করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে অজানা শঙ্কা
- মোঃ হাসান তারেক
- প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২০, ০৮:২৮ PM , আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১১:৩০ AM
বিশ্বব্যাপী এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে, করোনাভাইরাস। করোনার কারণে, এখন সর্বত্র লকডাউন অবস্থা বিরাজ করছে। লকডাউনের কারণে, স্থবির হয়ে পড়েছে সারাবিশ্বের অর্থনীতির চাকা। কোভিড-১৯ সংক্রমণে প্রতিদিন জ্যামিতিকহারে বিশ্বব্যাপী বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। বিশ্বের ধনী-গরীব, শক্তিশালী, কম শক্তিশালী সকল রাষ্ট্র নায়কের রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে এই করোনাভাইরাস।
এই করোনার সংক্রমণ থামানোর জন্য বিশ্বের বড় বড় বিজ্ঞানী, গবেষক, ঔষধ কোম্পানিগুলো নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে এক কার্যকর ভ্যাকসিনের সন্ধানে। কিন্তু, এখনও তারা কোন কার্যকর ভ্যাকসিনের নাম বলতে পারেননি। চলছে, মানবদেহে ট্রায়াল অ্যান্ড ট্রায়াল। কবে পাওয়া যাবে সেই পট পরিবর্তনকারীর সন্ধান? আর পেলেই কি সবাই পাবে সেই ভ্যাকসিন প্রয়োগের সুযোগ?
বিশ্বের ভ্যাকসিন বাজারের ৮৫ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে গ্ল্যাক্সোস্মিথ, সানোফি, ফাইজারসহ চার-পাচঁটি কোম্পানি। ভ্যাকসিন তৈরির প্রক্রিয়াটি এত সহজ নয়। এটি যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ এবং জটিল প্রক্রিয়া। বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে একটি কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়। আবিষ্কার থেকে প্রাণীর দেহে প্রয়োগ পর্যন্ত ধাপগুলো একটি বড় চক্র। তারপর প্রয়োজন হয় ধাপে ধাপে অনুমোদন।
অনুমোদন পাবার পরই শুর হয় এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। অনুমোদনের পর সকলের জন্য এটির সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য দরকার হয় বিশাল উৎপাদন সক্ষম কারখানার। পাশাপাশি, এটি সকলের ক্রয় ক্ষমতার মধ্য আনার মত চ্যালেঞ্জও এসে পড়ে। সকলের জন্য সহজলভ্য ও তৃণমূল পর্যায়ে সরবরাহ করতে ব্যর্থ হলে মহামারির বিস্তার থামানো কঠিন হয়ে যায়।
তাছাড়া তৃণমূল পর্যায়ে সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, অনেক সময় অন্তরালের রাজনীতির কারণেও। সকল শক্তিশালী রাষ্ট্রেই হতে চায় ভ্যাকসিনের পেটেন্ট পাবার রাজনীতিতে জয়ী। যুগে যুগে মহামারি যখনই এসেছে তখনই সূত্রপাত হয়েছে এই নোংরা রাজনীতির।
এক্ষেত্রে, উল্লেখ করা যেতে পারে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের টিকার কথা। ১৯৮২ সালেই বিশ্বের ধনীদেশগুলোতে চলে আসে এই ভাইরাসের টিকা। কিন্তু, সবাই কি পেয়েছিল সেই টিকা? উত্তর হচ্ছে, না। ২০০০ সাল পর্যন্ত গরীব দেশগুলোর দশ শতাংশের কম মানুষকে দেয়া গেছে এই ভাইরাসের টিকা।
উদাহারণ হিসেবে, আরো বলা যেতে পারে সোয়াইন ফ্লুর প্রতিষেধকের কথা। প্রথম দেশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়া সোয়াইন ফ্লুর প্রতিষেধক তৈরি করে। অষ্ট্রেলিয়া প্রথমে তার দেশের নাগরিকদের জন্য প্রতিষেধক নিশ্চিত করার পর আমেরিকাকে দিয়েছিল। পরবর্তীতে, আমেরিকার ক্ষোভে বেকায়দায় পড়েছিল অস্ট্রেলিয়া। এই ভ্যাকসিন রাজনীতি এখনও চলমান।
করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়েও একই রাজনীতি অভ্যন্তরীণভাবে চলমান রয়েছে। এই নোংরা রাজনীতির নেতৃত্বে রয়েছে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো। প্রত্যেকেই চাইছে ভ্যাকসিন তৈরির প্রতিযোগিতা জয়ী হতে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতিমধ্যে মার্কিন কোম্পানিগুলোকে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘ভ্যাকসিন তৈরিতে আমেরিকাকে জয়ী হতে হবে’।
তাছাড়া, মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে, তিনি জার্মান কোম্পানি কিয়োরভ্যাককে ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন ভ্যাকসিন তৈরির ফর্মূলা কিনতে। আমেরিকার বড় প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ চীন চাইছে ভ্যাকসিন প্রথম বাজারে আনতে। চীন তিনটি ভ্যাকসিনকে ট্রায়ালে নামিয়েছে। চীনের প্রতিবেশী দেশ জাপানও নেই পিছিয়ে। ৭ এপ্রিল জাপান সরকার দেশটির মোট জিডিপির ২০ শতাংশ আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার ঘোষণা দেয় করোনা মোকাবিলায়।
এই বরাদ্দকৃত অর্থের অন্যতম একটি অংশ ব্যয় হচ্ছে ইনফ্লুয়েঞ্জার জন্য কার্যকরী অ্যান্টি ভাইরাল ‘অ্যাভিগান’ তৈরিতে। ইংল্যান্ড অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা বিজ্ঞানী সারা গিলবার্টের আবিষ্কৃত ‘ChAdoX1’ এবং ‘ChAdoX2’ নামক করোনা ভ্যাকসিন সফলভাবে মানবে শরীরে প্রয়োগ করেছে। ভ্যাকসিন তৈরির এই প্রচেষ্টাগুলো নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য আশার কথা।
তবে, এই ভ্যাকসিন সরবরাহের পূর্ব অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের ভাবাচ্ছেও অনেক। ব্রিটেনের এসোসিয়েশন অব ফার্মাসিটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের মতে, একটি ভ্যাকসিন তৈরিতে প্রায় ১৮০ কোটি ডলার পর্যন্ত খরচ পড়ে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এত অর্থ ব্যয় করে পুঁজিপতি দেশগুলো কি এই ভ্যাকসিন সকলকে সহজে দিতে চাইবে?
অতীত অভিজ্ঞতা কিন্তু নেতিবাচক উত্তর দিচ্ছে। এখন তাহলে উপায় কি? উপায় হচ্ছে, টিকার বৈষম্য দূরীকরণের জন্য জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নেতৃত্বে সকল দেশের মধ্য ঐক্যমত সৃষ্টি করতে হবে। এজন্য, ইতিমধ্যে বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্থা একটি ভার্চুয়াল সম্মেলন আয়োজন করেছিল।
কিন্তু, অতীব পরিতাপের বিষয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ভারত অংশগ্রহণ করেনি এই সম্মেলনে। তাছাড়া, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও চীনকে নিয়ে ঠুনকো অভিযোগ উঠিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় সহায়তা বন্ধ করার হুমকি দিয়ে পরিস্হিতি আরো জটিল করে ফেলেছে।
তবে, টিকার বৈষম্য দূরীকরণে কার্যক্রম পরিচালনাকারী অলাভজনক দুটি প্রতিষ্ঠান গ্যাভি ও কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়াডনেস ইনোভেশন্স বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে কাজ করে কিছুটা হলেও আশার আলো ছড়াচ্ছে। তবে, আশা থাকবে এই ভয়ানক মহামারি দূরীকরণে টিকার সমান বন্টন সুনিশ্চিত করতে পারবে বিশ্ব নেতারা। নতুবা, মারাত্মক সংক্রামক করোনা আরো আগ্রাসী ভূমিকায় অবর্তীণ হবে।
লেখক: প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ডক্টর মালিকা কলেজ, ঢাকা