পিতা-কন্যা সম্পর্ক: বিজ্ঞান ও ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

  © প্রতীকী ছবি

সাধারণত ‘বাবা’ মানেই রাশভারী একজন পুরুষ। অন্তর পর্দায় এই মানুষটিকে ঘিরে থাকে ভয়, রাগ, শাসন আর গাম্ভীর্য। আসলেই কী তাই? একজন কন্যা সন্তানের কাছে বাবা মানে এক আকাশ নির্ভরতা এবং রাশি রাশি আস্থার অনুভূতি নয় কি? সত্যিকার অর্থে বাবা বনাম কন্যার সম্পর্ক সব সময়ই যেন এক রৈখিক ও আলাদা কিছু। এ যেন একে অপরারের জন্য শ্রষ্ঠার শ্রেষ্ঠ দান।

কন্যার কাছে বাবা হলেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা এ্যাঞ্জেল। বাবাই কন্যার বড় দার্শনিক ও বন্ধু। এ্যাঞ্জেল আর দার্শনিকের মধ্যেই কন্যার প্রত্যাশা সিমীত থাকে না। এসব ছাপিয়েও কন্যার কাছে বাবা মানেই আদর, স্নেহ, নিঃস্বার্থ পবিত্র ভালোবাসা, অনুপ্রেরণা, নির্ভরতা, আস্থা, আত্মবিশ্বাস ও মান-অভিমান। বাবা যেন মাথার ওপর শীতল কোমল ছায়া। বাবার কাছে কন্যা হল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান- ‘আয় রে আমার কাছে আয় মামণি, এ হাতটা ভালো করে ধর এখনই...’। কন্যাই বাবার আনন্দ, প্রশান্তি এবং চিরায়াত নির্মল সুখ। অর্থাৎ একে অপরের জান ও জীবন।

পিতা-কন্যার এই চিরায়াত মায়া, ভালোবাসা, হৃদ স্পন্দন, নির্ভরতা বা টান যাই বলিনা কেন, কোথা থেকে তা আসে? যা অন্য কারো ক্ষেত্রে হয় না? এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাবা-মায়ের মস্তিষ্ক ছেলে বা মেয়ে সন্তানের প্রতি সমান সাড়া ফেললেও মেয়ে সন্তানের প্রতি বাবা’র আবেগ অনুভূতির কম্পন ভিন্ন। ফলে বাবার প্রতি ছেলে সন্তানের চাইতে মেয়ে সন্তান বেশি অনুরক্ত হয়।

আমেরিকান সাইকোলজিকল অ্যাসোসিয়েন’য়ের ‘বিহেইভিয়র নিউরোসায়েন্স’ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণার ফলাফল বলছে- বাবা তার পুত্র সন্তানের চেয়ে কন্যা সন্তানকে আলাদাভাবে গুরত্ব দেয়। কন্যা সন্তানের সঙ্গে যোগাযোগ করার সময় বাবার মস্তিষ্কে ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া করে। এটাও দেখা যায় যে, কন্যা সন্তানের প্রতি বাবার অভিব্যক্তিগুলো ছেলে শিশুর তুলনায় বেশি কাজ করে। বাবারা তাদের কন্যা সন্তানের প্রতি বেশি উৎসাহী এবং কন্যার আবেগের প্রতি বেশি খেয়াল রাখে। কান্না করলে কন্যা সন্তানের বাবারা পুত্র সন্তানের বাবাদের চেয়ে দ্রুত প্রতিক্রিয়া করে ও মনযোগ দেয়। এই গবেষণায় দাবী করা হয়, পুত্র সন্তানের বাবারা অনেক সময় বুঝতেই পারে না যে তারা তাদের পুত্র সন্তানের দিকে কম মনযোগ দিচ্ছে এবং তাদের সঙ্গে আবেগের দিক থেকেও কম জড়িত।

অপরদিকে একজন কন্যার কাছে পিতা কেমন সে বিষয় গবেষণায় দেখা গেছে, বাবার প্রতি প্রতিটা কন্যা সন্তানের ভালোবাসা আর যত্নের ধরণ হয় আলাদা। কারণ মেয়েরা বাবার প্রতি বেশি অনুরক্ত হয়। কন্যা সন্তানের বাবা হিসেবে এসব কারনেই একজন বাবা সব সময় নিজেকে একজন বিশেষ কেউ অনুভব করবেন। আর এটা এমন একটা অনুভুতি যা কেবল একজন কন্যা সন্তানের বাবাই অনুভব করতে সক্ষম।
মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় যখন ওই উপসংহারে আসলো তাহলে এবার দেখা যাক পিতা-কন্যা সম্পর্ক নিয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী? আল্লাহ পবিত্র কোরআনে সূরা আন-নাহলে কন্যা সন্তানকে সুসংবাদ বলে উল্লেখ করেছেন। ইসলামী পন্ডিতরা মনে করেন স্বং আল্লাই পিতার অন্তরে কন্যা সন্তানের প্রতি বিশেষ ভালবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) কন্যাদের খুব মহব্বত ও স্নেহ করতেন। হযরত আবদুল্লাহ উমর (রা.) থেকে বণিত রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ওই নারী বরকতময়ী ও সৌভাগ্যবান, যার প্রথম সন্তান মেয়ে হয়। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বণির্ত, রাসুল (সা.) বলেছেন- ‘যার ঘরে কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলো, অতঃপর সে ওই কন্যাকে কষ্ট দেয়নি, মেয়ের উপর অসন্তুষ্টও হয়নি এবং পুত্র সন্তানকে তার ওপর প্রধান্য দেয়নি, তাহলে ওই কন্যার কারণে আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতে প্রবশে করাবেন।’ (মুসনাদ আহমদ)

হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর সিরাত গ্রন্থ (জীবনী গ্রন্থ) থেকে জানাযায়, রাসূল (সা.) যখন কোনো সফরে যেতেন, সবশেষে ফাতেমা (রা.) আনহার সাথে দেখা করে যেতেন। আবার যখন সফর থেকে ফিরে আসতেন, সর্বপ্রথম ফাতেমা (রা.) আনহার সাথে দেখা করতেন। হযরত আয়শা (রা.) বলেছেন, ‘যখন রাসুল (সা.) ফাতেমাকে দেখতে আসতেন, তিনি তাকে অভ্যর্থনা জানাতেন, দাঁড়িয়ে ফাতেমাকে চুমু খেয়ে তাঁর হাত ধরে নিয়ে আসতেন এবং তিনি যেই স্থানে বসতেন ফাতেমাকে সেখানে বসাতেন।’ রাসুল (সা.) একদা বলেছেন, ‘যে ফাতেমাকে খুশি করলো সে যেন আল্লাহকেই খুশি করলো, আর যে ফাতেমাকে রাগান্বিত করলো সে যেন আল্লাহকেই রাগান্বিত করল। ফাতেমা আমার একটি অংশ। যা তাকে খুশি করে তা আমাকেও খুশি করে আর যা তাকে রাগান্বিত করে তা আমাকেও রাগান্বিত করে।’ (বুখারি এবং মুসলিম)

অপরদিকে কন্যা ফাতেমা পিতা রাসুলকে (সা.) কতটা ভালবাসতেন সে সর্ম্পকেও সিরাত গ্রন্থে বর্ণনা পাওয়া যায় যে, যখন ফাতেমার বয়স ১০ বছরের কাছাকাছি, তখন একদিন রাসুল (সা.) মসজিদ-উল-হারামে নামাজ পড়া অবস্থায় আবু জাহেলের নির্দেশে তার লোকজন মৃত পশুর নাড়িভুঁড়ির নোংরা আবর্জনা সেজদারত রাসুলের কাঁধে ছুড়ে দেয়। কিন্তু এই কোমল বয়সেও ফাতেমা (রা.) বাবাকে লজ্জার কারণ হতে দেন নি। বাবার প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও সম্মান দেখিয়ে, ফাতেমা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। নামাজরত পিতার শরীর থেকে আবর্জনা ফেলে দিয়ে রাসুল (সা.) এবং কাফিরদের মাঝে প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।

সিরাত গ্রন্থ থেকে আরো জানাযায় যে, রাসুল (সা.) মৃত্যু যন্ত্রনার সময় হযরত ফাতেমা (রা.) পিতার শিয়রের পাশে বসে বাবার জন্য কষ্ট পাচ্ছিলেন। এ অবস্থায় রাসূল (সা.) ফাতেমাকে কাছে নিয়ে চুমু খেলেন এবং তাঁর কানে কানে কিছু বললেন। ফাতেমা কেঁদে দিলেন। অতঃপর আবার রাসুল (সা.) তার কানে ফিস ফিস করে কিছু বললেন এবং ফাতেমা হেসে দিলেন। হযরত আয়শা তা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি একই সাথে হাসলে এবং কাঁদলে ফাতেমা? আল্লাহ্‌র রাসুল তোমায় কী বলেছেন?” ফাতেমা উত্তর দিলেন, “ প্রথমে তিনি বলেছেন যে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি তাঁর রবের সাথে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছেন, তাই আমি কেঁদেছিলাম। তারপর তিনি বললেন, ‘কঁদো না, আর আমার পরিবারের মধ্যে তোমার সাথেই আমার প্রথম সাক্ষাত হবে’। আর তাই আমি হেসেছি।’

পরিশেষে মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণা এবং ইসলামী দৃষ্টভঙ্গি বিশ্লেষণ শেষে পিতা-কন্যার সম্পর্ক নিয়ে একটা উপসংহারে আসার চেষ্টা করা যেতে পারে। তা হচ্ছে- একজন কন্যা সন্তানের কাছে বাবা তার জন্য সম্পূর্ণ একটা ‘পৃথিবী’। আর সেকারণেই সে তার এই ‘পৃথিবীর’ যত্ম আর দেখাশোনায় কোন কমতি রাখেনা। বাবাকে খুশী করতে তার ভালো মন্দের খোঁজ রাখতে এমনকি বাবার হয়ে অন্য সবার সাথে লড়তে একজন কন্যা সন্তানের কখনো ক্লান্তি আসেনা। তাই কন্যা সন্তানের বাবা কখনই নিজেকে দুর্বল বা অসুরক্ষিত ভাবার সুযোগ পায় না। একজন কন্যার কাছে তার বাবাই সবচেয়ে সেরা মানুষটি বলে বিবেচিত হয়। অনেকটা সুপার হিরোদের মতো। আর সেকারণেই একজন কন্যা সন্তানের বাবা সেরা প্রশংসাটি কেবল কন্যা সন্তানের কাছে থেকেই শোনা যায়। সুতরাং একজন বাবা বা একজন কন্যার জীবনে এরচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত আর আসতে পারে না।

*লেখক: ইংরেজি শিক্ষক, বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, নির্ঝর। 


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence