সবচেয়ে বড় অস্ত্রটা সাধারণ মানুষের হাতেই থাকে, সেটা হলো—বয়কট

বিশ্বব্যাপী ইসরায়েলি পণ্য বয়কট আন্দোলন চলছে
বিশ্বব্যাপী ইসরায়েলি পণ্য বয়কট আন্দোলন চলছে  © সম্পাদিত

ইসরায়েলের পণ্য বয়কট ইসলাম, মুসলিম ও মানবতার প্রতি ভালোবাসা-আবেগের প্রকাশ। নানা কারণ ও পরিস্থিতিতে বয়কট জীবনব্যাপী চলমান একটি আন্দোলন। গাজা-ফিলিস্তিনের জন্য দৃশ্যমান কিছুই করতে না পারলে অন্তত অন্তর থেকে দোয়া করতে থাকুন এবং ইসরায়েল ও তাদের দোসরদের পণ্যসহ যা কিছু সম্ভব সর্বোচ্চ পর্যায়ে বর্জন করুন। এটা আমি, আপনি ব্যক্তিগতভাবে করতেই পারি। সেদিন অন্তত এটুকু বলতে পারার সুযোগ যেন নিতে পারি; যেদিন আমার, আপনার জবাবদিহিতা আমার, আপনাকেই করতে হবে। সামগ্রিক জবাবদিহিতার দোহাই দিয়ে পার পাওয়ার কোনো উপায় থাকবে না। 

বয়কট জীবনব্যাপী চলমান একটি অত্যাবশ্যকীয় আন্দোলন, যা ব্যক্তি পর্যায়ে কার্যকরী করতে কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। অবস্থার প্রেক্ষিতে বয়কট নিয়ে শেষ বিচারে আমার জবাবদিহিতা আমাকেই করতে হবে। অতএব, সর্বোচ্চ সচেতন হই এবং সতর্কতা জারি রাখি। তবে সঠিক সময়ে উপযুক্ত কাজটিই করতে হবে। জীবনবাজি রেখে বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়ানোই আমাদের সর্বাবস্থায় দায়িত্ব-কর্তব্য।

আমাদের প্রথম কিবলা ওরা গিলে ফেলছে। অন্য দেশ থেকে তথায় প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে দীর্ঘকাল আগ থেকে। এমনকি ফিলিস্তিনীরা ও স্বস্তি মতো সেখানে ঢুকতে, নামাজ আদায় করতে পারে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মেরাজ ও ইমামতির স্মৃতির আল আকসাকে তারা এমনতর করে রেখেছে। হাজারো নবীর উত্তরাধিকারী আকসার প্রহরী গাজাবাসীর ওপর নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে।

কূটনৈতিক-অর্থনৈতিক অবরোধ গড়ে তোলায় নেতৃত্বও এ বিরাট মুসলিম বিশ্ব দিতে পারছে না। এমতাবস্থায় আমাদের উচিত অন্তত কুনুতে নাজেলা পড়া এবং মানুষকে মাজলুমদের জন্য হৃদয় নিংড়ানো দোয়ায় উদ্বুদ্ধ করা। একদিন মিছিল করলেই কি দায়িত্ব শেষ!? অথচ পশ্চিমা দেশগুলোয় সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বিবেকবান অন্যান্য ধর্মাবলম্বী, ভিন্ন মত, পথের মানুষরা অব্যাহত  প্রতিবাদ জানাচ্ছে। মনুষ্যত্ব দেখিয়ে তারা কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে সরকারকে চাপ দিচ্ছে। 

সরকার তেমন কানে নিচ্ছে না বলে সামাজিকভাবে ওদের পণ্য বয়কট, ওদের সহযোগী ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়ার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনী পতাকাসহ নানা সিম্বল ধারণ করে বেড়াচ্ছে। ইসলামের তৃতীয় পবিত্র মসজিদ, পবিত্র স্থান,দেশ,মানুষসহ সব ধ্বংস করে দিচ্ছে, কি জবাব দেবেন আল্লাহর কাছে?  এতো এতো প্রিয়জন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, দলীয় নেতা-কর্মী ,ভক্ত-অনুসারীরা কেউই সেদিন পাশে থাকবে না, ফেসবুক-ইউটিউবের ফলোয়াররা কেউ থাকবে না, তখন কী জবাব দেবেন  প্রভুর দরবারে? 

