করোনা চিকিৎসার অব্যবস্থাপনা নিয়ে ডাক্তারের ক্ষোভ
অক্সিজেন মাস্কটাও মুখের উপর দিতে পারলাম না
- সজল আশফাক
- প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০২০, ১০:৫২ AM , আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৮:২২ PM
গত ২০ এপ্রিল আমার ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয়া নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী এবং মর্মান্তিক কিন্তু এই মৃত্যু করুণ। কেন করুণ সেটা বলছি-
১) গত ২/৩ দিন ধরে উনি বাসায় ছিলেন সামান্য জ্বর আর কাশি নিয়ে। বাসায় শুধু একমাত্র ছেলে আর স্বামী। ফোনে ফোনে আমাদের পরামর্শমত চিকিৎসা নিয়েছেন। কারণ ঢাকায় কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না করোনায় আক্রান্ত রোগীকে উপদেশ দেয়ার মত।
২) অবস্থা খারাপ হলে, শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, উনি নিস্তেজ হয়ে পড়েন। তখন বাসার কাছে নামকরা এক হাসাপাতালে যান। বলতে হবে, তারা ভাল কাজ করেছেন। রোগীর এক্সরে করেছেন, ইসিজি করেছেন। অন্যান্য প্যারামিটার চেক করেছেন। তখন ইসিজিতে সামান্য পুরনো সমস্যা এবং এক্স-রে থেকে দেখা গেল নিউমোনিয়া। ক্লিনিক্যালি এই হাসপাতাল তাকে কোভিড-১৯ এর রোগী হিসাবে সন্দেহ করে লিখিত পরামর্শ দিলেন কোভিড-১৯ এর জন্য নির্ধারিত তিনটি হাসপাতালের কোথাও ভর্তি হতে।
৩) কুর্মিটোলা হাসপাতালে যাওয়ার জন্য এম্বুলেন্স ডাকা হলো। কিন্তু যখনই ড্রাইভাররা শোনে কুর্মিটোলা তখনই তারা ফিরে যায়, আসে না। ফোনও ধরে না। তারপর অনেক টাকা দিয়ে একটি এম্বুলেন্স জুটলো।
৪) সেনাবাহিনীতে আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব যারা ছিলেন সবাইকে ফোন করলাম। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এলো রোগী ভর্তি হল আইসোলেশন ওয়ার্ডে। লোকবলহীন এই হাসপাতালে রোগী নিজেই নিজের ভরসা। তখন ১৯ এপ্রিল বেলা ৯টার মত। রোগীর তখন জ্ঞান আছে কী নেই বোঝা দায়। তারমধ্যে রোগী তার ছেলের কাছে অস্ফুট কন্ঠে নিথর চোখে তাকিয়ে কিছু খাবে বলে ইশারা করলো। কিন্তু কোথাও খাবার পেল না ছেলেটা। আমাদেরকে জানালো আশেপাশে কেউ আছে কী না যে একটু খাবার পৌঁছে দিতে পারে।
৫) খাবারের খোঁজে পাগল প্রায় ২০/২২ বছরের ছেলেটা মায়ের কাছে ফিরে দেখে মুখের ওপর দেয়া অক্সিজেন মাস্ক পাশে পড়ে আছে। রোগী নিজের শক্তি নেই সেটিকে তোলে। মাস্কের ইলাস্টিকের ফিতেটা বেজায় ঢিলে, জায়গামত থাকছে না। রোগীকে দেখার মত কেউ নেই, কিন্তু কাউকে সেখানে থাকতেও দিবে না হাসপাতাল। হাসপাতালের এটাই নিয়ম। ছেলেটা নিচে অসহায় দাঁড়িয়ে আমেরিকায় থাকা বোনের কাছে চরম বিষাদপূর্ণ সময়ে জানতে চাইলো, কী করবে সে। ওপরে ৬ তলায় তার মা, অনেক রোগীর সাথে একা পড়ে আছে লাশের মত।
৬) এদিকে সাধ্যমত তোড়জোড় চলছে, কিছু একটা করার। কিন্তু সদাপ্রস্তুত মীরাজাদীদের কাউকেই ফোনে পাওয়া গেল না। এত মানুষ ফোন করে ফোনে তো না পাওয়ারই কথা। সামরিক বাহিনীর সেই আত্মীয় পরিজনের সহায়তায় অবশেষে বিকেলের দিকে রোগীর স্যাম্পল নেয়া হলো কোভিড-১৯ এর জন্য। আইসিইউতেও নেয়া হলো কিন্তু কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে আবার পাঠানো হলো সেই আইসোলেশনে, ৬ তলায়। বুঝতে বাকি রইলো না দুইবার ৬তলা করে রোগীর ১২টা বাজানো হচ্ছে। টেস্টের রেজাল্ট না আসা পর্যন্ত তাকে আইসোলেশনেই থাকতে হবে। আইসোলেশন ওয়ার্ড না কি প্রাকমর্গ! সব রোগী মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। দেখার কেউ নেই। কে দেখবে? নার্স-ডাক্তার অপ্রতুল। একজন ডাক্তার একটা রোগী দেখার পর অন্যরোগীদের দেখতে দেখতে ফিরে আসার আগেই তার ডিউটি আওয়ার শেষ হয়ে যায় কিংবা রোগী নিজে থেকে চিরবিদায় নিয়ে চলে যায়। আমার এই আত্মীয়া আমাদেরকে বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিতে সম্মিলিত আইসোলেশন ছেড়ে একাকী আইসোলেশনে চলে গেছেন। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী তার একমাত্র কন্যার আকাশ বিদীর্ণ করা চিৎকারে নিউ ইয়র্কের আকাশের চোখেও আজ জল।
৭) তিনি কবিতা লিখতেন। বেগম পত্রিকার নিয়মিত লেখক শাহান আরা হক। অত্যন্ত অমায়িক, বিনয়ী এবং উচ্চ শিক্ষিত। স্বাধীন বাংলাদেশে এত আত্মীয় পরিজন থাকা স্বত্ত্বেও এই পরিণতি এভাবে কি তার প্রাপ্য ছিল?
আমরা কিছু করতে পারলাম না। অন্তত অক্সিজেন মাস্কটা যেটা ঢিলে ফিতের কারণে পড়ে যাচ্ছিল, সেটিকেও মুখের ওপর দিতে পারলাম না! মাস্কটাও অনেক চেষ্টা করেছে, নাক-মুখ আঁকড়ে ধরে বাঁচাতে চেয়েছে। ওই বা কী করবে? ওর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জরাগ্রস্ত, কোনভাবেই নিজের অবস্থানে থাকতে পারছিল না। আর যে ক্লান্ত যে ডাক্তার, ওর কন্ঠের আর্তনাদ এখনো কানে বাজছে- ভাইয়া, আমরা আর পারছি না।
৮. আমরা করোনার চেয়েও শক্তিশালী, আমরা করোনা বিরুদ্ধে প্রস্তুত, এদেশে করোনা রোগী নাই, পিপিই সংকট নেই- এইসব কথা বলে মানুষকে যারা মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছে, এখনও দিচ্ছে তাদেরকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট গালিটি দিতেও ঘৃণা হয়।
লেখক: নিউ ইয়র্ক প্রবাসী চিকিৎসক ও লেখক