দোলন করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শিক্ষা দেয়, শোষণহীন সমাজ গড়ার শিক্ষা দেয় এবং একইসাথে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের সম-অধিকারের একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠারও শিক্ষা দেয়।

তারুণ্য একটি প্রাণশক্তি। ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি (স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র) সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের আলোকে অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনে উদ্বুদ্ধ করে।

আমাদের নতুন প্রজন্মকে সেই ভাষণের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশপ্রেম লালন করে একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। নতুন প্রজন্মের কাছে এটিই হোক ৭মার্চের ভাষণের মূল শিক্ষা।

লেখক: তরুণ সাংবাদিক ও সমাজকর্মী


সর্বশেষ সংবাদ