আল্লাহকে ভয় করুন। সময়ের গুরুত্ব বুঝার চেষ্টা করুন। নিজ কর্তব্য-দায়িত্ববোধ থেকে সরে আসবেন না প্লিজ। বর্তমান দুনিয়াতে সবচাইতে বড় ব্যবসা হলো—প্রোডাক্ট বা পণ্য। যতো বড় মোড়ল, কর্পোরেট হাউজ, পরাশক্তি বলেন, সকলে টিকে থাকে তাদের পণ্য বিক্রির ওপর। দিনশেষে এই পণ্যের ক্রেতা কিন্তু সাধারণ মানুষ। মার্কেটটা কিন্তু সাধারণ মানুষকে ঘিরেই তৈরি হয়। সুতরাং পণ্য যারা কেনেন বা কনজিউম করেন, সবচাইতে বড় অস্ত্রটা তাদের হাতেই থাকে। সেটা হলো—বয়কট।

অতএব, যে আপনার শত্রু, আপনার ধর্মের শত্রু, আপনার অধিকার আর অস্তিত্বের শত্রু, যে আপনাকে গৃহহীন করে, আপনার ভাইকে হত্যা করে, বোনকে স্বামী-সন্তানহারা করে, আপনার সন্তানকে দুনিয়া ছাড়া করে, তার পণ্য বয়কট করে আপনি তাকে আপনার অবস্থান জানিয়ে প্রতিবাদ জারি না রেখে কিভাবে থাকতে পারেন? স্মরণ রাখা দরকার, অমুসলিমদের পণ্য ব্যবহার, তাদের সাথে লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য করা নাজায়েজ নয়। যদি না সে পণ্য- মুসলিমদের বিপক্ষে ব্যবহার করা হয়। এজন্যই অস্ত্র বিক্রি জায়েজ হলেও, ডাকাতের কাছে অস্ত্র বিক্রি হারাম। 

এমনিভাবে যারা মুসলিমদের বিপক্ষে লড়াইয়ে রত, তাদের কাছেও অস্ত্র বিক্রি জায়েজ নয়, যার ব্যবসা লব্ধ অর্থ ইসলাম ও মুসলিমের বিপক্ষে ব্যবহার করা হয় কিংবা মুসলিমদের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া অমুসলিমদের পণ্য ব্যবহার নাজায়েজ নয়। অতএব, আমরা ইসরায়েলের যেসব পণ্য বয়কট করার কথা ভাবছি, তা নাজায়েজ হিসেবে নয়। হ্যাঁ, এর মধ্যে কিছু আছে, যেগুলো ইসরায়েলের দখলদারিত্বের পেছনে সক্রিয় ভূমিকা রাখে, সেগুলো ব্যবহার করা নিশ্চিতই হারাম। 

বাকি যেসব পণ্য মুসলিমদের বিপক্ষে সরাসরি কাজে জড়িত নয় , ইসরায়েলের সেসব পণ্য বর্জনের কারণ হচ্ছে– জিহাদ। আমরা নিশ্চয়ই জানি, জিহাদের একটি অংশ হচ্ছে বয়কট বা অবরোধ। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.) খায়বরে বানু নাযীর গোত্রকে অবরুদ্ধ রেখেছিলেন। অর্থনৈতিক অবরোধও মূলত জিহাদেরই একটি অংশ। এ অবস্থায় সকল মুসলিম দেশ থেকে একযোগে ইসরায়েলের সাথে আমদানি-রপ্তানী বন্ধ করে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপই কার্যকরী একটি উপায় মনে করি।

যেহেতু নানা কারণে তা হচ্ছে না, সে হিসেবে ব্যক্তিগত পর্যায়ের অবরোধ হিসেবেই আমি পণ্য বয়কটকে জোড়ালোভাবে দেখছি। অর্থাৎ ব্যক্তির তরফ থেকে এক প্রকার অবরোধ হচ্ছে সে দেশের ও সে দেশ সংশ্লিষ্ট পণ্য বর্জন করা। এটা আর্থিক জিহাদেরই একটি পর্যায়, তা যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন। তবে অনেকেই বলে থাকেন, ইসরায়েলি পণ্য বর্জন করলে কিই বা লাভ। আমি একজন পণ্য বয়কট করলেই বা কি; না করলেই বা কি? তাতে তাদের কি যায় আসে? 

