বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষার প্রতি এত অবহেলা কেন?

এম এ মতিন
এম এ মতিন  © টিডিসি ফটো

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। বহু প্রাচীন এই প্রবচন। কিন্তু জাতির মেরুদন্ড শক্ত করতে হলে কোন সেই শিক্ষা যা মানুষকে দিতে হবে? শিক্ষার লক্ষ্য মূলত ২টি। প্রথমত - সক্রেটিসের ভাষায় ‘নিজেকে জানা’ অর্থাৎ ‘মানুষ হওয়া’ আর  দ্বিতীয়ত-পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্যে ও নিজের প্রয়োজন মেটানোর কলাকৌশল রপ্ত করা। বিজ্ঞজনেরা এ বিষয়টিকে এ ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন, ‘শিক্ষা হচ্ছে এমন জ্ঞান ও দক্ষতা যার মাধ্যমে মানুষ তার স্রষ্টার প্রতি, জ্ঞাতিজনদের প্রতি এবং চারপাশের মানুষ ও প্রকৃতির প্রতি নিজ দায়িত্ব পালনে সক্ষমতা অর্জন করতে পারে’। কিন্তু এতে সকল মানুষ সফল হয় না। ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় অনেকের  জীবন। মানুষ অমানুষের মত আচরণ করে, দুঃখকষ্ট নেমে আসে তাদের জীবনে, তার প্রতি অর্পিত দায়িত্ব পালনে সে ব্যর্থ হয়। নিজের কর্মের সংস্থান করতে পারে না। সমাজে সৃষ্টি হয় কর্মহীন বেকার। বাংলাদেশের মানুষ এর ব্যতিক্রম নয়।

সম্প্রতি শ্রমশক্তি জরিপ-২০২৩-এর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিএস। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটি ১৭ লাখ ১০ হাজার। এর মধ্যে ১৫ বছর এবং তদূর্ধ্ব বয়সী বেকার জনসংখ্যা ২৪ লাখ ৬০ হাজার। অর্থাৎ ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ মানুষ বেকার। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা’র (আইএলও) সংজ্ঞা অনুযায়ী, যারা কর্মক্ষম এবং কোনো কাজে নিয়োজিত নয়, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ খুঁজে বেড়ায় এবং ওই সময়ে কাজের সুযোগ পেলে সে কাজ করতে বা যোগদানে প্রস্তুত থাকে, মূলত সেসব ব্যক্তিকে বেকার হিসেবে ধরা হয়। বিবিএসও এই সংজ্ঞা ব্যবহার করে বেকারের তথ্য নির্ণয় করেছে।

বিবিএস’র প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দেশের মোট বেকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১৯ লাখ ৪০ হাজার যুবক বেকার। যার মধ্যে প্রায় ৯ লাখ উচ্চশিক্ষিত। অর্থাৎ মোট বেকার জনগোষ্ঠীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশই উচ্চশিক্ষিত, যারা স্নাতক থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশের মোট বেকার মানুষের ৩১ দশমিক ৫০ শতাংশই উচ্চশিক্ষিত। অথচ যাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই বা পড়াশোনা করেনি, তাদের বেকারত্বের হার মাত্র ১ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। অর্থাৎ মানসম্মত শিক্ষার অভাবে দেশে বেকারত্বের হার বাড়ছে, বিশেষ করে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা অধিক হারে বাড়ছে। বিবিএস’র তথ্যে দেখা যায়, উচ্চমাধ্যমিক পাস করা বেকারের হার ১৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ, মাধ্যমিক শেষ করা বেকার ২১ দশমিক ২৯ শতাংশ। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোনো বেকারের হার ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্য কোনো মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করা ব্যক্তিদের বেকারত্বের হার শূন্য দশমিক ৮১ শতাংশ। প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। শ্রমশক্তি জরিপ-২০২২ এর হিসাবে দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকার ছিল মোট বেকার জনগোষ্ঠীর ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ, যা বছরের ব্যবধানে বেড়ে হয়েছে ৩১ দশমিক ৫০ শতাংশ। বছরের ব্যবধানে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪ শতাংশ। অর্থাৎ ধারাবাহিকভাবেই বাড়ছে উচ্চশিক্ষিত বেকার মানুষের সংখ্যা। গ্রামের চেয়ে শহরে উচ্চশিক্ষিত বেকারের হার বেশি।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, শহরের উচ্চশিক্ষিত বেকারের হার ৩৪ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ, সেখানে গ্রামের বেকার ৩০ দশমিক ২৫ শতাংশ। একইভাবে পুরুষের চেয়ে উচ্চশিক্ষিত নারী বেকারের হার বেশি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে ৩৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ উচ্চশিক্ষিত নারী এবং ২৮ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ পুরুষ বেকার ছিল। শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, একদিকে দেশে পুরুষ বেকারের সংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে কমছে নারী বেকারের সংখ্যা। মোট বেকার জনসংখ্যার মধ্যে পুরুষ রয়েছে ১৬ লাখ ৪০ হাজার, যেখানে বেকার নারী ৮ লাখ ২০ হাজার। দেশে বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এ বিষয়ে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ বলেন, বেকারত্বের সংজ্ঞার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। বিবিএস বেকারত্বের যে হিসাব দেয়, তা সঠিক নয়। একজন মানুষের জীবনধারণের জন্য যতটুকু আয় দরকার হয় সেটা তার আছে কি না, এটিসহ বেশকিছু তথ্য বিবিএসের জরিপে আসে না। সে কারণে দেশের বেকারত্ব সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায় বটে, কিন্তু প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না।

