পুরান ঢাকার ৩ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংকট, প্রতিবছরই উপস্থিতি কমছে
- রায়হান উদ্দিন
- প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:৪৭ PM , আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:৪৭ PM

রাজধানীর পুরান ঢাকার তিনটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংকটে ভুগছে। প্রতি বছরই এসব স্কুল শিক্ষার্থী সংখ্যা কমছে। এমনকি উপস্থিতির সংখ্যাও ৪০-৬৫ শতাংশ। কোন ক্লাসে উপস্থিতির সংখ্যা ৩ জন। প্রাথমিকের শিক্ষকরা বলছেন, স্বচ্ছল ও স্থানীয় সামর্থ্যবানরা সরকারি স্কুলে ‘আত্মমর্যাদার’ কারণে তাদের বাচ্চাদের পড়াতে চান না। প্রায় ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী নিম্নবিত্ত পরিবারের। নানা অজুহাতে অনেকেই থাকে অনুপস্থিত। স্থানীয়রা বলছেন, ভালো মানের কিন্ডারগার্টেন, বেসরকারি স্কুল ও মাদ্রাসা থাকায় সরকারি স্কুলে পড়াতে চান না তারা।
আজ সোমবার (২১ এপ্রিল) পুরান ঢাকার সুরিটোলা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গোয়ালাঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও রাঁধাসুন্দরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেছে, এসব বিদ্যালয়ে যারা পড়াশোনা করছে, তাদের প্রায় সবাই নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।
গোয়ালাঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলতি বছরে ভর্তি হয়েছে ১৪৬ জন শিক্ষার্থী; ২০২০ সালে ১৬৮ জন, ২০২১ সালে ১৫২ জন, ২০২২ সালে ১৪৬ জন, ২০২৩ সালে ১৪৮ জন, ২০২৪ সালে ১৬০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হন। আর উপস্থিতির সংখ্যা ৬০ শতাংশ বলে জানা গেছে।
রাঁধাসুন্দরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০২৪ সালে ৮২ জন ও ২০২৩ সালে ৮৭ জন শিক্ষার্থী ভর্তি ছিল। আর চলতি বছরে ভর্তি হয়েছে মাত্র ৬৪ জন শিক্ষার্থী। আজ স্কুলটিতে প্রথম শ্রেণিতে ১৩ জনের ভেতর ১৩ জন উপস্থিত। দ্বিতীয় শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ১১ জনের মধ্যে উপস্থিত ৯ জন। তৃতীয় শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ১৬ জন, উপস্থিত ৯ জন। চতুর্থ শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ১১ জন, উপস্থিত ৩ জন এবং পঞ্চম শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ১৩ জন, উপস্থিত ৯ জন। উপস্থিতির সংখ্যা ৬৩ শতাংশ।
আরও পড়ুন: বৃষ্টি এলেই ক্লাস রুমে পানি, দিতে হয় ছুটি
সুরিটোলা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০০০ সালে ১ হাজার ২০০ জন শিক্ষার্থী ছিল, আর চলতি বছরে ৬৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। ২০২৪ সালে ৭০০ জন, ২০২৩ সালে ৬৫০ জন ও ২০২২ সালে ৮৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। তবে উপস্থিতি ৮০ শতাংশ রয়েছে বলে জানা গেছে।
প্রতিবছরই শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা কমছে, আমি যখন এ স্কুলে আসি তখনও অনেক শিক্ষার্থী ছিল, আর ২০০০ সালে প্রায় ১ হাজার ২০০ শিক্ষার্থী ছিল। আমাদের এখানে প্রচুর শিক্ষার্থী ভর্তি হতো। আমরা ভর্তির পরীক্ষার মাধ্যমে আগে শিক্ষার্থী ভর্তি করতাম। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি করেছি। আর এখন ডেকে এনে শিক্ষার্থী ভর্তি করছি। তবে আমাদের এ স্কুলে উপস্থিতি ৮০ শতাংশ থাকে। এটা একটা ভালো দিক। আবারও বৃত্তি পদ্ধতি চালু করা দরকার, এতে শিক্ষার্থীরা উৎসাহিত হবে — জুবাইদা আক্তার মিতা, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, সুরিটোলা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