এমন ভাবাটা একেবারে অমূলক নয়। একজন ক্রেতা বা ভোক্তা যদি পণ্য বয়কট করেন তাহলে কিন্তু বাহ্যত কোন ক্ষতিই পরিলক্ষিত হয় না। ধরে নিলাম, সারা বিশ্বে কেবল আমি  আপনি একজনই মাত্র একটা পণ্য বর্জন করলাম। তাতে পণ্যের উৎপাদনে যেমন হেরফের হবে না, তেমনই লাভেও না। তবে তাত্ত্বিকভাবে কিছুটা লোকসান তো হবেই; তা যতই ক্ষুদ্রতর হোক। মোটকথা হচ্ছে, যাররা পরিমাণ হলেও ক্ষতি হবে। এভাবে যদি বিশাল একটা অংশ ত্যাগ করে, তবে ক্ষতির সে শতাংশ বাড়তে থাকবে, তার প্রভাব উৎপাদনেও পরতে বাধ্য। 

অনেকটা বিন্দু বিন্দু জলের সাগরের মত। এক ফোঁটা কমলে কোন কিছুই কমে না, কিন্তু যদি এক ফোঁটা ফোঁটা করে কমতে থাকে একসময় পরিবর্তন চোখে পড়বেই। আমার ক্ষমতা তো অতটুকুই; নাকি? আল্লাহ তাআ'লা আমাকে তো ১০%, ৫০% বা ৭০% ক্ষতি করার সামর্থ্য দেননি। ফলে সেটা না করতে পারার জন্য আমাকে জিজ্ঞাসাও করবে না। কিন্তু আমার সামর্থ্য যতটুকু, ততটুকু যদি না করি, জিজ্ঞাসিত আমিই হবো; আপনি না। 

প্রিয় পাঠক, এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, কার কতটা ক্ষতি হলো, তা নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, আমার দায়িত্ব আমি কতটুকু পালন করলাম। কীভাবে আমার ঘৃণা প্রকাশ করলাম। আচ্ছা, এটা কি সম্ভব যে, যার দ্বারা আমার ভাই-বোন অত্যাচারিত হলো, আমি তার দোকান থেকেই  সদাইপাতি করি। শুনতে কেমন লাগল? কেউ যদি এমন করে আপনি তাকে নিশ্চয়ই সাধুবাদ জানাবেন না, তাই না? পণ্য বয়কটের মূল উদ্দেশ্য এখানেই। ক্ষতি কতটুকু, কি হলো সেটা গৌণ বিষয়।

হ্যাঁ ,আর্থিকভাবেও এই প্রতিবাদ কার্যকরী ; যদি সকলে মিলে এই কাজ করা যায়। এটা অসম্ভব কিছু না। এরূপ অনেক উদাহরণ আছে, নিকট অতীতেই। আমরা, মুসলিমরা যদি একটু ঈমানের চোখ দিয়ে তাকাই, তাহলেই সম্ভব। আর কে না জানে, ইয়াহুদীদের জোর অর্থের কারণেই। ফলে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে দেখলে নিশ্চয়ই তারা তাদের পলিসি পাল্টাতে বাধ্য হবে।

যাই হোক, একটা ঘটনা বলি....। এক ব্যক্তি কোকাকোলা, পেপসি পান করেন না। কারণ কোকাকোলা, পেপসি ইসরায়েলী পণ্য। তো কোনো এক অনুষ্ঠানে একজন তাকে খুব করে বললেন, তা পান করার জন্য। তিনি কিছুতেই পান না করায় সে বলল, ‘আপনি একজন খেলেই ইসরায়েলের কি লাভ, আর না খেলেই  কি লস-ক্ষতি?  অযথা নিজেকে বঞ্চিত বা কষ্ট না দিয়ে খেয়েই ফেলুন।’

উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি মানছি আমি একজন না খেলে কিছুই আসে যায় না। কিন্তু লাভ-ক্ষতি আমি দেখছি না। আমার সমস্যা হচ্ছে কোকাকোলা-পেপসি আমি খেতেই পারছি না। যখনই তা খেতে যাই, তখনই আমার চোখের সামনে ফিলিস্তিনী অসহায় শিশু-কিশোর, ভাই-বোনদের বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন রক্তমাখা লাশের টুকরো ভেসে ওঠে। আমার ভাই-বোনদের রক্ত লেগে আছে, এমন খাদ্য-পণ্য আমি কিভাবে খাই বা ব্যবহার করি?

এরপর সে আর একটা কথাও বলেননি। আসলে বলার কিছু থাকেও না। লাভ-ক্ষতি এখানে গৌণ; মুখ্য হচ্ছে অনুভূতি। এটা আদতেই চেতনার বিষয়, এতো গভীর আবেগে কেউ তাঁর ভাই-বোনকে ভালোবাসলে কেবল পানীয় কেনো, অনেক কিছুই ত্যাগ করা সম্ভব। এখন আপনার ভালোবাসা আপনার কাছেই থাকুক। আপনি কি পণ্য, কীভাবে ব্যবহার করবেন, তা আপনার হাতেই তোলা থাকল। ফিলিস্তিনী ভাই-বোনদের রক্তমাখা লাশের টুকরোকে উপেক্ষা করেও আপনি যদি তা ক্রয় করেন, ব্যবহার করতে পারেন তাহলে আমি হাজারো বার বললেই বা কি লাভ।

অনেকে বলেন, কতটি দেশের পণ্য বর্জন করবেন? ভারত, চীন, আমেরিকা, ফ্রান্স সবাই তো একই দোষে দোষী। এভাবে বয়কট করতে থাকলে কিছুই তো ব্যবহার করার উপায় নেই। খুবই যৌক্তিক প্রশ্ন। কিন্তু পণ্য বয়কটের ক্ষেত্রে তা মানানসই নয়। আপনি যতগুলো পারেন সবগুলিই বয়কট করেন। সেটা নির্ভর করছে আপনার ঈমান, আমল আর তাকওয়ার ওপর। সবগুলো যদি করতে পারেন, তাহলে তো নূরুন আলা নূর। আর যদি না পারেন যে কয়টি পারেন করুন।

এটা তো কোনো যুক্তি হতে পারে না যে, আমি যখন ভারতসহ অন্যান্য দেশের পণ্য বয়কট করছি না তাহলে ইসরায়েলেরটাও বয়কট করব না। বস্তুত এটা কোন বিধিবদ্ধ আইনের অধীন না, এটা নিতান্তই আপনার ইচ্ছার ওপর নির্ভর। আপনি প্রেফারেন্স তালিকা নির্ধারণ করে না হয় বয়কট করুন। হ্যাঁ, এটা আমরা বলি যে, বয়কট যেন হয়, ইসলাম, মুসলিম ও মানবতার স্বার্থে; নিজের কোনো স্বার্থের জন্য নয়।

প্রশ্নের দ্বিতীয়াংশে যা বলা হলো, সেটাও অনেকটা খোঁড়া যুক্তি। ইসলামে এর সমাধানও আছে। প্রথম কথা হচ্ছে, ঐসব দেশ থেকে যেসব পণ্য আসে তা জরুরি বা আবশ্যকীয় পণ্য নয়। বেশিরভাগই বিলাসদ্রব্য, আর তা নাহলেও এগুলোর বিকল্প পণ্য বেশ আছে। এগুলো তো আর ভাত-নুন-মাছ-ডাল-আলু-পেঁয়াজ-রসুন-মসলাপাতিসহ অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নয় যে, একেবারেই বর্জন করতে পারব না। সদিচ্ছা থাকলে তাদের পণ্য শতভাগ বর্জন সম্ভব বলে মনে করি।

তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, সে সব দেশের কিছু পণ্য এমন যে, এগুলো ছাড়া বাঁচার উপায় নেই, যদিও আমি এমন একটাও পাইনি।তাহলেও কোনো সমস্যা নেই। আপনি কেবল সেটাই ব্যবহার করুন, ততটুকু যতটুকু বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন। নিজের শখ মেটানোর জন্য নয়। যেমনিভাবে জীবন রক্ষার খাতিরে শর্তসাপেক্ষে রক্ত, শুকরের মাংস ইত্যাদি নির্দিষ্ট পরিমাণ খাওয়াও ইসলামে জায়েজ রয়েছে। সে হিসাবে এসব দেশের পণ্য তো আর মূলত নাজায়েজ নয়, বিশেষ কারণের প্রেক্ষিতে আপনি বর্জন করেছেন। ফলে জরুরি পরিস্থিতিতে সেসব পণ্য ব্যবহার করলে আপনার বয়কট ভঙ্গ হওয়ার কথাও আসে না। 

আবার এটাও দেখা যায় যে, যতদিন ইস্যু গরম থাকে ততদিন পণ্য বয়কট করা হলো। কিছুদিন পর আবার সেই আগের অবস্থা। তাহলে কি দরকার এভাবে লোক হাসানোর? এটা অনেকেই বলেন। আমি নিজেই অনেকের মুখে শুনেছি। হ্যাঁ, এটা বাস্তব যে, অনেকেই এমন করে থাকেন। এটা নির্ভর করে উনার ঈমানের দৃঢ়তা কতটুকু তার ওপর। তবে পরে আবার ব্যবহার করার সম্ভাবনা থাকবে বলে যে এখন বয়কট করতে পারবেন না, তা কিন্তু কোন কাজের কথা না। প্রথমত, যতদিন করলেন ততদিন তো সাওয়াব পেলেন, প্রতিবাদ করলেন। আর কে-ই বা বলতে পারবে যে, আপনি একেবারেই তা বর্জন করছেন না। সেটাও তো হতে পারে।

একটা উদাহরণ দিই, পাপ করতে অভ্যস্ত হলে কি তাওবা করার দরকার নেই। তাওবা করুন, পুনরায় পাপ হয়ে গেলে আবার তাওবা করুন। এভাবে একই পাপের জন্য একাধিকবার তাওবা করলেও আল্লাহ তা ক্ষমা করেন। হয়তে বলবেন যে, আমি জানি আবার পাপ করবো, তাতে তো তাওবা পুর্ণরূপে হয়ই না। হ্যাঁ, এটা সত্যি....আপনি যদি ভবিষ্যতেও সে পাপ করার ইচ্ছা ত্যাগ না করেন তাতে তাওবা যথাযথ হয় না। কিন্তু তাই বলে তাওবা ছেড়ে দেওয়াটা নিতান্তই মূর্খতা, এটা শয়তানেরই চালাকি। কেননা তাওবা শতভাগ না হলেও ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) তো হয়, বান্দা আল্লাহমুখী তো হয়। এভাবেই হয়তো কোনো একদিন খালিস তাওবা নসীব হবে।

আরো পড়ুন: বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে চীনের মহাপরিকল্পনা: কী বলছেন খাতসংশ্লিষ্টরা?

প্রিয় পাঠক, পণ্য বয়কটও তেমনই। যতদিন পারেন করেন, যতগুলো পারেন করেন। আপনার ঈমান যতদিন আপনাকে এ পথে চালায় ততদিন চলুন। আল্লাহর দিকে আপনার এই পদক্ষেপের দরুন আল্লাহর রহমত আপনার দিকে আরো বেশি করে অগ্রসর হবে, তাতে হয়ত আপনি বাকী জীবনও এমনিভাবে চলতে পারবেন। একটা কথা আমদের মধ্যে খুব প্রচলিত যে, “ইয়াহূদীদের পণ্য যদি বয়কট করতে হয়, তবে Facebook, Amazon, eBay, Google, IBM সহ সবই করুন। দেখি আপনাদের কত জযবা।’

ফলে আমাদের অনেকেই বয়কটের ব্যাপারে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পরে যান। অথচ এই কথা শুনতে যৌক্তিক মনে হলেও আসলে এর কোনো ভিত্তি নেই। অন্তত ইসলামী ব্যাখ্যানুসারে নেই। কেননা -সবাই সব পণ্য বয়কট করবে বা করতেই হবে এমন কোন নির্দেশনা নেই। বরং যার যার ক্ষমতা, সামর্থ্য ও সুযোগ বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। কেননা এটা ফরজে আইন নয়। এটা জিহাদের অংশ, ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতি ভালোবাসার-আবেগের প্রকাশ। ফলে যার ঈমান যতটুকু দাবি করে, তিনি ততটুকুই করবেন। যতদিন সম্ভব ততদিন করবেন।

হ্যাঁ, উত্তম হচ্ছে সবকিছু, সবসময়ের জন্য বয়কট করা। তবে কেউ না করতে পারলে তিনি মুসলিমই না এমন বলার কোন সুযোগ নেই; কেবল ঈমানের দাবি তিনি পরিপুর্ণভাবে পালন করেননি এটুকু বলা যায়। ‘নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ” করার নীতি ইসলামে নেই। একটু বুঝিয়ে বলি। উদাহরণ হিসেবে ফেসবুকই সম্ভবত আদর্শ। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, ফেসবুক ইয়াহূদীদের দ্বারা পরিচালিত, তাতে মুসলিমদের স্বার্থের অনেক হানি করা হয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ফেসবুকেতে আপনার আসার কারণ কী? তাতে লাভ কতটুকু আর ক্ষতি কতটুকু? যদি ফেসবুক ব্যবহারে কোনোরূপ হারামে জড়িত না হোন এবং আপনার নিয়ত যদি নেক হয় তবে ফেসবুক ব্যবহার ছেড়ে দিলে ইয়াহূদীদের যে ক্ষতি তাঁর চাইতে আপনার ক্ষতি বেশি। এটা পরিমাপ করবে শরয়ী বিধান। যেমন, আজ যদি ফেসবুক ব্যবহার না করতেন, তাহলে জানতেন কি, ফিলিস্তিনে কি হচ্ছে? জানতেন কি, এখন কি করা উচিত, কিংবা কখন মুসলিমরা সম্মলিতভাবে কি আন্দোলন করছে? সম্ভবত আমাদের বেশিরভাগই জানতেন না। 

