সৈকত কলেজ: অন্যরকম স্মৃতি, অন্যরকম ভালো লাগা
- ড. মো. কামাল উদ্দিন
- প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২০, ০৩:৩০ PM , আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০১:০৯ PM
একজন শিক্ষক হিসেবে লেখালেখি ও পড়াশোনা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প থাকে না। সে সুবাদে ছিটেফোঁটা কিছু লেখালেখি করার চেষ্টা করি। জীবনে কিছু একাডেমিক ও নন একাডেমিক লেখা লিখেছি। সমাদৃত হয়েছি খুবই কম। কারণ অনেকে লেখার মধ্যে সাহিত্য খোঁজেন। খোঁজাই স্বাভাবিক। সাহিত্য লেখাকে উন্নত করে কারণ সাহিত্য স্বয়ং উন্নত। এর ছোঁয়া যেখানে লাগে সেখানেই মাধুর্য বাড়ে। সৌন্দর্য বাড়ে। আবেগ ও বিবেক থাকে। মানবতা থাকে, থাকে গভীরতা ও বিশালতা।
আমার পক্ষে কখনো সাহিত্য লেখা সম্ভব হয়নি। আমি সিরিয়াস কিছু লিখতে পারিনা। আজকের লেখাটি এমন একটি বিষয় নিয়ে লেখার চেষ্টা করেছি যার সাথে জড়িত আমার আবেগ, শৈশব, ভালোবাসা এবং স্মৃতি। স্মৃতিচারণমূলক লেখা আমি আগে কখনো লিখিনি। জানিনা কিভাবে লিখতে হয়। সৈকত কলেজ কে ঘিরে আমার যে বলয়, জীবনের স্রোত, ভালোলাগা, অভিজ্ঞতা ও আমার শৈশবে হারিয়ে যাওয়া আনন্দময় সময় গুলো নিয়ে লিখতে চাইলাম। প্রথমে ধারণা করেছিলাম স্মৃতিচারণমূলক লেখা তো অনেক সহজ। স্মৃতি আমার, আর লেখক আমি নিজেই। লিখতে গিয়ে দিশেহারা। জানিনা কোন স্মৃতির আড়ালে কোন গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি ঢাকা পড়ে যায়। তবুও চেষ্টা করছি কিছু তুলে ধরবার জন্য।
সৈকত কলেজকে নিয়ে আমার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তখনকার সময়ে আমাদের শৈশব, আমাদের পড়াশোনা, পারিপার্শ্বিকতা ও সামাজিকতা ইত্যাদি বিষয়গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
সুবর্ণচর তখন সুবর্ণ ছিলনা। ছিল অনেকগুলো চরের সমষ্টি। রাস্তাঘাটের অবস্থা ছিল জরাজীর্ণ। বিদ্যুৎ ও পাকা রাস্তা ছিল স্বপ্নের মত। আমার প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে আমি প্রথমে কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা শুরু করিনি। বর্তমান তোতা মিয়ার বাজারে এমন একটি ঘর যেখানে রাতে গরু বাঁধা হত, আর সকালে তা পরিষ্কার করে হাতিয়া থেকে আগত আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক বাবু কুমুদ বন্ধু দাশ আমাদেরকে হাতে খড়ি দিতেন। বাবু কুমুদ বন্ধু দাসই হচ্ছেন আমার জীবনের প্রথম শিক্ষাগুরু, যিনি পরবর্তীতে হাজী নজির আহমদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি এখনো বেঁচে আছেন। আমাকে ফোন করেন বা আমি তাকে ফোন করি। সুযোগ পেলে ওনাকে দেখতে যাই, গল্প করি। স্যারের মাধ্যমেই আমার পড়াশোনা শুরু হলেও তা বেশিদুর এগোয়নি, কারণ বর্ষাকালে স্যার ওনার বাড়ি থেকে তোতা মিয়ার বাজার এসে আমাদেরকে পড়াতে পারতেন না, কারণ ওনার বাড়ি থেকে তোতা মিয়ার বাজার আসতে এক বুক পানি ডিঙিয়ে আসতে হতো। তাই তখন আমাদের পড়াশোনা ছিল মৌসুমী। তবে থেমে থাকেনি পড়াশোনা।