উচ্চশিক্ষিতদের বেকার থাকার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম-এর মতে ‘আমরা যে পরিমাণ গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছি, সে পরিমাণে জব তৈরি করতে পারছি না। জব তৈরি হওয়ার জন্য যে পরিমাণ বিনিয়োগ দরকার, তা হচ্ছে না। জব তৈরি না হলে তো উচ্চশিক্ষিতরা বেকার থাকবেই। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা পড়াশোনা শেষ করে, তারা ভালো জব পেতে অপেক্ষা করে, এটাও বেকার থাকার একটি কারণ। এ ছাড়া মার্কেটের চাহিদা অনুযায়ী যে দক্ষ গ্র্যাজুয়েট তৈরি করার কথা সেটা আমরা করতে পারছি না। মানসম্মত শিক্ষাও দিতে পারছি না। ফলে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব বাড়ছে’। অথচ সরকার দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিয়েই চলেছে।

২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন যাবত যে সকল বিষয়ে অভিযোগ ছিল সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা, নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করা, বিরোধী মত দমন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে ব্যর্থতা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুটপাট, তীব্র বেকারত্ব রোধে ব্যবস্থা নিতে না পারা, নিয়োগ–বাণিজ্য, ইত্যাদি। বিশেষ করে দ্রব্যমূলের উর্ধ্বগতিতে জনজীবনে নাভিশ্বাস এবং শিক্ষিত বেকারদের তীব্র হতাশা এবং সে বিষয়ে সরকারের উদাসীনতা ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানকে বেগবান করেছিল। এই অভিজ্ঞতার আলোকে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হবে বিদ্যমান অন্যান্য নেতিবাচক অর্থনীতির সূচকগুলোর নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি দেশ থেকে বেকারত্বের তীব্রতা কমানোর জন্য জরুরি কর্মসূচি গ্রহণ করা।

কর্মসংস্থানের বৈশ্বিক গতি প্রকৃতির অন্যতম লক্ষ্যনীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- বিশ্বের চাকরির বাজার আগের চেয়ে অনেক দ্রুত বদলে যাচ্ছে। অনেকে মনে করছেন বর্তমানের অনেক চাকরির অস্তিত্ব শীঘ্রই অদৃশ্য হয়ে যাবে। এই পরিবর্তনের পেছনে প্রধান দুটি কারণের কথা ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সাম্প্রতিক সমীক্ষায় উঠে এসেছে। তন্মধ্যে একটি হলো-নতুন প্রযুক্তির উত্থান বা অটোমেশন এবং অন্যটি হলো সবুজ ও টেকসই অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাওয়া। বিগ ডেটা, ক্লাউড কম্পিউটিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মত নতুন নতুন প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি শ্রম বাজারে আমূল পরিবর্তন আনবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নতুন প্রযুক্তি সার্বিক অর্থনীতি উন্নয়নে সাহায্য করবে বটে তবে একদিকে যেমন অনেক কর্মসংস্থানের খাত তৈরি হবে তেমনি অনেক কর্মসংস্থান ধ্বংস হয়ে যাবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গবেষকদের মতে, আগামী পাঁচ বছরে বর্তমান চাকরির বাজার প্রায় এক চতুর্থাংশ বদলে যাবে। সুতরাং বৈশ্বিক এ পরিবর্তনের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেরও উচিত হবে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান শিক্ষিত বেকারদের প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজারে সফলতা অর্জনের জন্য নতুন নতুন দক্ষতা অর্জনকারী কর্মমুখী তথা কারিগরি শিক্ষার বাস্তবায়ন এবং এর সক্ষমতা বাড়ানোর উপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ করা। 

সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা রয়েছে বিধায় কর্মমুখী তথা কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কর্মমুখী শিক্ষা শিক্ষার্থীর কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করে এবং তাদেরকে সৃজনশীল ও উৎপাদনমুখী করে গড়ে তোলে। এই শিক্ষার কাজ হলো জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রুপান্তর করে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক শক্তিকে সুদৃঢ় করা। কর্মমুখী শিক্ষা শিক্ষার্থীকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং তাদের সুপ্ত গুণাবলীকে বিকশিত করে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এর মতে, ‘কর্মমুখী শিক্ষা হলো এমন শিক্ষাব্যবস্থা. যা শিক্ষার্থীদের জীবনকে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে গড়ে তুলতে ও কর্ম পেতে সাহায্য করে’।

কর্মমুখী শিক্ষা এমন এক ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা, যা গ্রহণ করতে পারলে শিক্ষার্থীরা ঘরে-বাইরে, ক্ষেতে-খামারে, কলে-কারখানায় যেকোনো পেশায় অতি দক্ষতার সঙ্গে কাজ করার যোগ্যতা লাভ করে। এই শিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান মূলত পেশাগত কর্মের সাথে সম্পৃক্ত। এই শিক্ষা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এ শিক্ষার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল ‘কর্মমুখী শিক্ষা নিলে, বিশ্ব জুড়ে কর্ম মিলে’।

উচ্চতর কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে ইচ্ছামতো একটি স্বাধীন পেশায় নিয়োজিত হতে পারে বা ভালো বেতনে উচ্চপদস্থ পেশাজীবী হওয়ার সুযোগ পায়। যেমন- প্রকৌশলী, চিকিৎসক, অধ্যাপক, কৃষিবিদ, ইত্যাদি। সাধারণ কর্মমুখী শিক্ষায় পেশাজীবী হতে চাইলে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির প্রয়োজন হয় না, প্রাথমিক বা মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাগত যোগ্যতাই যথেষ্ট। এই শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন শেষে একজন শিক্ষার্থী কৃষি খামারী, মৎস্য চাষি, কামার, কুমার, তাঁতি, দর্জি, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, পেইন্টার, কাঠমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি, টাইলস মিস্ত্রি, প্লাম্বার, পোশাক কারখানা শ্রমিক, ছাপাখানা শ্রমিক, চামড়া শিল্পের শ্রমিক, কুটির শিল্প, নার্সারি মালিক, গ্রাফিক্স ডিজাইনার, নার্স, ধাত্রী, গাড়ি চালক, সাইকেল-রিকশা, ইত্যাদি মেরামতের কাজ, দোকানদার, সেলসম্যান, হেয়ার ড্রেসার, মেকানিক, ওয়েল্ডার, রেডিও-টেলিভিশন-ফ্রিজ-মোটরগাড়ি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও, গ্রাফিক ডিজাইন কিংবা কন্টেন্ট মেকার, ইত্যাদি আর মেরামতের কাজ, যেমন -  বৈদ্যুতিক গৃহসামগ্রী মেরামতের কাজ, হাউস ওয়ারিং, যানবাহন চালক, প্রাথমিক চিকিৎসা, কাপড় ইস্ত্রি, আধুনিক পদ্ধতিতে হাঁস-মুরগি-গরু-ছাগল ও ভেড়া পালন, সেলুনের কাজ, ইত্যাদি পেশায় নিয়োজিত হতে পারেন। এ শিক্ষা অল্প সময়ে স্বল্প ব্যয়ে সহজেই গ্রহণ করা যায় এবং দেশ ও বিদেশের সর্বত্রই এ ধরনের কাজের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার ফলে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যেমন - আমেরিকা, জাপান, ব্রিটেন, ফ্রান্স, চীন, কোরিয়া,  প্রভৃতি দেশ আজ নিজেদের জীবন মানকে সুপ্রসন্ন করে উন্নতির শিখরে আরোহণ করেছে। তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা পরিকল্পিত, কর্মমুখী, আধুনিক প্রযুক্তি ও কলাকৌশল নির্ভর। অন্যদিকে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা প্রদানে পিছিয়ে থাকার কারণে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের সীমিত সম্পদের উপর চাপ এবং  বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের সংখ্যা বাড়ছে। বেকারত্ব ও দারিদ্র্য অব্যাহত থাকলে ২০২৭ সাল নাগাদ উন্নয়নশীল দেশের সনদ লাভ অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন। 

বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোতে দক্ষ জনসংখ্যা ৬০ শতাংশের কাছাকাছি। যেমন-জার্মানিতে প্রায় ৭৩ শতাংশ, জাপানে ৬৬, সিঙ্গাপুরে ৬৫, অস্ট্রেলিয়ায় ৬০, চীনে ৫৫, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৫০, মালয়েশিয়ায় প্রায় ৪৬ শতাংশ শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষায় দক্ষতা অর্জন করে। বিপরীতে বাংলাদেশে স্বল্পদক্ষ ও দক্ষ জনশক্তি সরকারীভাবে ১৮ শতাংশ দাবি করা হলেও আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী দেশে কারিগরি শিক্ষার হার মাত্র ৯ শতাংশ। বলা বাহুল্য, কারিগরি শিক্ষাই অর্থনৈতিক অগ্রগতির চাবিকাঠি।

দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ইত্যাদি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশেও কর্মমুখী শিক্ষা যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি কারিগরি, প্রকৌশলী, চিকিৎসা, ভোকেশনাল, ইত্যাদি কর্মমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে বেশ কিছু সরকারি-বেসরকারি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ও শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমিয়ে আনতে কর্মমুখী তথা কারিগরি  শিক্ষার বিকল্প নেই। প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষায় কর্মমুখী শিক্ষা বা বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও বিজ্ঞানসংশ্লিষ্ট প্রোগ্রাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি করা দরকার। তাই দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে একটি বিশ্বমানের শিক্ষানীতি ও কারিকুলাম প্রণয়ন আবশ্যক। সকলের আশা,  অন্তর্বর্তীকালীন  সরকার সব স্টেকহোল্ডারদের সহযোগিতা নিয়ে কারিগরি তথা কর্মমুখী শিক্ষার ব্যাপক সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশের বেকারত্ব নিরসন, দারিদ্র্য বিমোচন, টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করবেন।

বাংলাদেশে কর্মমুখী তথা কারিগরি শিক্ষার বর্তমান অবস্থা 
বর্তমানে বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষার স্তর ৩ টি। ১. স্নাতক পর্যায়ে বি এসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী। ২. পলিটেকনিক ইন্সটিউটে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী ও ৩। পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট ও কারিগরি ইন্সটিটিউটে স্বল্পমেয়াদী ভোকেশনাল/ট্রেড কোর্সে সার্টিফিকেট। 

আমাদের দেশে ১৯৫৫ সালে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট (বর্তমান ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট) প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মধ্যম স্তরের প্রকৌশলী তথা ডিপ্লোমা প্রকৌশলী তৈরির স্বতন্ত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়। দীর্ঘ ৬৯ বছরে সরকারি ৫০টি এবং বেসরকারি পর্যায়ে প্রায় ৫ শতাধিক পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপিত হয়েছে। ৩৮৭টি  বেসরকারি পলিটেকনিকের মধ্যে মাত্র ২০ থেকে ২৫টি ছাড়া অন্যগুলো নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। মালিকরা সার্টিফিকেট বিক্রির দোকান খুলে বসেছেন। শিক্ষায় অনুন্নত কারিকুলাম ও পুরোনো কোর্স থাকায় পড়ালেখা সম্পন্ন করেও চাকরির বাজারে বঞ্চিত হচ্ছেন অনেকে। কারিগরি বিভিন্ন বিষয়ে বিদেশে চাহিদা থাকলেও শিক্ষার মান উন্নয়নে আশাতীত কোনো উদ্যোগ নেই সংশ্লিষ্টদের।