প্রাথমিকের শিক্ষকরা জানান, রাজধানীর সরকারি প্রাইমারি স্কুলে যারা পড়েন তাদের অধিকাংশই দিন এনে দিন খায়, এমন পর্যায়ের লোকজন। তবে ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী আছে, যাদের বাবা-মা সচেতন। ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থীই নিম্নবিত্ত পরিবারের। আর আত্মমর্যাদার কারণে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাদের বাচ্চাদের ভর্তি করাতে চান না পুরান ঢাকার স্থানীয় ও স্বচ্ছল পরিবারের অভিভাবকরা। তারা জানান, এসব স্কুলে শিক্ষকদের যোগ্যতা নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই, তবে সরকারি স্কুলের থেকে আরও ভালো মানের বেসরকারি স্কুল ও ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতে আগ্রহী তারা। এমনকি বেসরকারি স্কুলে এক্সাট্রা কারিকুলাম পাচ্ছেন। পাশাপাশি আত্মমর্যাদার একটা বিষয় থেকে তারা সরকারি স্কুলে বাচ্চাদের ভর্তি করাতে চান না অভিভাবকরা।
পুরান ঢাকার ৩ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ছবি: টিডিসি
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১ লাখ ১৪ হাজার ৬৩০টি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৫৬৭টি। আর ঢাকা মহানগরীতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৪২।
গোয়ালাঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শরমিন আক্তার দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আত্মমর্যাদার কারণে সরকারি স্কুলে স্থানীয় ও স্বচ্ছল পরিবারের অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের পড়াতে চান না। তাদের সাথে বেশ কয়েকবার মিটিং করেও তাদের কাছ থেকে সাড়া পাচ্ছি না। আমাদের এখানে যতগুলো বাচ্চা পড়ছে, তাদের ৯৫ শতাংশই নিম্নবিত্ত পরিবারের। তবে ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী আছে যাদের বাবা-মা সচেতন ও সচ্ছল। আমার সন্তানও সরকারি স্কুলে পড়াশুনা করছে।’
আরও পড়ুন: মাদ্রাসায় ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তিতে বয়স নির্ধারণ
সুরিটোলা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জুবাইদা আক্তার মিতা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমাদের স্কুলে সাধারণত নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানেরই পড়াশুনা করছে। তবে খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থী আছে যারা মোটামোটি স্বচ্ছল পরিবারের। কিন্ডারগার্টেন, প্রাইভেট স্কুল ও মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হচ্ছে। মাদ্রাসাগুলোতে বাংলা, ইংরেজি পড়তে পারার কারণে অভিভাবকরা তাদের বাচ্চাদের ভর্তি করছে। আর পুরান ঢাকার স্বচ্ছল পরিবারের সন্তানরা ইংলিশ মিডিয়াম ও ভার্সনে ভর্তি হচ্ছে।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মনিরা জাহান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘কিন্ডারগার্টেন, বেসরকারি স্কুল ও মাদ্রাসাগুলোতে ছেলে-মেয়েরা ভর্তি হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানে কী ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থা রেখেছে বা কীভাবে বাচ্চাদের পড়াচ্ছে যা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হচ্ছে না, তা গবেষণা করা দরকার। যদি তাদের পদ্ধতি কার্যকর হয়ে থাকে তাহলে প্রাথমিকেও পরিবর্তন বা পরিমার্জন করা যেতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সবার উদ্দেশ্যেই সব বাচ্চাকে একাডেমিকের পাশাপাশি আচরণগত শিক্ষা দেওয়া। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কারিকুলামগুলো সেভাবেই সাজানো রয়েছে। আর স্বচ্ছলরা আরও ভালো সুবিধা পেতে হয়তো কিন্ডারগার্টেন বা বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করাচ্ছে এবং মাদ্রাসায় ধর্মীয় চিন্তাভাবনা ও সাধারণ শিক্ষা পাচ্ছে বলে সেখানে তাদের বাচ্চাদের দিচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে যদি নতুন কিছু আমরা পেয়ে থাকি, তাহলে প্রাথমিকের কারিকুলামেও যুক্ত করা যেতে পারে। তবে গবেষণা সাপেক্ষে এসব বিষয় যুক্ত করতে হবে।’