আমার কোন ব্রেক অফ স্টাডি নেই কিন্তু আমার জীবনের যারা প্রথম ক্লাসমেট তারা অনেকেই আমার থেকে ৩-৫ বছরের বড় আবার যাদের সাথে আমি দাখিল পাস করি তারা বয়সে আমার ৩-৫ বছরের ছোট। এর একটি বড় সুবিধা আছে, আমার বন্ধু বান্ধবের সংখ্যা অনেক বেশি।
কুমুদ স্যারের গ্রীষ্মকালীন শিক্ষার পর ভর্তি হলাম আনসার মিয়ার হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মধ্যখানে কিছুদিনের জন্য দুলাল মিয়ার হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়া আসা করেছিলাম। বাড়ি থেকে আনসার মিয়ার হাট বর্ষাকালে কোনভাবেই যাওয়া যেত না। আবার যেহেতু আমার জন্ম ও আত্মীয়-স্বজনদের বেশিরভাগই দুলাল মিয়ার হাটের পাশেই অবস্থান করেন সেজন্য আমার আব্বা সিদ্ধান্ত নিলেন দুলাল মিয়ার হাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমাকে ভর্তি করাবেন। আমার জানামতে ওই সময়ে আমি ছাড়া দুলাল মিয়ার হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমান তোতা মিয়ার বাজারের আশেপাশের আর কোন ছাত্র ছিল না। তাই কিছুদিন যাওয়ার পর দুলাল মিয়ার হাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আর আমার যাওয়া হলো না। আবার চলে গেলাম আনসার মিয়ার হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
শ্রদ্ধেয় শিক্ষক বাবু দীনেশচন্দ্র ও এটিএম লুৎফুর রহমান স্যার ছিলেন আমার সরাসরি শিক্ষক। আনসার মিয়ার হাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমি চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করি। এরইমধ্যে তোতামিয়ার বাজারের পশ্চিমে একটি নূরানি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়। আমার মায়ের বড় ইচ্ছা ছিল আমাকে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করানোর কিন্তু বাড়ির আশেপাশে কোন মাদ্রাসা না থাকায় আমি স্কুলে পড়াশোনা শুক্র করি। আমার নাম রেখেছিলেন জৌনপুরী হুজুর মাওলানা কামাল সিদ্দিকী সাহেব। তখন আমাদের অঞ্চলে সুদিনে জৈনপুরী হুজুরদের আগমন বেশ আনন্দময় ছিল। তাঁরাই ছিলেন আমাদের পীর। আমরা তাঁদের অনেক ভক্তি-শ্রদ্ধা করতাম । সেজন্য মা আমাকে হুজুর বানানোর ইচ্ছা পোষণ করলেন।
নূরানি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর সেই সুযোগ লুফে নিলেন আমার মা। আব্বাকে রাজি করিয়ে আনসার মিয়ার হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র মো. কামাল উদ্দিন কে নূরানি মাদ্রাসায় প্রথম জমাতে ভর্তি করিয়ে দিলেন। ফলে বন্ধুদের চার বছরের জুনিয়ের হয়ে গেলাম। তাতে আমার কোনো অসুবিধা হয়নি, খাপ খাইয়ে নিলাম নিজেকে। চকচকে রঙের পাঞ্জাবি এবং ডোরাকাটা লুঙ্গি আমার নিত্যদিনের পোশাকে পরিণত হল। নূরানি মাদ্রাসায় প্রথম জামাতে ৪০ টি হাদিস মুখস্থ করা, মাসলা মাসায়েল শিখা, দ্বিতীয় ও তৃতীয় জমাতে হাতে কলমে কোরআন শিক্ষার পর ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম ছমীর হাট ইসমাইলিয়া মাদ্রাসায়। কারণ ছমীর হাট ইসমাইলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা বোরহান সাহেব নূরানি মাদ্রাসার আমার ক্লাসমেটকে বিয়ে করেন। উনার শশুর বাড়ি আর আমাদের বাড়ি খুব কাছাকাছি।
