শিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ ও তাঁর শেষ জীবনে বদলে যাওয়ার কাহিনী
- আবু রায়হান
- প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০২০, ০৩:৩৪ PM , আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৬:১১ PM
গতকাল ২৩ মার্চ নীরবে চলে গেল শিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ'র প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি গত বছরের ২৩ মার্চ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার বারিধারায় নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন।তিনি ১৯৫২ সালের ২ জানুয়ারি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন তাঁর পিতার নাম এম ফজলুল হক ও মাতার নাম আসিয়া হক। শাহনাজ রহমতুল্লাহর ভাই আনোয়ার পারভেজ সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক এবং আরেক ভাই জাফর ইকবাল ছিলেন চলচ্চিত্র অভিনেতা ও গায়ক। প্রখ্যাত গজলশিল্পী মেহেদী হাসানের কাছে শাহনাজ রহমতুল্লাহ গজল শিখেন। বাংলায় দেশাত্মবোধক গানের জনপ্রিয় কণ্ঠ শিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ'র ১৯৬৩ সালে শাহনাজ বেগম হিসেবে তাঁর গানের হাতেখড়ি।
১৯৬৩ সালে ১০ বছর বয়সে নতুন সুর’ নামক চলচ্চিত্রে কণ্ঠ দেওয়ার মাধ্যমে তাঁর শিল্পী জীবনের শুরু হয়। ১৯৬৪ সালে প্রথম টেলিভিশনে তাঁর গাওয়া গান প্রচারিত হয়। শাহনাজ রহমতুল্লাহ ১৯৭৩ সালে আবুল বাশার রহমতউল্লার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
এরপর তিনি শাহনাজ বেগম থেকে শাহনাজ রহমতুল্লাহ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেন। তিনি গাজী মাজহারুল আনোয়ার, আলাউদ্দিন আলী, খান আতা প্রমুখের সুরে গান গেয়েছেন। পাকিস্তান আমলে উর্দু গজলসহ পাকিস্তান টিভি ও রেডিওতে গান গেয়েছেন। ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি গান গেয়ে কণ্ঠজাদু দিয়ে সংগীতপ্রেমীদের আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন।
জীবনের শেষ সময়ে এই গুণীশিল্পী গান ছেড়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে ধর্মকর্ম পালনে মনোনিবেশ করেন। যা তার মৃত্যুর পূর্বে বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়। ২০০৬ সালে বিবিসির শ্রোতা জরিপে সর্বকালের সেরা ২০ বাংলা গানের তালিকায় শাহনাজ রহমতুল্লাহর কন্ঠের ছিল চারটি গান। সেই তালিকায় চারটি গানের মধ্যে ৯ নম্বরে ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’, তালিকায় ১৩ নম্বর স্থান দখল করে শাহনাজের গাওয়া ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটি। এই গানটি স্বাধীন বাংলা বেতারের সূচনা সংগীত হিসেবে তৈরি করা হয় ১৯৭০ সালে। এটি বাঙালির জাতীয় স্লোগানও বটে।তালিকার ১৫ নম্বর গানটি ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’।‘একতারা তুই দেশের কথা বল’ গানটি রয়েছে ১৯ নম্বর স্থানে।
শাহনাজ রহমতুল্লাহর গাওয়া গানের মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য গান হলো ,‘আমার দেশের মাটির গন্ধে’, ‘আমায় যদি প্রশ্ন করে’, ‘সাগরের তীর থেকে’, ‘পারি না ভুলে যেতে’, ‘ফুলের কানে ভ্রমর এসে’, ‘যে ছিলো দৃষ্টির সীমানায়’, ‘আমি তো আমার গল্প বলেছি’, ‘আরও কিছু দাও না’, ‘এই জীবনের মঞ্চে মোরা কেউবা কাঁদি কেউবা হাসি’, ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’ ইত্যাদি। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’ গানটি দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি তাদের দলীয় সঙ্গীত হিসেবে বেছে নিলে কিছুটা বিতর্কের মধ্যেও পড়েন শাহনাজ রহমতুল্লাহ। এই গানটিও তুমুল জনপ্রিয় বাংলা গানের শ্রোতাদের কাছে।