অতএব, ঢালাওভাবে অন্য সব পণ্যের সাথে এসবের তুলনা করা মোটেও ঠিক নয়। কেননা, কোনো পাণীয় বা বিলাস দ্রব্য ত্যাগ করায় মুসলিম উম্মাহর একটুও  ক্ষতি নেই, তাছাড়া এসবের বিকল্পও আছে। অন্যদিকে ফেসবুকের বিকল্প যদি তৈরি করা যায় সেটাই সবচেয়ে উত্তম, না হওয়া পর্যন্ত সেটাকে নিজেদের কাজে লাগানোই বরং সময়ের দাবি। যেমন- দাওয়াতের কাজ করা, ইলম অর্জন করা, মুসলিম উম্মাহর, দেশের খবরাখবর জানা, নিজ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা ইত্যাদি।

রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেই উকায মেলায় যেতেন। কেন? মুশরিক বা অন্যরা যে উদ্দেশ্যে যেত, সে উদ্দেশ্যে নয়; বরং দাওয়াতের জন্য যেতেন। কারণ, তথায় গেলে নানান এলাকার লোকের কাছে সহজে দাওয়াত পৌঁছানো যেতো। ফেসবুকও অনেকটা এমন। নির্ভর করে আপনার নিয়ত ও সঠিক পদ্ধতি প্রয়োগের ওপর। তবে লক্ষ্য রাখা উচিত, এসব কাজে ফেসবুক ব্যবহার যেন আমাদের হারামে লিপ্ত না করে। কেননা, এসব কাজ করার আরো অনেক মাধ্যম আছে, ফেসবুক একমাত্র মাধ্যম নয়। ফলে একটি সহজ পথ অনুসরণ করতে গিয়ে হারামে জড়িয়ে পরার আশংকা থাকলে সে পথ ব্যবহারও হারামই হয়।

তাছাড়া অমুসলিমদের সকল পণ্য ব্যবহারই যদি নিষেধ হত, তবে যুদ্ধাস্ত্র, মোবাইল, বিমান এমন সবই তো নিষিদ্ধ হয়ে যেত। অথচ সেসব নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না। মূলত যেসব পণ্য সত্তাগতভাবে হালাল সেগুলো ব্যবহার করা হালাল, যদি তা প্রয়োজনীয় হয়, কিংবা উম্মাহর ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক কল্যাণে কাজে লাগে। আর যে সব পণ্য হারাম তা কেবল অমুসলিম কেন, মুসলিমের তৈরি হলেও হারাম।

এসবের আলোকেই ফেসবুক ব্যবহারের বিধান কার্যকর হবে। কেবল একটি নীতি জেনে তা নিয়ে তর্ক করা জ্ঞানীদের মানায় না। ফেসবুক যিনি কল্যাণের কাজে, প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করবেন তার জন্য জায়েজ। পাঠক খেয়াল রাখবেন, জায়েজ বা বৈধ বলছি – ওয়াজিব বা মুস্তাহাব, এমনকি উত্তম বলছি না। অন্যথায় যিনি হারামে লিপ্ত হয়ে পড়েন তাঁর জন্য, উম্মতের যত কল্যাণই তাতে চোখে পড়ুক, হারাম। সেক্ষেত্রে কল্যাণ-অকল্যাণ মূলনীতির আগে হালাল-হারাম মূলনীতি প্রযোজ্য হবে। 

হ্যাঁ, যদি কেউ তাকওয়ার কারণে সব কিছুই বর্জন করতে পারেন, তাঁর নিকট থেকে আমরা দোয়ার প্রত্যাশাই করি। আল্লাহ তাআ'লা আমার, আপনার, সকলের বয়কটকে ইসলাম ও মানবতার স্বার্থে কবুল করুক, সকল প্রকার রিয়া ও প্রদর্শনেচ্ছা থেকে হিফাযত করুক, আল্লাহুম্মা আমীন ইয়া রাব্বুল আলামিন।

 

(ফেসবুক থেকে নেওয়া)


সর্বশেষ সংবাদ