মাদ্রাসায় ছাত্রের বড্ড অভাব, উনি চিন্তা করলেন আমাকে যদি উনার মাদ্রাসায় ভর্তি করানো যায় অন্তত ইসমাইলিয়া মাদ্রাসায় একজন ছাত্র বাড়বে। পরিবারকে বলা হল ছমীর হাটের আশেপাশে আমাকে একটি লজিং ঠিক করে দিবেন। আব্বা রাজি হলেন কিন্তু একটি ঘটনার কারণে ছমীর হাট ইসমাইলিয়া মাদ্রাসায় আর আমার পড়াশোনা হল না। ঘটনাটা আমার কাছে খুবই মজার ও কষ্টের। আমি মাওলানা বোরহান সাহেবের বাইসাইকেলের পেছনে চড়ে ছমীর হাট মাদ্রাসায় ভর্তি হতে গেলাম চকচকে রঙের পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি পড়ে। মাথায় সরিষার তেল প্রচণ্ড রোদে বেয়ে বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল আমার শরীরের উপর। মাওলানা বোরহান সাহেব আমাকে মাদ্রাসার বারান্দায় রেখে দ্রুত ওনার ক্লাসে ঢুকে গেলেন। ওনার ইচ্ছা ছিল ক্লাস শেষে আমাকে অফিসে নিয়ে ভর্তি কার্যক্রম সমাপ্ত করবেন, কিন্তু এরই মধ্যে হয়ে গেল বিপত্তি। আমি বারান্দায় হেঁটে হেঁটে দেখছিলাম মাদ্রাসার সৌন্দর্য, ক্লাসরুম। হঠাৎ কিছু বুঝে উঠতে না উঠতে আমার পিঠের উপর ক্রমাগত বেতের আঘাত পড়তেই থাকলো। প্রায় ১০ থেকে ১৫ টি বেত্রাঘাত! আমি হতভম্ব!! কিংকর্তব্যবিমূঢ়!!! নিজের কোনো অপরাধ খুঁজে পেলাম না এবং কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখানোর সুযোগ পেলাম না। আমার প্রতিক্রিয়া না দেখে যে হুজুর আমাকে মেরে তুলোধুনো করছিলেন তিনি হঠাৎ চিন্তা করলেন এমন মারার পরও সে দৌড়ে পালাচ্ছেনা, ক্লাসেও ঢুকছে না, ব্যাপার কি! তিনি তখন আমার চেহারার দিকে তাকালেন, দেখে ওনার কাছে আমাকে অপরিচিত মনে হল। জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে? কাঁদো কাঁদো ভাবে বললাম, নতুন ভর্তি হতে এসেছি। তিনি যে কি পরিমান লজ্জিত হয়েছিলেন এবং কি করবেন তা ভেবে পাচ্ছিলেন না। উনার মত লজ্জিত কারো চেহারা আমি আর দেখিনি।
ইতোমধ্যে খবর চলে গেলো মাওলানা বোরহান সাহেবের কাছে। তিনি ক্লাস তাড়াতাড়ি শেষ করে আমার কাছে আসেন। আমাকে অফিসে ডেকে নিয়ে গেলেন এবং উচ্চস্বরে ওই শিক্ষককে অনেক কিছু বল্লেন। যদিও বেত্রাঘাত ছিল চরম মাত্রায়, কষ্ট হয়েছিল আমার অনেক, তবুও ওনাকে এভাবে আমাকে মারার অপরাধে শিক্ষকরা মিলে বকাঝকা করাটা আমার ভালো লাগেনি। যাই হোক ওই কারণে আমার আর ইসমাইলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়া হলো না।
