আধুনিক বিজ্ঞান ও রমজান
- মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক
- প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২১, ০১:৫৫ PM , আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২১, ০১:৫৫ PM
আল্লাহ প্রদত্ত ইসলাম মানবজাতির পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। যার প্রতিটি বিধান কল্যাণকর মানব-দানব সবার জন্য। দিনভর রোজা ও রাতভর ইবাদত বন্দেগি করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে ইবাদতের বসন্তকাল মুসলিম উম্মাহ রমজান মাসে আত্মসংযমের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জন করে থাকেন। দীর্ঘ এগারটি মাস পরে রমজানের সিয়াম সাধনায় মানবদেহের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা কু-রিপুগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যায় এবং রোজার প্রভাবে মানবের ভেতর-বাহির কালিমামুক্ত হয়ে রোজাদার ব্যক্তি একজন খাঁটি মানুষে পরিণত হয়ে যায়; মানুষের কৃত পাপগুলোকে পুড়িয়ে ফেলে দেয় এবং তখন তার অবস্থান নিষ্পাপ-মাসুম ফেরেশতাদের উপরে চলে যায়। তাই তো কালের পালাবদলে ইসলাম নোঙ্গর ফেলেছে পৃথিবীর দুয়ারে দুয়ারে। প্রতীয়মান হয়েছে ইসলামের সৌন্দর্য ও নানাবিধ কল্যাণ।
রমজানের রোজা ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের অন্যতম। রমজানের রোজা মুসলমানের উপর ফরয করা হয়েছে। রোজার ব্যাপারে কুরআন-হাদিসে ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ইসলামের পূর্বেও রোজার প্রচলন ছিল। কিন্তু অবাধ স্বাধীনতার ফলে রোজার ভাবমূর্তি ও প্রাণশক্তি নষ্ট করা হয়েছিল। আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যমকে অন্তঃসারশূন্য করে নিছক এক অনুষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছিল। এমন পরিস্থিতি থেকে মুক্ত করে আবার আত্মিক ও নৈতিক ইবাদতে পরিণত ও সুন্দর করে আল্লাহ উম্মতে মোহাম্মদীর উপর ফরয করে দেন।
বিজ্ঞানসম্মত রমজানের ইবাদতকে অযৌক্তিকভাবে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে দেখা যায়। অনেকের ধারণা রোজা বিজ্ঞানসম্মত নয়। কিন্তু আধুনিক যুগের চিকিৎসা বিজ্ঞান রোজার ব্যবহারিক তাৎপর্য উপলব্ধি করে তার সত্যতা প্রমাণ করেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নত গবেষণার ফলে জানা যায়, রোজার নানাবিধ উপকারিতার কথা। রোজা পালন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। বরং রোজা রোগমুক্তির বিশেষ ওষুধ এবং সুস্থ হওয়ার বিরাট নিয়ামত। তাই ইউরোপের ঘরে ঘরে বর্তমান সময়ে রোজা রাখার হিড়িক পড়েছে। সবার মুখে শোনা যাচ্ছে-শরীরটাকে ভালো রাখতে চাও তো রোজা রাখ। জার্মানির স্বাস্থ্য ক্লিনিকের ফটকে বড় অক্ষরের টাঙানো আছে- রোজা রাখ, স্বাস্থ্যবান হবে।
প্রখ্যাত চিকিৎসক ইবনে সিনা তাঁর রোগীদের ৩ সপ্তাহের জন্য উপবাস পালনের নির্দেশ দিতেন। কারণ, বছরে ১ মাস রোজা রাখার কারণে মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতঙ্গের বিশ্রাম ঘটে। সকল বিষয়ে বিশ্রাম অনিবার্য। মানুষের শরীরে এক প্রকার জৈব বিষ জমাট হয়। এই জৈব বিষ দেহের স্নায়ু এবং অন্যান্য জীব কোষকে দুর্বল করে দেয়। এক মাসের রোজার ফলে এই জৈব বিষ দূর হয়ে যায়।
রোজা দেহের রক্ত প্রবাহকে পরিশোধন করে। রোজা মানুষের হাইপারটেনশন কমাতে সাহায্য করে। পেট ভর্তি করে খাওয়া অপেক্ষা মানুষের জন্য মন্দ দ্বিতীয় কোনো কাজ নেই। আদম সন্তানের টিকে থাকার জন্য কয়েক লোকমাই যথেষ্ট। পেটের এক-তৃতীয়াংশ পানি এবং এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য খালি রাখা উচিত (আহমদ ইবনে মাযাহ)। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, দীর্ঘজীবন লাভের জন্য খাওয়া-দাওয়ার প্রয়োজন বেশি নয়; বরং পরিমিত খাওয়াটাই দীর্ঘজীবন লাভের চাবিকাঠি।
আধুনিক বিজ্ঞানে রোজার প্রতি চেতনা সৃষ্টি করার পেছনে বিখ্যাত জার্মান চিকিৎসাবিদের মতে, মানুষের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গঠন ও কার্যপ্রণালি বিশ্লেষণ করে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হলে বছরে কতিপয় দিন উপবাসের অভ্যাসের কথা বলেছেন। তাদের মতে, উপবাস খাবারের উপাদান থেকে সারা বছর শরীরে জমে থাকা বিষাক্ত পদার্থ (টক্সিন), চর্বি ও আবর্জনা থেকে মুক্তি দান করে। শরীরের জমে থাকা বিষগুলো রমজানে নির্গত হয়, যা ধ্বংস না হলে শরীরে উচ্চ রক্তচাপ, একজিমা, পেটের পীড়া ইত্যাদি রোগ জন্ম নেয়। উপবাসে কিডনি ও লিভারের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
রোজা রাখলে শরীর দুর্বল হয়, মাথায় চক্কর দেয় কিংবা ঘুমের প্রকোপ বেশি হয় বলে যেসব কথা প্রচলিত রয়েছে, তা ভুল প্রমাণ করেছেন মিসরের জাতীয় গবেষণাগারের প্রাণ-রসায়ন বিষয়ের শিক্ষক ডাক্তার মোহাম্মদ সাইয়েদ। তিনি বলেন, রোজার মধ্যে দিনের খাদ্য গ্রহণ না করায় শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা আলফা-১ ও গামা নামক প্রোটিন বৃদ্ধি পায়। ফলে তা ক্যালসিয়াম জমতে বাধা দেয়। আর ক্যালসিয়াম জমেই সৃষ্টি হয় পাথর। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে, রমজানে তা গঠিত হতে পারে না। রাশিয়ার শরীর বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডাক্তার ডি. এন. নাকিটন বলেছেন, ‘তিনটি নিয়ম পালন করলে শরীরের বিষাক্ত দ্রব্যাদি বের হয়ে যাবে এবং বার্ধক্য থামিয়ে দিবে। তা হলো, অধিক পরিশ্রম করা, অধিক পরিমাণে ব্যায়াম করা এবং প্রত্যেক মাসে একদিন উপবাস থাকা।’
আধুনিক মুসলিম গবেষকগণ বলেন, পেপটিক আলসার রোজার কারণে তাড়াতাড়ি ভালো হয়। রোজার কারণে পাকস্থলী খাদ্যমুক্ত থাকে। এ সুযোগে পাকস্থলীর ক্ষতস্থান বা আলসার নিরাময়ে লেগে যায়। পাকস্থলী খালি হওয়া মাত্রই তার ক্ষয় পূরণ এবং পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়। এভাবে দীর্ঘ এক মাসের রোজা মানুষের পেপটিক আলসার রোগ নিরাময় করতে সাহায্য করে। অনিয়মিত খাবার, অত্যধিক চা পান, ধূমপান, দুশ্চিন্তা ও টেনশন পেপটিক আলসার সৃষ্টি করে। নিয়মিত রোজা পালনের কারণেই পেপটিক আলসার থেকে মানুষের মুক্তি পাওয়া সম্ভব। নিয়মিত পেট খালি রাখলে এবং নিয়মিত আহার করলে পেটে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যাতে আলসার বা ক্ষত শুকাতে সহায়ক হয়।
বিশিষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডাক্তার অ্যালেক্স হেইগ বলেছেন, ‘সিয়াম হতে মানুষের মানসিক শক্তি এবং বিশেষ বিশেষ অনুভূতিগুলো উপকৃত হয়, স্মরণ শক্তি বাড়ে, মনোযোগ ও যুক্তি শক্তি পরিবর্ধিত হয়, প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা, সহানুভূতি, অতীন্দ্রিয় এবং আধ্যাত্মিক শক্তির উন্মেষ ঘটে। ঘ্রাণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি বেড়ে যায়। রোজা খাদ্যে অরুচি ও অনীহা দূর করে। সিয়াম শরীরের রক্তের প্রধান পরিশোধক। রক্তের পরিশোধন এবং বিশুদ্ধি সাধন দ্বারা দেহ প্রকৃতপক্ষে জীবনীশক্তি লাভ করে। যারা রুগ্ন তাদেরকেও রোজা পালন করা উচিত’।
ইসলামে রোজা রাখার ব্যাপারে কোথাও অতি ভোজনের উল্লেখ নাই। সব সময় পরিমিত ও পুষ্টিকর খাবারের কথা বলা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, পেটের তিনভাগের একভাগ খাবার, একভাগ পানীয় দিয়ে পূরণ করতে। অপর ভাগ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য খালি রাখতে বলেছেন। আর বর্তমান মেডিক্যাল সাইন্সও সেই কথাই বলে। রমজানে সারাদিন অভুক্ত থেকে কেউ কেউ অতিরিক্ত এবং বাজে খাবার খেয়ে ক্ষেত্র বিশেষে অসুস্থ হয়ে পড়েন। আর এই সুযোগটিই কাজে লাগান কিছু মানুষরূপী জ্ঞানপাপী শয়তান। আর একে কেন্দ্র করে রোজার ক্ষতিকারক দিকগুলো প্রচার করে মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়। অথচ রোজায় ফ্যাট বা কোলেস্টেরল কমায়, এজিং প্রসেস ব্যাহত করে। শরীরের ডিটক্সিফিকেশন করে ও ইম্যুনিটি বৃদ্ধি করে, হজমতন্ত্রের এসিড নিঃসরণ কমায়, কিডনি স্টোন হওয়ার ঝুঁকি কমায়, নন ইনসুলিন ডিপেন্ডেন্ট ডায়াবেটিস কমায়, হার্ট আর্টারি প্রেশার এবং লিভার আর্টারি প্রেশার কমায়। রোজা রোগ প্রতিরোধ ও সুস্থ থাকার অন্যতম উপায়।
বিজ্ঞানের উন্নতিতে আজ পুরো পৃথিবী জানতে পারছে, ইসলামই হচ্ছে সুখ ও কল্যাণের চাবিকাঠি। আসুন, জীবনে সফলতা লাভের উদ্দেশ্যে রোজা রাখার নিয়তে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। আর তাতেই নিহিত আছে মানুষের আরোগ্যলাভের উত্তমপন্থা। সিয়াম সাধনায় আমরা হব স্বাস্থ্যবান ও পবিত্র আত্মার অধিকারী। আল্লাহ আমাদের রমজানের রোজা ভালোভাবে আদায় করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক