ইতিহাস বদলে দেয় ইসলামের প্রথম যুদ্ধ

  © ফাইল ফটো

মুসলিম ও কাফিরদের মধ্যেকার ঐতিহাসিক প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ দ্বিতীয় হিজরী (৬২৪ খৃঃ) ১৭ রমজান সংগঠিত হয়। দেড় হাজার বছর পূর্বে ১৭ রমজান সংঘটিত প্রথম যুদ্ধ। কুরআনে বদর যুদ্ধকে সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী যুদ্ধ অভিহিত করা হয়। মুসলমান সংখ্যায় কম থাকা সত্ত্বেও কাফির পরা শক্তিকে পরাজিত করে বদর প্রান্তে ঐতিহাসিক বিজয় অর্জিত হয়। রাসুল (সা:) মাত্র ১ বছর ৬ মাস ২৭ দিনে মদিনায় হিজরতের সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে কুরায়েশরা রাসুলকে (সা:) মদিনা থেকে বের করে দেবার চেষ্টা চালায়। কিন্তু রাসূলের (সা:) ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল। বদর যুদ্ধর আগে কুরায়েশ নেতারা মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের নিকটে পত্র প্রেরণ করে, কিন্তু সে তখনো ইসলাম গ্রহণ করেনি। এদিকে রাসূল (সা:) মদিনায় আগমনের ফলে তার নেতৃত্ব হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় দারুনভাবে সে ক্ষুব্ধ।

কুরায়েশরা তার ক্ষোভ কাজে লাগাতে কঠোর ভাষায় পত্র প্রেরণ করে। তোমরা আমাদের লোকটিকে (রাসুল (সা:) আশ্রয় দিয়েছ। এজন্য আমরা আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, হয় তোমরা অবশ্যই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে অথবা তাকে মদিনা থেকে বের করে দিবে নতুবা আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে যুদ্ধ করব এবং তোমাদের যোদ্ধাদের হত্যা করব ও মহিলাদের হালাল করে নেব। পত্র পেয়ে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই দ্রুত গোপনে বৈঠ বসলে সেখানে রাসূল (সা:) গিয়ে বলেন, ‘তোমরা কি তোমাদের সন্তান ও ভাইদের সাথে (মুসলমানদের সাথে) যুদ্ধ করতে চাও’? রাসূলের (সা:) মুখে এ বক্তব্য শুনে বৈঠক ভেঙ্গে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

সা‘দ বিন মু‘আয (রা:) মক্কায় ওমরাহ করতে গেলে কুরায়েশ নেতা উমাইয়া বিন খালাফের অতিথি হন। উমাইয়ার ব্যবস্থাপনায় ত্বাওয়াফরত দেখে আবু জাহল তাকে ধমকের সুরে বলে, তোমাকে দেখছি নিরাপদে ত্বাওয়াফ করছ। অথচ তোমরা বেদ্বীনগুলোকে আশ্রয় দিয়েছ! আল্লাহর কসম! যদি তুমি উমাইয়া বিন খালাফের সাথে না থাকতে, তবে নিরাপদে ফিরে যেতে পারতে না’। একথা শুনে সা‘দ চীৎকার দিয়ে বলেন, তুমি আমাকে এখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালে আমি তোমার জন্য এর চেয়ে কঠিন বাঁধা হয়ে দাঁড়াব- আর সেটা হ’ল মদিনা হয়ে তোমাদের ব্যবসায়ের রাস্তা বন্ধ করে। অতঃপর মুহাজিরগণের নিকটে হুমকি পাঠালো যে, ‘মক্কা থেকে তোমরা নিরাপদে ইয়াছরিবে পালিয়ে যেতে পেরেছ বলে অহংকারে ফেটে পড়ো না। ওখানে গিয়েই তোমাদের ধ্বংস করে দেবার ক্ষমতা রাখি’। অতপর তারা তৎপর ছিল মুহাজিরগণের সর্বনাশ করতে। পরবর্তীতে ১ম হিজরীর রমজান মাস থেকে কুরায়েশদের হামলা প্রতিরোধে মদিনায় নিয়মিত সশস্ত্র টহল একবছর অব্যাহত থাকে।

