করোনায় অস্থির তেলের বাজার, যুদ্ধের আলামত!
- সোহেল রানা
- প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০২০, ১০:৪০ PM , আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৫:৫৩ PM
করোনার রোগী শনাক্তের প্রভাব পড়েছে দেশের পুঁজিবাজারে। একদিন বাদেই বিরাট ধসের কবলে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শেয়ার বাজার। ঢাকাতে প্রধান মূল্যসূচক, ডিএসই-এক্স এক দিনেই সাড়ে ৬ শতাংশ পড়ে গেছে। ২৭৯ পয়েন্ট হারিয়ে বাজার নেমে এসে ঠেকেছে ৪ হাজার ৮ পয়েন্টে। গত সাত বছরে এই পতন সর্বোচ্চ। একইসাথে চট্টগ্রামে সিএসই-থার্টি সূচক ৬২১ পয়েন্ট কমে এসে থেমেছে ১০ হাজার ৭শ ৩২ পয়েন্টে।
অবশ্য নভেল করোনা বিশ্ব পুঁজিবাজারে ধাক্কা দিয়েছে আগেই। সেই ধাক্কা শেষ অবধি তেলের বাজারে গিয়ে পড়েছে। এই সময়ে উল্টো ঘটনাও ঘটেছে। তেল পড়েছে আগে,এরপর পুঁজিবাজার। দুটোতেই কিন্তু করোনার প্রেসার।
পেট্রোডলারের এই যুগে শেয়ারবাজারের ধাক্কা তেলের বাজার গিয়ে ঠেকবে,তাকে তো আর অস্বাভাবিক বলা যায়না। আজ (সোমবার) এশিয়ার শীর্ষ অপরিশোধিত তেল ব্রেন্টের দাম প্রায় ৩০ শতাংশ কমে ব্যারেলপ্রতি ৩১ দশমিক শূন্য দুই ডলারে নেমেছে। ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের পর ব্রেন্টের এটা সর্বোচ্চ দরপতন।
অনেকে বলছেন, এটা তেল নিয়ে যুদ্ধ শুরুর আলামত।
এখানে দুটি পক্ষ। প্রথম পক্ষে আছে ওপেকের মুরুব্বি সৌদি আরব আর দ্বিতীয় পক্ষে নন-ওপেকের মুরুব্বি রাশিয়া। তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর ফোরাম-ওপেক এখন মোটামুটি সৌদির কব্জায়। এই ওপেকের সাথে করোনা অ্যাটাক পরবর্তী তেলের দাম নিয়ে বনিবনা হয়নি রাশিয়ার। অথচ মতপার্থক্য সত্ত্বেও তেলের উৎপাদন কমিয়ে আনার বিষয়ে ওপেক ও রাশিয়া এতোদিন একসাথে কাজ করেছে।
গত শুক্রবার সৌদি নেতৃত্বাধীন ওপেকের সাথে রাশিয়া নেতৃত্বাধীন নন-ওপেক মিত্রদের বৈঠক ব্যর্থ হবার পর থেকেই তেলের দাম পড়তির দিকে। অবশ্য এই ধারা বিশ্বজুড়ে করোনা হানা দেবার পর থেকেই শুরু হয়েছিল। পতনের মুখে থাকা তেলের বাজার সামলাতে সৌদি আরব প্রস্তাব করেছিল অন্তত ১৫ লাখ ব্যারেল উৎপাদন কমিয়ে আনার। সৌদি প্রস্তাবে একমত হতে পারেনি নন-ওপেক দেশগুলো। সৌদি গোস্বা করে কমিয়ে দিয়েছে উৎপাদন ও রপ্তানি। সৌদির আচমকা কৌশল পরিবর্তনের ফলে কয়েকদিন ধরে বড়সড় একটা ঝড় বইছে বিশ্ব তেলের বাজারে। চক্রাকারে সেই ধাক্কায় সোমবার পুঁজিবাজারে সবচেয়ে বেশি মূল্য হারিয়েছে জ্বালানি কোম্পানিগুলো। তেলের এই যুদ্ধ এশিয়ার প্রধান তেল আমদানিকারক চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারতের জন্য পোয়াবারো হলেও বিপদটা রপ্তানিকারক ইরানের-ই বেশি। সৌদিরও কি শেষ পর্যন্ত মুখরক্ষা হবে? সে কি এখন আর আগের মত তেলের লো-কস্ট প্রোডিওসার? সেই আলাপ আরেকদিন হবে।
তেল নিয়া যে লড়াইটা চলছে তার ইতিহাস কয়েকশ বছরের মাত্র। যুদ্ধটা শুরু করেছিল তখনকার তিন মোড়ল ব্রিটেন, ফ্রান্স আর জার্মানি। আমেরিকা,রাশিয়া আর ইতালি বিশ্বরাজনীতিতে তখনো নবজাতক। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ব্রিটিশ নৌ শক্তি ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ব্রিটিশ ম্যানুফেকচার দশকের পর দশক লিড করেছে। মাঝে মাঝে ব্রিটেনের এই রাজত্বে এসে বাগড়া দেয় ফ্রান্স। কিন্তু ইস্পাত আর লোহার উপর ভর করে জার্মানিতে ভারি শিল্পের একটা বিপ্লব হয়ে গেলে সহসাই ফ্রান্সকে টপকে ব্রিটেনের এক নম্বর জাতশত্রুতে পরিণত হয় জার্মানি।
১৯১৪ সালের মধ্যেই অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেই মিশর, আমেরিকা এমনকি ব্রিটিশ কলোনিগুলোর জলসীমায় জার্মান সামরিক ও বাণিজ্য জাহাজগুলো দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করে। তাদের একের পর এক আধুনিক যুদ্ধজাহাজ তৈরির ঘটনা ব্রিটিশদের উদ্বেগে ফেলে দেয়। এর কিছু বছর আগে জিওপলিটিক্সে পেট্রোলিয়াম গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারক হয়ে ওঠে । বিংশ শতকের প্রথম দশকে ব্রিটিশরা ভাবলো জার্মানির অর্থনৈতিক ও সামরিক উত্থানের বিপরীতে তাদের জরুরী কিছু করা দরকার। পেট্রোলিয়াম বিশেষ করে তেলকে কাজে লাগানোর চিন্তা তখন থেকেই। শুরু হলো পেট্রোলিয়ামের জন্য লড়াই। এতদিন যেখানে জাহাজগুলি ছিল কয়লাচালিত, এবার সেগুলো তেল দ্বারা রিপ্লেস হতে থাকলো।
ব্রিটেনকে এই পথ দেখিয়েছিলেন এডমিরাল লর্ড ফিশার নামের এক সমর বিশেষজ্ঞ ও নৌ কর্মকর্তা। ১৮৮২ সালের সেপ্টেম্বরে লর্ড ফিশার জনসম্মুখে দেওয়া এক ভাষণে বলেন ,ব্রিটিশ নেভাল ফ্লিটকে ‘তেল’ দ্বারা রিপ্লেস করতে হবে। আর এই তেলশক্তি সমুদ্রের আধিপত্য নিয়ন্ত্রণে ব্রিটেনের গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রাটেজি নির্ধারণে ভূমিকা রাখবে। সেসময় ফিশারকে অদ্ভুত স্বপ্নচারী বলেছিল সহকর্মীরা। ফিশারের কথা কি পরে বাস্তব হয়েছিলো? আর জার্মানিও কি চুপচাপ বসেছিল? এসব বিষয় নিয়ে কথা হবে ধারাবাহিকভাবে।