এরপর সিদ্ধান্ত হলো ওলামা বাজার সোনাগাজীতে কাওমী মাদ্রাসায় আমাকে ভর্তির। সেই মদ্র্রাসাও আমার ভালো লাগেনি। ফিরে গেলাম বাড়িতে। তারপর বাড়ির কাছাকাছি কিন্তু ৪-৫ কিলোমিটার দূরে দুলাল মিয়ার হাট দাখিল মাদ্রসায় তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হলাম। শুরু হলো সরকারি মাদ্রাসায় পড়াশোনার পালা। দুলাল মিয়ার হাট মাদ্রাসায় পড়াশোনা ভালোই চলছিল। তবে দীর্ঘদিন ধরে স্কুলে পড়াশোনা করায় মাদ্রাসার পড়াশোনায় মন বসাতে বড্ড কষ্ট হয়েছিল। তবুও চালিয়ে নিলাম। শেষ পর্যন্ত দাখিল পাস করলাম। কেমনে জানি আমি শিক্ষিত হয়ে গেলাম। অথচ দীর্ঘদিন ধরে যেভাবে স্কুল আর মাদ্রাসা পরিবর্তন করলাম আমার ঝরে পড়ার কথা ছিল।
দীর্ঘমেয়াদে মাদ্রাসা শিক্ষা চালিয়ে যাওয়াটা আমার কাছে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। আমি ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলাম যে আমি ভালো কোন আলেম হতে পারবোনা। আমি জানি সত্যিকারের আলেম হওয়া বড়ই কঠিন। আমার সহপাঠীরা আমাদের বিদায় অনুষ্ঠানে সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন তারা যেন হাক্কানি রাব্বানী আলেম হতে পারে, আর আমি দোয়া চেয়েছিলাম শিক্ষিত হয়ে দেশ জাতির সেবা করবার জন্য। আমার বন্ধুরা দাখিল পরীক্ষায় অতিরিক্ত সাবজেক্ট হিসেবে মানতেক সহজ বাংলায় যুক্তিবিদ্যা সাবজেক্টে নিয়েছিল আর আমি অতিরিক্ত সাবজেক্ট হিসেবে পৌরনীতি নিয়েছিলাম।
রাষ্ট্র, সমাজ ও রাষ্ট্রনীতি নিয়ে পড়া আমার বেশ আগ্রহের জায়গা ছিল। সেজন্য দাখিল পরীক্ষা পাশের পর আমি চিন্তা করলাম কলেজে ভর্তি হবার। অবশ্যই চিন্তার ক্ষেত্রে ১৯৯৩ সালে আমাদের এলাকায় একসাথে দুইটি কলেজ প্রতিষ্ঠা আমার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। বিপত্তি হলো তখন মাদ্রাসা বোর্ড থেকে মার্কশিট দেরিতে আসার কারণে মাদ্রাসার ছাত্রদের ভালো কলেজে ভর্তি হওয়া দুরূহ ছিল। আমি নাছোড়বান্দা, কলেজে ভর্তি হবোই। শুনেছিলাম মাদ্রাসা বোর্ডের পাশেই ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন সুবর্ণচরের দুইজন কৃতি সন্তান হাফেজ মোবারক উল্লাহ ফারুক ভাই (তিনি আবার ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়েও পড়তেন) যিনি বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করছেন এবং জনাব নাজিম উদ্দিন কাকা যিনি ঢাকায় একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। আমি ঢাকা চলে গেলাম ওনাদের কাছে। তখন কোনো মোবাইল ফোন ছিল না, উনাদের সাথে যোগাযোগ করেও যাইনি। ঢাকা আলিয়ার হলে খুঁজে বের করলাম মোবারক উল্লাহ ফারুক ভাইকে, একজন ভালো ছাত্র হিসেবে তার বেশ পরিচিতি ছিল। ওনার মাধ্যমে নাজিম কাকাকেও খুঁজে বের করলাম। উনাদেরকে আমি কলেজে ভর্তি হওয়ার আগ্রহের কথা জানালাম এবং আমার মার্কশিট তুলে দেয়ার জন্য সহযোগিতা চাইলাম। দুইজন অক্লান্ত পরিশ্রম করে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে আমার মার্কশিট তুলে দিলেন।
ঢাকা থেকে দ্রুত এসে নোয়াখালী কলেজে ভর্তির ফরম নিলাম। নোয়াখালী কলেজে ভর্তি হতে পারব সে নিশ্চয়তা ছিলনা। সাথে সোনাপুর কলেজে ভর্তির ফরম নিলাম।
সৈকত কলেজে ভর্তির আগ্রহ প্রাথমিকভাবে ছিলনা। ইচ্ছা ছিল শহরে যাবো, কেন জানি বদলাতে ইচ্ছে করেছিলাম। সোনাপুর কলেজের রেজাল্ট হলো, ভর্তি হলাম। কিছুদিন পর নোয়াখালী কলেজের রেজাল্ট হলো, সেখানেও ভর্তির সুযোগ পেলাম। সোনাপুর কলেজ থেকে মার্কশিট উঠানোর জন্য সোনাপুর কলেজের তৎকালীন জনপ্রিয় শ্রদ্ধেয় মরহুম মিজানুর রহমান স্যারের কাছে গেলাম। তিনি বললেন তুমি ফয়েজ ভাইয়ের ছেলে, তুমি কেন সোনাপুর বা নোয়াখালী কলেজে পড়বে। তোমাদের মত মেধাবীরা যদি এলাকা থেকে চলে আসো, সৈকত কলেজ টিকে থাকবে কীভাবে? তিনি বললেন, আজই চলে যাও বাড়িতে। তোমার নোয়াখালী কলেজে ভর্তি হওয়ার দরকার নেই। তখন নোয়াখালী কলেজে ভর্তি হওয়া আমার কাছে স্বপ্নের মতো ছিল। শ্রদ্ধেয় মিজান স্যারের কথায় আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। একটা মানুষ এতো দরদ দিয়ে কথা বলতেন! আমার সিদ্ধান্ত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হলো। তিনি আমাকে বললেন, তুমি চলে যাও। কাল থেকে সৈকত কলেজে ক্লাস শুরু করো। ওনার কথামতো বাড়ি চলে গেলাম। বাড়ির কেউ বিশ্বাস করতে পারছিলনা যে, আমি শহর ছেড়ে বাড়ি চলে এসেছি।
যাই হোক পরদিন সৈকত কলেজে গেলাম। আমি কলেজে যাওয়ার আগেই মিজান স্যার আমার বিষয়ে কলেজে অবহিত করেন। আমি জানিনা তিনি আমার কাগজপত্র কখন সোনাপুর কলেজ থেকে তুললেন আর কখন সৈকত কলেজে জমা দিয়েছিলেন। আমি শুধু ভর্তি ফরমে স্বাক্ষর করে ভর্তি হয়ে গেলাম। আমার জানামতে ভর্তির জন্য সামান্য টাকা নিয়েছিলো। আমি বরাবরই তেমন মেধাবী ছাত্র ছিলাম না তাই মানবিক বিভাগে ভর্তি হলাম।
শুরু হল সৈকত কলেজে আমার শিক্ষা জীবন যা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। এত ভালোলাগা ও শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ভালোবাসা আর কোথাও পাইনি। কলেজ জীবনে দুইটি ক্লাস, বাংলা ও ইংরেজি কমন ক্লাস ছিল। বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা একসাথে ক্লাস করতেন লম্বা হল রুমে। দেখতে ভালই লাগতো। এত শিক্ষার্থীদের সাথে ক্লাস করার অভিজ্ঞতা জীবনে প্রথম। সেরকম একটা ক্লাসের মাধ্যমে সৈকত কলেজে আমার শিক্ষা জীবন শুরু হলো। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে ক্লাসটা নিয়েছিলেন তৎকালীন অধ্যক্ষ ও ইংরেজি শিক্ষক খগেন্দ্রনাথ সরকার স্যার। উনি খুব ভালো শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু উনার পড়ানো আমার বুঝতে খুবই কষ্ট হতো।
একটি পাঞ্জাবির সাথে প্যান্ট ও স্যান্ডেল পরে কলেজের প্রথম দিন ক্লাস শুরু করি। কলেজ ক্যাম্পাসে এবং ক্লাস রুমে ঢুকার সাথে সাথে সবাই এমন ভাবে আমার দিকে তাকালো যেন চিড়িয়াখানায় নতুন কোন প্রাণীর আগমন ঘটলো। প্রথম ক্লাসে চুপচাপ ছিলাম। খাতা ও কলম কিছুই আমার কাছে ছিল না পাশের একজন থেকে এক পেজ কাগজ নিলাম ও একজন থেকে একটা কলম নিয়ে প্রথম ক্লাস করলাম। এরপর অফিসে গিয়ে সাবজেক্ট ঠিক করলাম। সাবজেক্ট নিলাম অর্থনীতি, পৌরনীতি যুক্তিবিদ্যা ও ইসলামিক স্টাডিজ কিন্তু ক্লাস করেছি অনেক সাবজেক্টে। ইসলামের ইতিহাস ও সমাজ কল্যাণের ক্লাস করেছি রীতিমতো। মাঝেমধ্যে বাণিজ্য বিভাগেরও দুই একটা ক্লাস করেছি।
