করোনা মহামারির দিনেও কমছেনা ধর্ষণ-নিপীড়ন
- মহব্বত হোসেন মিলন
- প্রকাশ: ০৩ মে ২০২০, ০৭:৩৫ PM , আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:১১ PM
করোনাকালীন দুর্যোগে বিধ্বস্ত পৃথিবীতে প্রতিদিন বৃহৎ থেকে বৃহত্তর হচ্ছে লাশের মিছিল। জ্যামিতিক হারে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। চারিদিকে অজানা আতঙ্কে মানুষ হয়ে আছে ঘরবন্দি। তৃতীয় বিশ্বসহ সব মোড়ল দেশগুলোর সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, অবস্থা ক্রমেই ভেঙ্গে পড়ছে।
অথচ এই মহামারীর হাত থেকে বেঁচে ফেরার কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে ব্যর্থ পুরো পৃথিবীর চিকিৎসা ব্যবস্থা। তবে কি পুরো চিকিৎসাব্যবস্থা করোনার কাছে ধরাশায়ী হয়ে গেলো নাকি অসহায় আত্মসমর্পণ? এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থা কী? এমন অবস্থায় বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, বাংলাদেশ এই মহামারীকে অনেকটা স্বাগত জানিয়ে চলেছে তার গতানুগতিক নিয়মে।
রাষ্ট্র কর্তৃক নারী নিপীড়ক ও ধর্ষক সৃষ্টির উর্বর ভূমিতে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলছে ধর্ষণ ও নিপীড়নের ঘটনা। এই বিকৃত মস্তিষ্কের ধর্ষকদের বুকে নেই চলমান মহামারীর কোন আতঙ্ক। তারা ব্যস্ত তাদের বিকৃত যৌন আকাঙ্ক্ষা পূরণে। তাদের সেই যৌন আকাঙ্ক্ষার শিকারে পরিণত হচ্ছে শিশু থেকে বৃদ্ধা সব বয়সী নারী। করোনার মহামারী থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য যখন সারা পৃথিবীর মানুষ প্রাণপন চেষ্টা করছে তখন আমদের দেশে দেখছি এসব ধর্ষক ও নিপীড়করা করোনাভাইরাস কে বেছে নিয়েছে অভিনব কৌশল হিসেবে।
সংবাদ মাধ্যমে যার সংবাদ আমাদের কর্ণ শিখরকে শিহরিত করছে প্রতিনিয়ত। জামালপুরে পুলিশ পরিচয়ে করোনা রোগি তল্লাশির কথা বলে কিশোরীকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ, কেরানীগঞ্জে ত্রাণ নিতে গিয়ে ১০ বছরের শিশু ধর্ষণ, বরগুনার তালতলিতে ত্রাণ দেওয়ার কথা বলে দিন মজুরের মেয়েকে ধর্ষণ করে ইউপি সদস্য এবং মামলা করতে গেলে ধর্ষিতার পরিবারকে এলাকা ছাড়ার হুমকি প্রদান করে বুক উচিয়ে চলছে বদমাশ ইউপি সদস্য।
আমাদেরকে আরো অবাক করে লুটপাটের বর্ণনা দেওয়ায় গৃহ বধুকে গলা কেটে হত্যার ঘটনাটি। রাজশাহীতে ত্রাণ চাইতে গিয়ে মারধরের শিকার বৃদ্ধার ঘটনাটি চাপা পড়ে যায় এতো এতো সংবাদের ভিড়ে। এখানেই কি শেষ? না, তা হবে কেন? যখন ধর্ষকদের পৃষ্ঠপোষকতার দায়িত্ব স্বয়ং রাষ্ট্রই গ্রহন করেছে তখন ভয়মুক্ত ধর্ষকদের আরো কিছু সংবাদ উত্থাপন করা সমীচীন বলেই মনে করি। মানবজমিন পত্রিকায় চোখ বোলাতেই দেখতে হলো বাহ্মনবাড়িয়ায় তাহা নামের স্কুল ছাত্রীর আত্মহত্যার ঘটনা।