এর পাশাপাশি প্রতি জেলায় স্থাপিত সরকারি বৃত্তিমূলক র্শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (টিএসসি) দক্ষ জনবল তৈরিতে ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে কারিগরি শিক্ষার হার প্রায় ১৫-১৬ শতাংশ দাবী করা হলেও আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ো এই হার ৯ শতাংশের কাছাকাছি। বিগত সরকার এ হার ২০২০ সালের মধ্যে ২০ শতাংশে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছিল। সে টার্গেট অর্জিত হয়নি। বিগত সরকার কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতের হার ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। এটা খুবই আশাব্যঞ্জক হলেও কারিগরি শিক্ষা এখনো অবহেলিত। কারিগরি শিক্ষায় ৫০ শতাংশ ভর্তি বাধ্যতামূলক করতে হবে যেহেতু কারিগরি শিক্ষা গ্রহণে এখনো আমাদের দেশে আগ্রহ কম। সাধারণ ও কারিগরি শিক্ষা গ্রহণের অনুপাত নির্ধারণ হওয়া প্রয়োজন। 

বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়য়ের অধীন কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের অধীনে শের-ই-বাংলা নগরস্থ আগারগাও এ অবস্থিত কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর। বাংলাদেশের একমাত্র কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অফিস এখানেই। কারিগিরি শিক্ষা সম্প্রসারণ ও মানোন্নয়নের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৬০ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর অধীনে সরকারি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মোট ৭৯২৫। আগেই বলা হয়েছে, এ গুলোতে শিক্ষার স্তর মোট  ৩ টি। ১. ডিপ্লোমা ডিগ্রীর নিচে ৬ মাস/ ১ বছর মেয়াদি ভোকেশনাল/ট্রেড কোর্স ২. পলিটেকনিক ইন্সটিউটে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ও ৩। স্নাতক পর্যায়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং। এগুলোর মধ্যে সার্টিফিকেট পর্যায়ে ১৩৪ টি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ এবং ১ টি ভোকাশনাল টিচার্চ ট্রেনিং ইন্সটিটিউট রয়েছে। এ ছাড়া ডিপ্লোমা পর্যায়ে ৪৯ টি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট এবং ডিগ্রী পর্যায়ে ৪ টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ রয়েছে। এগুলো ছাড়াও এই অধিদপ্তরের অধীনে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ২০২২-২৩ সালে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে সর্বমোট ১১,১১৮ টি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দিয়েছে। এ গুলোর মধ্যে সরকারি ৭৭৭ টি ও বেসরকারি ১০,৩৪১ টি। এগুলোর মোট আসন সংখ্যা হচ্ছে ১৩,৬৯,১০৫ টি। ২০২২-২৩ সালে ভর্তি হয়েছে মোট ৬,৭৩,৫৯১ জন (সরকারি ৯৭,৯২৯ জন ও বেসরকারি ৫,৭৬,৬৬২ জন)। অতএব দেখা যাচ্ছে মোট আসনের শতকরা ৫০ ভাগ আসন খালি পড়ে আছে।  যা দুঃখজনক বৈ কি?

এ ছাড়া এই অধিদপ্তরের অধীনে রয়েছে ‘জাতীয় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও গবেষণা একাডেমি (নেকটার)। ১৯৮৪ সালে বগুড়া জেলার শাজাহানপুর উপজেলার জাহাঙ্গীরাবাদ সেনানিবাস সংলগ্ন নেকটার –এর কার্যক্রম শুরু হয়। এর মূল কাজ হচ্ছে – শিক্ষিত বেকার যুবক ও মহিলাদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ ও আত্নকর্মসংস্থান এবং অনলাইন মার্কেট প্লেসে কাজ করার উপযোগী করে গড়ে তোলা। এ ছাড়াও সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জন্যে তথ্য প্রযুক্তি (আই সি টি) বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। 
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ দেশে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণে প্রতি জেলায় একটি করে সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও প্রতিটি উপজেলায় একটি করে বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন, টেক্সটাইল ও লেদার ইনস্টিটিউটসহ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ শিক্ষানীতিতে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডকে অধিকতর শক্তিশালী করা ও প্রয়োজনীয় আর্থিক সংস্থান ও জনবল বৃদ্ধি, যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক-প্রশিক্ষক নিয়োগের অঙ্গীকার করা হলেও বাস্তব অগ্রগতি সামান্যই। প্রতিটি বিভাগে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড হওয়া দরকার। একটি মাত্র কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পক্ষে বিপুল সংখ্যক কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তত্ত্বাবধান করা সম্ভব নয়। দেশে ৮টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড থাকলেও  কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সংখ্যা ১টিই রয়ে গেছে। অর্থাৎ কারিগরি শিক্ষা উপেক্ষিতই রয়ে গেছে।