সৈকত কলেজে দ্বিতীয় ক্লাস নিয়েছিলেন আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক যিনি ইংলিশ মোস্তফা হিসেবে পরিচিত ছিলেন আমাদের মোস্তফা কামাল স্যার। আবারো আমি ক্লাসে ঢোকার সাথে সাথে আমার দিকে অন্যরকম চাহনি। স্যারের তো আমার দিকে তাকানোর সময়ই নেই। ক্লাসে অনেক শিক্ষার্থী। স্যার প্রিপজিশন পড়াচ্ছিলেন। তিনি ক্লাসকে জিজ্ঞেস করলেন তোমরা দুইটা প্রিপজিশনের উদাহরণ দাও। ক্লাসের অনেকেই জানে কিন্তু কেউ বলতে চাইলোনা। আমি সুযোগ পেলাম, হাত উঠালাম। স্যার আমার দিকে তাকালেন। আমি দাঁড়িয়ে অনেকগুলো প্রিপজিশন এর উদাহরণ দিলাম। এরই মধ্যে ক্লাসে পরিচিতি পেলাম। রীতিমতো ভালো ছাত্র বনে গেলাম। প্রিপজিশন ও বেসিক ইংলিশের অনেক কিছুই দুলাল মিয়ার হাট মাদ্রাসায় আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক কালাম স্যার শিখিয়েছিলেন। এখনো মনে আছে স্যার কত যত্ন সহকারে আমাদেরকে ইংরেজি শেখাতেন।
এভাবেই ইংলিশ মোস্তফা স্যারের সাথে আমার অন্য রকম সম্পর্ক গড়ে ওঠে। স্যার আমাকে অনেক আদর করতেন। উনি ওনার বাড়ির দরজায় বিকেলে প্রাইভেট পড়াতেন। একদিন কেন জানি স্বেচ্ছায় আমাকে বললেন, কামাল তুমি আমার কাছে পড়তে এসো। আমি স্যারের কাছে পড়েছিলাম অনেকদিন কিন্তু কোনদিন আমার থেকে টাকা নেননি। মনের আনন্দে নাকি স্যার আমাকে পড়াতেন। সৈকত কলেজ ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সকল শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের ভালোবাসা পেয়েছি অনেক।
সৈকত কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ সুবর্ণচর উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান আচমকা উপস্থিত হতেন আমাদের ক্লাসে। কি অসাধারণ আলোচনা। তিনি আমার সরাসরি শিক্ষক। ওনার ভালোবাসা ও আন্তরিকতার কমতি ছিল না। সব সময় ওনার স্নেহ পেয়ে আসছি। অদ্যবধি তিনি স্নেহ ও ভালোবাসা থেকে আমাকে বঞ্চিত করেনি।
বর্তমান অধ্যক্ষ মোনায়েম খান স্যার। তিনি আমার ক্লাসের সরাসরি শিক্ষক ছিলেন না। কিন্তু যখনই তিনি জানতে পারলেন পড়াশুনার প্রতি আমার আগ্রহ আছে তখন তিনি ক্লাস রুমের বাইরে ডেকে আমাকে অনেক অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন। ইংরেজির প্রতি আমাকে জোর দিতে বললেন। পাশ করার পর অবশ্যই যেন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কোন ভাল সাবজেক্টে ভর্তি হই সেই অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন সব সময়। স্যারকে আমি শিক্ষক এবং একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা করি।