রাসূল (সা:) মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র গঠন, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শান্তি এবং নিরাপত্তার লক্ষ্যে মদিনার অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীগুলোর সাথে একটি শান্তি ও সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হন। কুরাইশগণ নানা ষড়যন্ত্র চালাচ্ছিল মদিনায় নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। এমনকি মদিনায় আক্রমন করারও তারা পরিকল্পনা করেছিল। রাসূল (সা:) সিরিয়া ফেরত মক্কার ব্যবসায়ী কাফেলার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও তাদের পুরো খবরাখবর সংগ্রহের জন্য তালহা বিন উবায়দুল্লাহ ও সাঈদ বিন যায়েদ (রা:)-কে প্রেরণ করেন। তাঁরা ‘হাওরা’ নামক স্থানে পৌঁছে জানতে পারেন যে, আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে বিরাট এক ব্যবসায়ী কাফেলা সত্বর ঐ স্থান অতিক্রম করবে; যাতে রয়েছে এক হাজার উট বোঝাই কমপক্ষে ৫০,০০০ স্বর্ণমুদ্রার মাল-সম্পদ এবং তাদের প্রহরায় রয়েছে আমর ইবনুল আছ সহ মাত্র ৪০ জন সশস্ত্র সৈন্য। তাঁরা দ্রুত মদীনায় এসে রাসুল (সা:)-কে এই খবর দেন। রাসুল (সা:)-চিন্তা করলেন যে, এই বিপুল মাল-সম্পদ মক্কায় পৌঁছে গেলে তার প্রায় সবই ব্যবহার করা হবে মদিনায় মুহাজিরগণকে ধ্বংস করার কাজে। তিনি কালক্ষেপন না করে বদর গিরিপথে আবু সুফিয়ানকে বাঁধা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

মুজাহিদগণ রাসুলের (সা:) নেতৃত্বে মদিনা থেকে বেরিয়ে পড়েন আবু সুফিয়ানকে বাঁধা দিতে। সে খবর জানতে পেরে মক্কার কাফিরদের জানালে নেতারা উত্তেজিত হয়ে সুসংগঠিত যুদ্ধের আয়োজন করে। রাসুলের (সা:) নেতৃত্বে কাফিরদের মোকাবেলা করতে বাধ্য হন। দ্বিতীয় হিজরির রমজান মাসে ৩১৩, ১৪ বা ১৭ জনের ক্ষুদ সৈন্য বাহিনী নিয়ে মদিনা থেকে ৮০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে বদর গিরিপথের দিকে যাত্রা করলেন। ৮২, ৮৩ বা ৮৬ জন ছিলেন মুহাজির বাকী ছিলেন আনছার সাহাবী। বি’রে সুক্বইয়া নামক স্থানে রাসুল (সা:)- ক্বায়েস ইবনু আবী ছা‘ছা‘কে সংখ্যা গণনা করতে এবং সংখ্যা জেনে খুশি হয়ে বললেন, তালূতের সৈন্য সংখ্যাও তাই ছিল। এটা বিজয়ের লক্ষণ। এই বাহিনীতে মাত্র ২টি ঘোড়া ও ৭০টি উট ছিল। ‘রাওহা’ নামক স্থানে পৌঁছে আবু লুবাবা ইবনু আবদিল মুনযিরকে ‘আমীর’ নিযুক্ত করে পাঠানো হয়। অপর পক্ষে কাফেলার পতাকা বহনের দায়িত্ব দেওয়া হয় মদিনার প্রথম দাঈ মুসআব বিন উমায়েরকে। ডান বাহুর সেনাপতি নিযুক্ত হন যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম এবং বাম বাহুর জন্য মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রা:)। পশ্চাদ্ভাগের সেনাপতি নিযুক্ত হন ক্বায়েস ইবনু আবী ছা‘ছা‘আহ (রা:)। এতদ্ব্যতীত মুহাজিরগণের পতাকা বাহক হন আলী (রা:) এবং আনছারগণের সা‘দ ইবনু মু‘আয (রা:)। সার্বিক কম্যান্ডের দায়িত্বে থাকেন স্বয়ং রাসুল (সা:)।

কুরাইশ নেতারা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বিশাল বাহিনীর সাথে মক্কার শীর্ষস্থানীয় উমাইয়া বিন খলফ, আবু জেহেল, উৎবা, শায়বা, আবুল বুখতারী, হিশাম, হাকিম বিন হাজম প্রমুখসহ একহাজার সৈন্য। সাহাবাগণ ছিলেন রিক্ত হস্ত, খাদ্য-রসদ ও অস্ত্র-শস্ত্র ছিল অপ্রতুল, শত্রু বাহিনী তিনগুণের চেয়ে বেশি। রাসুল (সা:)- সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করলেন। আবু বকর ও ওমর (রা:) তাদের মূল্যবান পরামর্শ দান করলেন। আনসার সাহাবী সাআদ বিন মাআজ (রা:) নিজেকে দ্বীনের পথে উৎসর্গ করে দীর্ঘ ভাষণ দিলেন-‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা:)! আমরা আপনার উপর ঈমান এনেছি এবং আপনার সত্যতা স্বীকার করেছি এবং আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনার আনিত দ্বীন সম্পূর্ণ সত্য। হে আল্লাহর রাসুল (সা:)! আপনি মদিনা থেকে বের হয়েছেন এক ইচ্ছা নিয়ে, কিন্তু আল্লাহ এখন অন্য পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দিয়েছেন। এখন আপনার যা মর্জি হয় করতে পারেন। আমরা সর্বাবস্থায় আপনার সাথে আছি। আল্লাহর কসম! আমরা আপনাকে ঐরূপ বলব না, যেরূপ বনু ইস্রাঈল তাদের নবী মুসা (আ:)-কে বলেছিল যে, ‘তুমি ও তোমার রব যাও যুদ্ধ করগে! আমরা এখানে বসে রইলাম’ (সূরা:মায়েদাহ,আয়াত-২৪)। আপনি আমাদের কে যা ইচ্ছা তা নির্দেশ দেন, আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, আপনি আমাদেরকে মহাসমুদ্রে ঝাপ দেওয়ার নির্দেশ দিলেও আমরা মহাসমুদ্রে ঝাপ দিতে প্রস্তুত। আমাদের মধ্য থেকে কেউ পিছনে থাকবেনা’ (যুরকানী ১ম খন্ড)।

রাসুল (সা:)-বক্তব্য শুনে খুশি হলেন এবং আল্লাহ সাহাবাদের উপর সন্তুষ্ট হয়ে বদর যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ের ফায়সালা দিলেন। রাসুল (সা:)- আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করলেন, ‘হে রাব্বে কারিম! তোমার ওয়াদা পূর্ণ কর-এই কুরাইশ বাহিনী নিতান্ত অহংকার ও দাম্ভিকতার সাথে অগ্রসর হচ্ছে, ওরা আপনার বিরোধীতা করছে। হে আল্লাহ! তোমার ওয়াদা পূর্ণ কর, আমাদের বিজয় দান কর’ (সিরাতে ইবনে হিশাম)। আল্লাহ দোয়া কবুল করলেন এবং তাঁর রাসুলের প্রতি অকুন্ঠ আনুগণ্যশীল, শহীদি দরজায় উজ্জীবিত মুসলিম বাহিনীর প্রতি আসমানী সাহায্যের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে গেল। বৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহ বদরের বালুকাময় স্থানকে শক্ত করে দিলেন। যুদ্ধ শুরু হলে ‘হয়ত শহীদ নয়ত গাজী’ এই দুটি পথ। মুসলমানদের ঈমানী শক্তির ফলে আল্লাহ বদর প্রান্তরে পাঁচ হাজার ফেরেশতা পাঠিয়ে মুসলমানদের সাহায্য করলেন।

উতবা, শাইবা ও ওয়ালিদ নিহত আমীর হামজা, আলী এবং উবায়দা (রা:)-এর হাতে। দুই যুবক মাআজ এবং মুআওয়াজের হাতে নিহত কুরাইশ নেতা আবু জেহেল। উমাইয়া বিন খালফ মৃত্যুবরণ করল তার কৃতদাস বিলাল (রা:)-এর হাতে। মুসলিম শহীদ ১৪ জন, কাফের নিহত ৭০ এবং বন্দী ৭০ জন। বদর যুদ্ধের পর ইসলামের বিজয় ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বিশ্বে, বেজে উঠে দাম্ভিক শক্তির পতনঘন্টা। মুসলিম বাহিনী বিজয় পতাকা উড্ডীন করলো বদর প্রান্তে।

লেখক : প্রাবন্ধিক


সর্বশেষ সংবাদ