সাম্প্রতিক বিবেচনায় কিছু সহজ স্বীকারোক্তি

জুবায়ের রহমান
জুবায়ের রহমান  © টিডিসি ফটো

তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্র দেশ হিসেবে আমরা তলাবিহীন ঝুড়ি বলে বিশ্বে পরিচিত হয়েছি বহুপূর্বেই। কিন্তু কোন এককালে আমরা এমন ছিলাম না। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ভিক্ষুকের মত বিভিন্ন প্রকার দান-সহযোগিতায় দেশকে চালাতে হয়েছে। এজন্যই বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ১১ জানুয়ারি বলেছিলেন, ‘বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে আমাকে আনতে হয়, আর এই চোরের দল আমার দুঃখী মানুষের সর্বনাশ করে এভাবে লুটতরাজ করে খায়।’ অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হলেও আজও সে পথেই চলছি আমরা।

অথচ একসময় আমরা পুরো বিশ্বকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতাম। বিভিন্ন দেশে খাদ্য, বস্ত্রসহ বিভিন্ন দ্রব্য রপ্তানির মাধ্যমে বিশ্ব বাণিজ্যকে চাঙ্গা রাখতাম। পুরো বিশ্বকে খাবার তুলে দিলে তারা খেত। ফসল ভাল ফলত বলে এখানে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বণিক শ্রেণী এসে বস্তি গড়েছে। যার ফলে আজ আমরা একটা সংকর জাতিতে পরিণত হয়েছি। অথচ আজ সেই দেশই অসহায় হয়ে পড়েছে বিশ্বের কাছে। আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনের কয়েকটি কারণ রয়েছে।

মধ্যযুগের বিশ্ব বানিজ্যের নাম করে করে সারা বিশ্বে শাসন-শোষণ শুরু করে ইউরোপিয়রা। পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দ্যা-গামা ভারতের কালিকট বন্দরে প্রথম আসে ১৪৯৮ সালে। সময়ে সময়ে যারা বাণিজ্য করতে এই ভূখন্ডে আসে তাদের মধ্যে প্রথম কাতারে নাম আসে পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ডাচ, ফরাসি, ব্রিটিশদের নাম। তখন থেকেই তাদের মধ্যে ব্যবসা কেন্দ্রিক একটা প্রতিযোগিতা ছিল ভারতবর্ষেকে ঘিরে। বাংলায় ইউরোপীয় বণিকদের মধ্যে প্রথম এসেছিল পর্তুগিজরা। সেটা প্রায় ১৫৮০ সালের দিকে।

তখন থেকেই ইউরোপিয়রা ব্যবসায়ীক ঘাঁটি স্থাপন করে নিজেদের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে থাকে। সেই সাথে অন্যান্য বণিক শ্রেণীর সাথেও যুদ্ধ করে চলতে হতো। সর্বশেষ নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এই ভারতবর্ষে টিকে থাকে শুধু ব্রিটিশরা। এটা হয়ত সবারই জানার বিষয়। কিন্তু ভাববার বিষয় হচ্ছে সেটা, যখন থেকে তারা ক্ষমতা দখল করে। তারা ছলে-বলে-কৌশলে লুটতরাজ করতে থাকে। যার সংস্কৃতি আজও চালু রয়েছে। ১৯৪৭ পর্যন্ত তারা শোষণ করে।

বিশ্বকে নিমন্ত্রণে খাওয়ানো জাতি তখন থেকে বিশ্বের কাছে ভিক্ষার থালা নিয়ে ঘুরা জাতিতে পরিণত হয়। তারপর পাকিস্তানি শাসন-আমল আরও অসহায় করে দেয় এই জাতিকে। দারিদ্রতার হার নেমে আসে প্রায় ৭০ ভাগ মানুষের উপরে। তারপরে শেখ মুজিবের শাসনামলে যখন তিনি বিভিন্ন সাহায্য সহযোগীতা নিয়ে রাষ্ট্রকে পরিচালনা করতে থাকেন, তখন চাটার দলেরা চেটে চেটে সেই সম্পদ লুট করেছে। মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা বাজারে নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সংকট তৈরি করে অধিক মুনাফা গ্রহণ করতে থাকে।

ফলে অচিরেই অনেকে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে। জীবনের শেষ সময়ে তিনি তাদের বিরুদ্ধে হুংকার দিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু তাদের শায়েস্তা করতে পারেনি। সেই চাটার দলেরা আজও চেটে খাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু কন্যার শাসনামলেও তারা থেমে নেই।

হয়ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও চলে যাবে, কিন্তু এই লুটতরাজ করে খাওয়া মানুষরা ঠিকই থেকে যাবে। যার ফলে সমান হারে ধনীও বাড়ে, দরিদ্রও বাড়ে। তাইতো সমগ্র বিশ্বে ধনী বৃদ্ধির দিক থেকে আমরা বিশ্বে তৃতীয়। সুইস ব্যাংক হয়ত কয়েকদিন বাদে এদের দখলেই চলে যাবে। (কুমিল্লা সেনানিবাসে ১৯৭৫ এর ১১ জানু. বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও শেখ হাসিনার আমলে বালিশ কান্ডের মত ঘটনা)

বহুকাল ধরেই জেনে আসছি চোর দুই প্রকৃতির হয়। স্বভাবগত চোর ও অভাবগ্রস্থ চোর। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশে উভয় সংখ্যক চোরের সংখ্যা তুলনামূলক সমান। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে চোরের আনুপাতিক পরিবর্তন হচ্ছে। অভাবগ্রস্থ চোরের সংখ্যা কমে গিয়ে উল্লেখযোগ্য হারে স্বভাবগত চোরের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এটা বলে রাখা ভাল যে, অভাবের তাড়নায় যারা চুরি করে তাদের চোর বলতে আমার কন্ঠে বাঁধে। এই সমস্ত লোক চুরি করার পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে খেয়ে বেঁচে থাকার তাগিদ। সমাজের নিষ্ঠুরতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা কিংবা কর্মসংস্থানের অভাবের ফলে সমাজে এই শ্রেণীর উদ্ভব। তাই তাদের কিছু খোঁচা মেরে বলতেও বাঁধে। তাছাড়া ছিঁচকে চোর, ডাকাত, সন্ত্রাস এদের কর্মকান্ড সরকারী হস্তক্ষেপে কমে এসেছে। ক্রসফায়ার নামক বিচারহীন ব্যবস্থার মাধ্যমে পুলিশ প্রশাসনের কয়েকটি কর্মকান্ড এই শ্রেণীর মনের মধ্যে যথেষ্ট ভীতি ‌অর্জন করাতে সক্ষম হয়েছে। যদিও রাঘব বোয়ালরা ধরা ছোয়ার বাইরে থেকে গেছে এখনো।

কিন্তু স্বভাবগত চোর সম্পর্কে অনেক কটু কথা বলতে চাই। কিন্তু পরক্ষণে আবার কন্ঠতে বিধে যায় এই ভেবে যে, যদি মানহানির মামলা ঝুলিয়ে দেয়। কারণ এই শ্রেণীর রহস্যময় প্রাণী গুলো হয়ে থাকে জনপ্রতিনিধি ও উচ্চশিক্ষিত। তাদের একপক্ষের যেমন আছে কলমের জোর, তেমনি আরেকপক্ষের আছে ক্ষমতার জোর। দিনশেষে এটাও একটা বার্তা যে, তারা উভয়ে সম্মিলিতভাবেই দেশটাকে চেটেপুটে খাচ্ছে। যা বলে দেয় যে, একে অপরকে প্রোটেকশন দিয়ে দেয় সহজে।

বর্তমান বিশ্বের এই নাজুক পরিস্থিতিতে যখন কর্মহীন হয়ে পড়েছে মানুষ, তখন সরকারীভাবে অসহায় মানুষের মধ্যে আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে কর্মহীন গরীব মানুষের মত নাম চলে আসে অনেক এলিট সম্প্রদায়ের মানুষের। যা আমরা বিভিন্ন পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি। সরকার যদি গরিবদের জন্য ২ টাকা করে দেয়ার ঘোষণাও দেয় দেখবেন এরা তাদের বাবা-মা, ভাই, বোন, থেকে শুরু করে ১৪ গোষ্ঠীর নাম দিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ এই সকল স্বভাবগত চোর সম্প্রদায় তারা ছলে-বলে-কৌশলে যে করেই হোক না কেন মানুষের অধিকার মেরে নিজের পকেট ভরবেই।