আমার আরেকজন সরাসরি শিক্ষক বর্তমান চর আমানুল্লাহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক বেলায়েত স্যার। তিনি আমাদের সমাজকল্যাণ পড়াতেন। অনেক সময় স্যার আমাকে বিভিন্ন বিষয়ে বলতে বলতেন। স্যার আমাকে বলার অভ্যাস করিয়েছেন। স্যারের আন্তরিকতা, ভালোবাসা এবং অন্যরকম কেয়ার আমাকে অনেক অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। আমাদের পৌরনীতি পড়াতেন ওই সময়ে আমাদের গানের ও প্রানের শিক্ষক অধ্যাপক আব্দুল হাই স্যার। স্যারের ক্লাসে আমরা অনেক মজা পেতাম। স্যার অনেক মজা করতেন পড়াতেন আন্তরিকতার সঙ্গে। আমার সাথে স্যারের শিক্ষক ছাত্রের সম্পর্ক থেকে আরো বেশি কিছু ছিল। অতিরিক্ত যতœ নিতেন আমার প্রতি।
আমার আরেকজন অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, অনেক প্রিয় ও একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে যাকে পেয়েছি তিনি আমাদের রহমান স্যর। রহমান স্যার সম্পর্কে আমার কাকা হন। স্যার অসাধারণ পড়াতেন। অর্থনীতির মতো কঠিন বিষয় আমাদের কাছে অতি সহজ করে দিয়েছেন। পড়াশুনার প্রতি ওনার ছিল এক অদম্য ইচ্ছা। আমি ভাবতাম কেন সব কিছু বিসর্জন দিয়ে গ্রামে পড়ে আছেন ওনারা। ওনারা যদি না থাকতেন ভালো শিক্ষকের সংজ্ঞা আমার কাছে অজানা থেকে যেত। রহমান স্যার আমাদের সকলের প্রিয় শিক্ষক ছিলেন। তিনি ছিলেন আমার গার্ডিয়ান। আজও তিনি গার্ডিয়ানশিপ ছাড়েননি। যেকোনো প্রয়োজনে আমার ইচ্ছা পূরণের মাধ্যমে তিনি আনন্দ পান। সত্যিই উনি আমার অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছিলেন।
ইসলামের ইতিহাস পড়াতেন আমাদের সাইফুল্লাহ স্যার। স্যারের অন্যরকম কেয়ার, ভালোবাসা এবং কি দারুণ এক শব্দ 'কিগো কামাল' আমার এখনও কানে বাজে। কলেজ জীবন পরবর্তী এই পর্যন্ত সব সময় আমার খোঁজ নিয়েছেন। আমাদের বাংলার শিক্ষক হিসেবে আমরা পেয়েছিলাম দুইজনকে একজন আমাদের আব্দুল্লা দিদার স্যার ।স্যারের কথার কি বলব? বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার কথা ক্লাসের ফাঁকে গল্প করে শোনাতেন। তৎকালীন সময়ে তিনি কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র ছিলেন। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং ওনার সাথে সাহিত্যের সম্পর্ক যেন বেমানান। হয়তো তিনি হওয়ার কথা ছিলো বড় কিছু। কিন্তু তার চেয়ে বড় কিছু হলেন আমাদের শিক্ষক হিসেবে সৈকত কলেজে অধ্যাপনা করবার মাধ্যমে। স্যার বাংলা ব্যাকরণ পড়াতেন। কঠিন বাংলা ব্যাকরণ আমাদেরকে উদাহরণ দিয়ে অনেক সহজ করতেন। শুধু ভালো শিক্ষক নয় তিনি একজন ভালো মানুষ বটে। স্যারের সাথে দেখা হলেই কাঁধে হাত দিয়ে অনেক কাছে এসে খোঁজখবর জিজ্ঞেস করতেন। উনি ভালোবাসতেন, ভালবাসতাম এবং আপনাকে ভালোবাসি স্যার।
বাংলার আমাদের আরেকজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক সালাহউদ্দিন স্যার। সাহিত্যের প্রতি সারের অগাধ ভালোবাসা। তিনি আমাদের বাংলা সাহিত্য পড়াতেন। হৈমন্তী পড়াতে গিয়ে তিনি বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে যেতেন। অসাধারণ ভাবে আমাদেরকে তিনি বুঝাতেন।সাহিত্যের বিভিন্ন চরিত্র পড়াতে গিয়ে মনে হয় সেই চরিত্রে তিনি নিজেই ধারণ করতেন। বুঝতে অসুবিধা হতো না আমাদের। স্যারের জন্য অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। কিছুদিন পরেই আমাদের দুলাভাই হলেন। স্যার ও দুলাভাই, দুটি মিলে এক অন্যরকম সংযোজন।