উপরন্তু পরিকল্পনাহীনতার কারণেই দেশে এখন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৮টি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত প্রায় ৭০০ সরকারি-বেসরকারি কলেজে অনার্স-মাস্টার্স খোলা হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এখন ১১৪টি (জুন ২০২৩)। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অতি সম্প্রতি ‘গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে আরও একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়েছে বলে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে।  

এ সকল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর ডিগ্রীপ্রাপ্ত  প্রায় ৩-৫ লাখ উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণী বেকারের তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন। তাই আমরা মনে করি ১.  স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষাকে সীমিত করে সনদনির্ভর দক্ষতাহীন শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা হ্রাস করা; ২. প্রাথমিক (৮ম শ্রেণি পাশ) ও এসএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের কমপক্ষে ৫০ শতাংশকে কারিগরি শিক্ষাগ্রহণ বাধ্যতামূলক কর;  ৩. সাধারণ শিক্ষায় একাদশ শ্রেণির আসন সংখ্যা যৌক্তিক হারে সংকুচিত করে কারিগরি শিক্ষার আসন বৃদ্ধি করা এবং কোনো আসন যাতে খালি না থাকে তা নিশ্চিত করা; ৪. শুধু পরিমাণগত নয়, এগুলোতে পড়াশুনা করা ছাত্রছাত্রীদের গুণগত মানও নিশ্চিত করতে হব; ৫. বেসরকারি পর্যায়ে নতুন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট অনুমোদনের ক্ষেত্রে মান ও ইতোমধ্যে অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া; ৬. প্রতিটি বিভাগে ১টি করে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড স্থাপন করা; এবং ৭. শ্রম বাজারের চাহিদা নিরূপণ করে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো। 

সম্প্রতি ‘যুব কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে স্থানীয় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা’ শীর্ষক এক সম্মেলনের আয়োজন করে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে সন্মেলন থেকে বলা হয়েছে,  ‘বর্তমানে বহু ধরনের সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে।...কারিগরি শিক্ষার আধুনিকায়ন এবং এর সংস্কার নয়, রূপান্তরের জন্য একটি অংশীদারত্বমূলক বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করতে সরকারের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি।’ আরও বলা হয়, ‘অন্তর্বর্তী সরকার খুব দ্রুততার সঙ্গে আধুনিক, দক্ষ ও সময়োপযোগী বিশ্বমানের কারিগরি বৃত্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে, সেটা কিভাবে করা যায়, তার একটি রূপান্তরমূলক কর্মপরিকল্পনার জন্য দ্রুত একটি কমিটি করবে’।

জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এখন তরুণ জনগোষ্ঠীর দেশ। এ অঞ্চলের ৪৫টি দেশের জনসংখ্যাভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আমরা এক্ষেত্রে সবচেয়ে সুবিধাজনক স্থানে রয়েছি। শুধু তাই নয়, এ মুহূর্তে বাংলাদেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা (১৫-৫৯ বছর) মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশেরও বেশি। তাই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট (জনমিতি মুনাফা) বিবেচনায় বাংলাদেশ এখন অতিক্রম করছে একটি সুবর্ণ সময়। আমরা এ সুযোগ ও সম্ভাবনাকে সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে প্রত্যাশিত উন্নত দেশে পরিণত হতে পারি। কিন্তু তরুণ-তরুণীদের প্রকৃত শিক্ষা ও কাজ দিতে না পারলে সে সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা সর্বাধিক। তাই শ্রম বাজারে কর্মসংস্থানের হার বাড়াতে হলে কারিগরি শিক্ষাকেই প্রাধান্য দিতে হবে। সেই লক্ষ্যে নিন্মোল্লেখিত বিষয়গুলোর প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিঃ 

১. কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শতকরা ১০০ ভাগ ছাত্র ভর্তি নিশ্চিত করা এবং শিক্ষক/প্রশিক্ষকের শূন্য পদ পূরণের আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করা। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ অনুযায়ী ২০৪০ সালের মধ্যে কারিগরি শিক্ষার হার শতকরা ৫০ ভাগে উন্নীত করার লক্ষ্যে সর্বাত্নক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে; 

২. অষ্টম শ্রেণী পাশ ছাত্রছাত্রীদের মধ্য থেকে বিশেষ পরীক্ষা (স্ক্রিনিং) এর মাধ্যমে শুধুমাত্র অতি মেধাবীদের নবম শ্রেণীতে ভর্তির অনুমতি প্রদান এবং বাদবাকীদের ঢালাওভাবে কারিগরি শিক্ষায় অনুপ্রবেশের একটি সর্বসম্মত জাতীয় নীতি গ্রহণ করা। মনে রাখা প্রয়োজন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করা ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দান জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী; 

৩. শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দক্ষ আধা–দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আফ্রিকার শ্রম বাজারে চাহিদা অনুযায়ী কম খরচে জনশক্তি রপ্তানির ব্যবস্থা করা;

৪. দেশে নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির পদক্ষেপ গ্রহণ করা। শিক্ষিত বেকার যুবকদের প্রয়োজনীয় ট্রেনিং ও  পুঁজি সহায়তা দিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ করে দেওয়া;

৫. সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শূন্য পদের সুস্পষ্ট পরিসংখ্যান তৈরি করে পর্যায়ক্রমে দুর্নীতিমুক্তভাবে শিক্ষিত বেকারদের নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করা;

৬. শ্রমিক অসন্তোষ দূর করে নতুন নতুন রপ্তানিমুখী শিল্প কারখানা গড়ে তোলা। বন্ধ শিল্প কারখানা দ্রুত চালু করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা; 

৭.  বিশ্বের উন্নত দেশে বাংলাদেশের শ্রম বাজার সম্পর্কে প্রচার করার পাশাপাশি বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যত বেশি বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা যাবে তত বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এক্ষেত্রে ডলার সংকট দূর করা, অর্থ পাচার বন্ধ করে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনা, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা এবং সর্বোপরি সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করাকে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা দুরূহ হয়ে উঠবে; এবং সবশেষে

৮. সামাজিক মর্যাদার প্রশ্নে বাংলাদেশে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষার প্রতি যে নেতিবাচক মনস্তাত্ত্বিক ভাবমূর্তি বিদ্যমান তা দূরীভূত করার কার্যর্কর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যাতে তরুণরা সাধারণ শিক্ষার চেয়ে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণে ব্রতী হয়।

সার্বিকভাবে আমাদের নতুন প্রজন্ম এবং শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীকে বিশ্ববাজারে  নতুন নতুন কাজের উপযোগী করে গড়ে ওঠার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ফিউচার অফ জবস রিপোর্ট ২০২৩ অনুসারে, সব ধরনের খাত এবং শিল্পে সবুজ চাকরির চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। সবুজ রূপান্তরের কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী তিন কোটি কর্মসংস্থান তৈরি হতে পারে।

এ কর্মসংস্থান তৈরি হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, অল্প শক্তি ব্যবহার করে বেশি উৎপাদন এবং কম নির্গমন প্রযুক্তি এ তিনটি খাতে। সবুজ শক্তি এবং টেকসই উন্নয়নে নতুন চাকরির সুযোগের ক্ষেত্রে আপাতত যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে পশ্চিমা দেশ এবং জাপান। এরপরে রয়েছে চীন। এ কাজগুলো ব্যবসা, বিজ্ঞান ও পরিবেশের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত হতে পারে। আমাদের বেকার কর্ম শক্তিকে ঐসব কাজের উপযোগী করে প্রশিক্ষণ দিয়ে উপযোগী ওসব দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ গ্রহণ করতে হবে।

লেখক: উপদেষ্টা, গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগ ও প্রক্টর, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, আশুলিয়া এবং প্রাক্তন পরিচালক, বাংলাদেশ লোক-প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি), সাভার, ঢাকা।
ই-মেইল: amatin@aub.ac.bd

 


সর্বশেষ সংবাদ