এই গুণীশিল্পী ১৯৯২ সালে একুশে পদক, ১৯৯০ সালে ‘ছুটির ফাঁদে’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ নারী কণ্ঠশিল্পী হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কার অর্জন করেন।
মৃত্যুর বছর পাঁচেক আগে হঠাৎই গান ছেড়ে দিয়েছিলেন এ কিংবদন্তি শিল্পী। গণমাধ্যমেও ছিলেন অনুপস্থিত। এক জন্মদিনে শাহনাজ রহমতুল্লাহ বলেন, ‘এখন আসলে জীবনযাপন বদলে গেছে। সারাক্ষণ মহান আল্লাহর ধ্যানেই মগ্ন থাকি, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনেই চেষ্টা থাকে আমার। আমি সবার জন্য দোয়া করি যেন সবাই সুস্থ থাকেন, ভালো থাকেন।
মৃত্যুর পূর্বে ঐ সাক্ষাৎকারে শাহনাজ রহমতুল্লাহকে প্রশ্ন করা হয়, আর কি কখনো গাইবেন? জবাবে বলেন, ‘যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর কোনদিনই গাইবো না। গানের জগতে তার অনুপস্থিতিতে শ্রোতা ও ভক্তদের মন বারবারই কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল। তাঁর খোঁজ খবর নিতে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে এক গণমাধ্যমকর্মী গিয়েছিলেন তার বাসায়।
সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন যে, ধর্ম-কর্মে বেশ মনোযোগী হয়েছেন কিংবদন্তি এ শিল্পী। তাই এসবে সময় হয়ে উঠছে না তার।হঠাৎই গানের ভুবন থেকে নিজেকে কেন সরিয়ে নিলেন গণমাধ্যমকর্মীর এমন প্রশ্নে সেদিন তিনি জানিয়েছিলেন- আমার নামাজ পড়েই সময়টা বেশ কাটছে। ওমরাহ করে আসার পরের দিন থেকেই আর গান করতে ইচ্ছা করেনি। তখন আমি নামাজ পড়া শুরু করেছিলাম। তিনি আরও জানিয়েছিলেন, পবিত্র কাবা, মহানবী (সা.)-এর রওজা শরিফ দেখে আসার পর থেকে পার্থিব বিষয়ে আগ্রহী নন তিনি। বাকিটা জীবন সৃষ্টিকর্তার কৃতজ্ঞতায় প্রার্থনা করেই কাটাতে চান।
এ সময়ের গান কেমন হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন সে বিষয়ে কিছুই জানেন না তিনি। টিভি দেখেন না, রেডিও শোনেন না।
তার সময় কাটে কীভাবে প্রশ্নে তিনি জানান, ভোর ৪টায় ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়েন। ফজর পর্যন্ত জায়নামাজে অপেক্ষা করতে থাকেন। ওয়াক্ত হলে ফজর পড়ে কোরআন শরিফ পড়া শুরু করেন।
তিনি আরো জানান একজন হুজুর বাসায় এসে পবিত্র কোরআন শিখিয়ে যান। এভাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজসহ আরও কিছু ধর্মীয় কাজ সারেন। তিনি জানান এশার নামাজ শেষে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়েন যেন পরবর্তীতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে জাগতে পারেন।
তিনি সংবাদমাধ্যম কর্মীকে সেদিন আরও জানিয়েছিলেন, এখন হজে যাওয়াই তার মূল লক্ষ্য। হাঁটুতে ব্যথার কারণে হাঁটতে পারছেন না জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, একটু সুস্থ হলেই আমার স্বামী আমাকে হজে নিয়ে যাবেন। তিনি হজ করেছেন। এখন তিনি তাবলিগ করছেন।
এই গুণীশিল্পীর জীবনের শেষ ইচ্ছা হজ্জ করার সৌভাগ্য হয়ে উঠেনি। তার পূর্বেই মহান আল্লাহ তায়ালার ডাকে সাড়া দিয়ে ২০১৯ সালের ২৩ মার্চ দিবাগত রাত সাড়ে ১১টায় ইহজগতের মায়া ছিন্ন করে পরপারে পাড়ি জমান। আল্লাহ তার জীবনের নেক আমলগুলো কবুল করুন।