শিক্ষকতার আরেক শিল্পের নাম ছিল আমাদের শ্রদ্ধেয় দিদার স্যার। তিনি আমাদের যুক্তিবিদ্যা পড়াতেন। যুক্তিবিদ্যার যুক্তিগুলো এত আকর্ষণীয় করে আমাদের মাঝে তুলে ধরতেন তা অকল্পনীয়। স্যার পড়াতেন জাদুকরী ভঙ্গিতে। স্যার সৈকত কলেজে বেশিদিন চাকরি করেননি। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে যোগদান করে বর্তমানে সোনাইমুড়ী সরকারি কলেজে উপাধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করছেন।
এছাড়া জসিম স্যার এর আদর ও শাসন ভুলবার নয়। বিজ্ঞানের শিক্ষক হলেও শ্রদ্ধেয় সাইফুল্লাহ স্যারের সুনজর, ভালোবাসা ও স্নেহ আমাকে দারুন উৎসাহিত করেছে। স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞ। কেশব স্যার আমাকে কেন জানি অন্য রকম আদর করতেন। অবশ্য তিনি পরবর্তীতে সৈকত কলেজে ছেড়ে অন্যত্র চলে যান।
সৈকত কলেজের সাথে আমার ও আমাদের সম্পর্ক আত্মার। সৈকত কলেজে আমরা যে পরিবেশে পড়াশোনা করেছি তা কোনদিন ভুলবার নয়। স্কুলের পরিত্যক্ত ভবনে কিছুদিন ক্লাস করার পর সৈকত কলেজের বর্তমান ক্যাম্পাসে প্রথম যে লম্বা টিনশেড ঘর নির্মাণ করা হয় সেখানে আমরা কাজ করি শ্রমিকের মত। একবার কি একটা টানতে গিয়ে মাথায় কিসের সাথে লেগে রক্ত বেরিয়ে যায় কিন্তু তেমন কষ্ট হয়নি লেগেছে অনেক আনন্দ। যারা সেসময় কলেজের সাপোর্ট স্টাফ হিসেবে কাজ করেছেন তাদের কথা ভুলবার নয়। তারা অনেক সহযোগিতা করেছিলেন। তাদের প্রতি জানাই অগাধ শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।
সৈকত কলেজের সবচেয়ে ভাগ্যবান ব্যাচ ওই সময় আমাদের ব্যাচ। আমাদের বেঁচে অনেকগুলো প্রথম বিভাগ পেয়েছে। একটু বলে রাখি তখন প্রথম বিভাগ পাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য ছিল। আমাদের ব্যাচ থেকে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। এই কলেজের শিক্ষার মান ও শিক্ষার্থীদের বর্তমান অবস্থান সবকিছু মিলে নোয়াখালী জেলার একটি শ্রেষ্ঠ কলেজ আমার প্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সৈকত কলেজ। অদ্যাবধি কলেজ শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছে। ইচ্ছে আছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিছুদিন ছুটি নিয়ে কলেজে শিক্ষার্থীদের সাথে সময় কাটানোর। জানিনা সে সুযোগ কলেজ কর্তৃপক্ষ করে দিবে কিনা। সুযোগ দিলে কৃতজ্ঞ থাকবো। সৈকত কলেজের সাথে আমাদের এই বন্ধন অটুট থাকুক। শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের ভালোবাসা, স্নেহ ও দোয়া অনবরত থাকুক। কলেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যারা যে পর্যায়ে যেকোনোভাবে অবদান রেখেছেন তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা রইল।
লেখক: অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থী সৈকত সরকারি কলেজ।