গত তিনদশকে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ছাত্ররাজনীতি। সেই সাথে এটাও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে জোর যার মুল্লুক তার। সেই সাথে ছাত্রদের মধ্যে সন্ত্রাসী কার্যকলাপও বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। যার ফলে বর্তমানে ডাকসু ব্যতিত সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রসংসদ বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। এছাড়াও যে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাদের কোন রকম উদ্দ্যোগ নেই ছাত্রসংসদ গঠনের ক্ষেত্রে।

ইতোমধ্যে ছাত্রদের দ্বারা বিশ্বজিত, আবরারসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড মানুষের বিবেকের তাড়নায় অতি পৈশাচিক বলে গণ্য হয়েছে। যার মধ্যে বিশ্বজিত হত্যাকাণ্ডের আসামীদের বিচারে গাফলতি দেখা গেছে। মামলা ঝুলে আছে আবরারের। আর যে কত শত হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি জাতি ভুলেই গেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। এসব কার্যক্রমের ফলে জনমনে দাবি উঠেছিল ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের। যার ফলে শুধুমাত্র বুয়েটে এখন ছাত্ররাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ঘোষণায় নিষিদ্ধতা বহাল রয়েছে। আর ছাত্ররাজনীতি জনপ্রিয় হয়ে উঠার পেছনের কারণ ক্ষমতার বড়াই, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি সহজেই আয়ত্ব করা যায়। ছাত্র বয়সেই কোটিপতি হওয়ার নজির রয়েছে শুধুমাত্র একটি বড় পদ পেয়ে।

ওইতো সেদিন ছাত্রলীগ থেকে শোভন-রাব্বানী পদত্যাগ করতে বাধ্য হলো দুর্নীতির অভিযোগে। কপাল ভাল যে সাংবাদিক সেটি প্রমাণসহ ধরতে পেরেছিল। কত বিষয় যে আড়ালে থাকে তার কোন ইয়ত্তাই থাকে না। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংকিং তরতর করে নিচে নেমে আসছে। গবেষণা কমে আসছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে যে দল ক্ষমতায় আসে তার ছাত্রসংগঠন মূল দলের রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়ায়। ক্ষমতাসীন দলের যাবতীয় প্রোটেকশন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি এসব অঙ্গসংগঠন বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে। আবার সুযোগ সন্ধানীরা কিংবা বিকৃত মস্তিষ্কের কিছু এলিয়েন হঠাৎ ক্ষমতা পেয়ে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী, খুন-খারাবি থেকে শুরু করে সমাজ বিরুদ্ধে যাবতীয় কর্মকান্ড শুরু করে।

ছাত্র সংগঠনসমূহ যে উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হয় তার বাস্তব কর্মপন্থা কখনোই সাধিত হয় না। ছাত্রনেতার যে সকল গুণ থাকার কথা সেগুলোও থাকে না। বছরের পর বছর চলে যায়, কিন্তু পড়ালেখা শেষ না করে আদু ভাইয়ের মত ক্যাম্পাসে বিচরণ করে। আর স্থানীয় ছাত্ররাজনীতিতে কোন প্রকার ছাত্রত্ব না থেকেও ছাত্র নেতা হয়ে উঠে।

কোনকালেই কোন সরকার স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। প্রত্যক সরকারেরই কিছু সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান রয়েছে। সেজন্য দেশের জনগণ সরকারের সমালোচনা করে, যা সংবিধান সম্মত। দেশের প্রত্যকটি নাগরিকের বাক-স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু মূল কথা হচ্ছে সরকারের সমালোচনা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তির জীবন-নাশের দিকে চলে যায়।

ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রথম সুর তুলেছিল মেজর জলিল। যার ফলে স্বাধীন বাংলাদেশে সেক্টর কমান্ডার হয়েও প্রথম জেলে বন্দি ব্যক্তি এবং একমাত্র সেক্টর কমান্ডার যার কোন পদবি দেওয়া হয় নাই। এসব কর্মকান্ড বলে দেয় ভারতীয় কোন ইস্যুতে বরাবরই যেকোন সরকার মানিয়ে নেই। যা স্বাধীনতারই পরিপন্থী। স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশে কোন দুর্নীতি থাকবে না। জনপ্রতিনিধিরা জনগণের কল্যাণে ব্যস্ত থাকবে। রাজনীতি হবে সম্প্রীতির। সেদিনের অপেক্ষায়....

লেখক: শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