এর কারণ কি? বখাটেরা প্রতিনিয়ত তাকে উত্যক্ত করতো। তাদের ক্ষমতার কাছে নতি শিকার করে তাহা আত্মহত্যার মাধ্যমে মুক্তির পথ বেছে নিয়েছে। ময়মনসিংহে এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ শেষে হত্যা করে লাশ গাছে ঝুলে রাখার ঘটনা এটাই প্রথম নয় এর আগেও এরকম ঘটনার সংবাদ শুনেছে এদেশের জনগণ। এখানেই কি শেষ? এমন ভাবার কারণ নেই। শ্রীপুরে মা ও ২ মেয়েকে ধর্ষণ ও হত্যার সংবাদ যখন শুনতে হয় তখন ধর্ষক, রাষ্ট্র নাকি নিজেকেই ধিক্কার দিবো তা বুঝে আসে না। নারায়নগঞ্জে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করে ইব্রাহিম ও তার ২ বন্ধু। পরিবার মামলা করলে পুলিশ মামলা নেয়নি কারণ ইতোমধ্যে পুলিশ অপরাধী কর্তৃক মোটা অঙ্কের টাকায় পকেটকে ভারী করেছে। ভিক্টিমের পরিবার সাদা কাফনের কাপড় পড়ে বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামার দৃশ্যটা আমাদেরকে আশান্বিত করলেও সেই আশা যে আশাই থেকে যাবে তা বিগত সময়ের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়।
যতোগুলো ধর্ষণের ঘটনা বর্ণনা করে পাতা ভারী করলাম তা বহু পূর্বের কোন ঘটনা নয় সবগুলোই ঘটেছে মার্চ ও এপ্রিল মাসের মধ্যে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এম জে এফ) এর একটি জরিপে দেখা গেছে লকডাউনের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৬ টি এবং পারিবারিক নির্যাতন ৩ শতাধিক। বাংলা নিউজ এ এটি প্রকাশ হয় ২১ এপ্রিল ২০২০ এ। প্রথম আলোতে প্রকাশিত ২০১৯ সালে পুলিশ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫৪০০ টি এ তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ধর্ষণের হার ৩.৮০ অর্থ্যাৎ প্রতি লাখে ৪ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। যা স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি। ১৯৯১, ২০০১, ২০১১, ২০১৮ তে প্রতি হারে ধর্ষণের হার ছিল ০.৩৯, ২.৩৭, ২.৩৮ ও ২.৪৫। ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১.৩৫ অর্থ্যাৎ এক তৃতীয়াংশ। (বাংলাদেশ পুলিশ হেডকোয়াটার্স ওয়েব সাইট)।
ধর্ষণ দিয়ে শুরু হওয়া বছরটিতে ধর্ষণের মাত্রা আরো বেড়ে গেছে। প্রথম সাড়ে তিন মাসে ৩৯৬ জন শিশু হত্যা, নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে।(বাংলাদেশ প্রতিদিন) এসব ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এর সাথে জড়িত ব্যক্তিরা অধিকাংশই কোননা কোনভাবে ক্ষমতা কাঠামোর সাথে যুক্ত অথবা ক্ষমতাধরদের আশেপাশের লোকজন। তারা এ ব্যাপারে আশ্বস্ত যে তারা ধর্ষণ বা হত্যা যাই করুক না কেন তাতে তাদের কোন ভয় নেই। যদিও ২/১ টি ঘটনার বিচার হয়েছে জনগণের আই-ওয়াশের নিমিত্তে কিন্তু বাকি সব ঘটনা চাপা পড়ে গেছে অথবা অপরাধীকে পার করে দেওয়া হয়েছে তদন্তের নামে। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি রাষ্ট্র এদেরকে বিচারের আওতায় আনতে অপারগ কিংবা এদের বিচার করতে চায় না।
কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে সোহাগী জাহান তনু ধর্ষণ ও হত্যার ৪ বছর পেরিয়ে গেলেও কিন্তু বিচারের প্রশ্নে রাষ্ট্র নিশ্চুপ। দিনাজপুরে পুলিশের ভ্যানে ইয়াসমিন ধর্ষণের খবরটা কারো অজানা নয়, কিন্তু তার বিচার হলেও তা হয়েছে অনেক দেরিতে, জনগণের চাপের মুখে এবং মানুষের রক্ত ও লাশের বিনিময়ে? রাষ্ট্র ধর্ষকদের বিচার তো করছেই না বরং এর বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার তাদের শায়েস্তা করতেই এরা বদ্ধপরিকর। আর একাজটি করছে পুলিশ ও সরকারপন্থী ছাত্র সংগঠন। আমরা দেখেছি তনু হত্যার বিচারের দাবিতে রংপুরে প্রত্যয়ী মিজান ও সাজুরা যখন দাঁড়িয়েছিলো তখন তাদের উপর ছাত্রলীগ নির্মম হামলা চালায়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি নারী নিপীড়নের ঘটনা। গতবছর প্রথম বর্ষের একজন ছাত্রীকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে ব্যর্থ হলে তার শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে ছাত্রলীগ কর্মী কিন্তু এর বিচার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন করতে সমর্থ হয়নি। চলমান সালটিতে আমরা শুনেছি আই আর বিভাগের একজন মেয়েকে ধর্ষণের সংবাদ। যখন আমরা বিচারের দাবিতে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর সামনে দাঁড়াই তখন অনেক শিক্ষককেই বলতে শুনেছি সে তার বন্ধুর বাসায় যাবে কেন? অর্থাৎ বন্ধুর বাসায় বান্ধবী গেলে তাকে ধর্ষণের অধিকার সুশিল সমাজ দিয়ে দিয়েছে। সন্ধ্যার পর টিউশনি থেকে ফেরার পথে বহিরাগত মটর সাইকেল আরোহী কর্তৃক একজন ছাত্রী বুকের ওড়না হরণের শিকার হলে প্রশ্ন উঠে সন্ধ্যার পর মেয়ে বাইরে যাবে কেন?
এছাড়াও শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী লাঞ্চনা ও নিপীড়নের ঘটনা হরহামেশাই শোনা যায়। এর বিচার দৃশ্যমান নয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নারী নিপীড়ন বিরোধী সেল থাকলেও সেটা প্রায় সময় অকার্যকর থাকে। এই হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা।
এই ধর্ষণ ও নিপীড়নের ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য একদিকে যেমন বিচারহীনতার সংস্কৃতি দায়ী অন্যদিকে আমাদের সুশীল সমাজও কম দায়ী নয়। একটি মেয়ে যখন ধর্ষিত হয় তখন শুনতে হয় সে এমন পোশাক কেন পরবে, সন্ধ্যার পর কেন বাইরে থাকবে, বন্ধুর সাথে কেন মিশবে। এসব অমূলক প্রশ্ন, যার মাধ্যমে ধর্ষকের অপরাধকে লঘু করে অপরাধীকে মুক্ত করার চেষ্টা চলে। অপর দিকে ভিক্টিম শারীরিক ধর্ষণের পর সমাজ কর্তৃক মানষিক ধর্ষণের শিকার হয়।
কিন্তু এভাবে আর কতো? এখনই সময় শিশু-নারী নিপীড়ন-ধর্ষণ ও হত্যা প্রতিরোধ করতে রাষ্ট্রকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহন করতে হব। এজন্য চলমান বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেড়িয়ে এসে বর্তমান ও বিগত সময়ের চিহ্নিত অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
ধর্ষণের মনস্তত্ব সম্পর্কে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মুক্ত আলোচনা ও গবেষণা করতে হবে। ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সহজ সম্পর্ক তৈরীর পথ উন্মুক্ত করে সংস্কৃতি চর্চার সুস্থ্য পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: সম্পাদক, উত্তরণ সাহিত্যের ছোটকাগজ, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়