তনু থেকে নুসরাত: বাংলাদেশে মামলার পোস্টমর্টেম

  © টিডিসি ফটো

এ বছরের এপ্রিল মাসে ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা,অবশেষে তার মৃত্যু, গোটা বাংলাদেশকে যেভাবে আন্দোলিত করেছিল। এমনিভাবে আন্দোলনের ঢেউয়ে ২০১৬ সালেও প্রকম্পিত করেছিল গোটা বাংলাদেশকে। সেটি ছিল কুমিল্লা সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ১৯ বছর বয়সী সোহাগী জাহান তনুর হত্যাকান্ড।

সেসময় আমি কিছুদিনের জন্য ভিক্টোরিয়া কলেজে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত ছিলাম। সেইদিন গুলোতে কাছ থেকে তনু হত্যার প্রতিবাদে তার সহপাঠী বন্ধু ও সচেতন মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও প্রতিবাদ দেখেছি। তনু হত্যাকাণ্ড সমগ্র বাংলাদেশে আলোড়ন তোলে এবং সামাজিক মাধ্যমে এ নিয়ে প্রচন্ড আলোচনা হয়।

সমগ্র বাংলাদেশে শিক্ষার্থীরা নিজেদের ক্যাম্পাসে বিচারের দাবীতে আন্দোলন করে এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনেও প্রতিবাদ মিছিল করে। স্বাভাবিক কারণেই আমার মতো অনেকেই আশায় বুক বেঁধেছিলেন অন্তত তনু হত্যার সুষ্ঠু বিচার হবে। তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো তনু হত্যার কোনো কূলকিনারা হয়নি।

নুসরাত হত্যার রায়ের পর তনু হত্যার বিচারের বিষয়টি নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তনুর বাবা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডে চাকরিরত ছিলেন। ২০১৬ সালের ২০শে মার্চ তনুর মৃতদেহ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে পাওয়া যায়। প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে বাসায় পড়তে গিয়ে তনু আর বাসায় ফিরেনি।পরের দিন তার লাশ কুমিল্লা সেনানিবাসের আবাসিক এলাকা পাওয়ার হাউজের জঙ্গল থেকে উদ্ধার করা হয়।

তনুর বাবা ইয়ার হোসেন কুমিল্লা শহরের কোতোয়ালী মডেল থানায় অজ্ঞাত আসামীর বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। পুলিশ মামলাটি গোয়েন্দাদের কাছে হস্তান্তর করে। ২০১৬ সালের ১ এপ্রিল মামলাটি সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়। ৪ এপ্রিলে প্রকাশিত ময়নাতদন্তে বলা হয়, তনুকে ধর্ষণ কিংবা হত্যার কোন আলামত পাওয়া যায়নি।

ময়নাতদন্তের রিপোর্টে নতুন করে বিতর্কের সৃষ্টি করে। জনমনে এই ময়নাতদন্ত রিপোর্টে সন্দেহের সৃষ্টি করে। ফলে দেশের উচ্চ আদালত পুনরায় ময়নাতদন্তের নির্দেশ দিলে দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে করা হলে তনুকে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়।

২০১৬ সালের মে মাসে সিআইডির তত্ত্বাবধানে তনুর পরিহিত জামা কাপড়ে প্রাপ্ত বীর্যের ডিএনএ পরীক্ষা করা হলে সিআইডি নিজস্ব গবেষণাগারে তিনজন পুরুষের বীর্যের অস্তিত্ব তনুর জামা কাপড়ে পায়। তিনজন পুরুষের বীর্যের ডিএনএ পাওয়া গেলেও আইন অনুযায়ী কোনো অপরাধীকে এখনো সনাক্ত করা হয়নি। সুতরাং এখন পর্যন্ত তনুর হত্যাকারী আসামীরা ধরা ছোঁয়ায় বাইরে।

তনু হত্যার তিন বছরের মাথায় এ বছরের এপ্রিলে ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করেন। এরপর অধ্যক্ষ তার অনুসারীদেরকে রাফিকে হত্যার প্ররোচনা দিয়ে নির্দেশনা প্রদান করে। নুসরাত হত্যার পরিকল্পনাকারীরা এর আগেও ২০১৬ সালে তার চোখে দাহ্য পদার্থ ছুঁড়ে মেরেছিল। তখন নুসরাতকে হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হয়।

২০১৯ সালের ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা নুসরাতকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে এবং এই পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা করে নুসরাতের মা। মামলা তুলে না নেওয়ায় ৬ এপ্রিল মাদ্রাসার প্রশাসনিক ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয় বোরকা পরা পাঁচ দুর্বৃত্ত। ১০ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অগ্নিদগ্ধ নুসরাতের মৃত্যু হয়।

গতকাল নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলায় দোষীসাব্যস্ত ১৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছ আদালত। ১৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে ৮৬৯ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছিল। মাত্র ৬১ কার্যদিবসে মামলার কার্যক্রম শেষ হয়। আর মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ করতে পিবিআইয়ের লাগে ৩৩ কার্যদিবস। তবে এ রায় চূড়ান্ত নয়, কেননা আসামীরা উচ্চ আদালতে সাত দিনের মধ্যে আপিল করার সুযোগ পাবে। শেষ পর্যন্ত মামলার রায়ে কতজনের ফাঁসি হয় সেটি এখন দেখার বিষয়।

রায় শোনার পর আসামিরা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে। কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ে। কেউ কেউ জানায় উচ্চ আদালতে আপিল করবে তারা। আসামিরা এ সময় বাদীপক্ষের আইনজীবীদেরও অশ্লীল ভাষায় গাল মন্দ করে। বাংলাদেশে এতো দ্রুত সময়ে মামলার রায় প্রদান এক ধরনের বিরল ঘটনা।

অনেক হত্যাকান্ডের যেখানে বিচার হচ্ছে না, মামলা জটে আদালত যেখানে জর্জরিত। সেখানে নুসরাত হত্যার রায় নিঃসন্দেহে বিচার বিভাগের জন্য মাইলফলক। শুধু নুসরাত কেন তনু, মিতু সাগর রুনিসহ নাম অজানা কতজনের বিচার প্রক্রিয়া স্থবির। তাদের পরিবার আজ ন্যায় বিচারের আশায় প্রহর গুনছে। তারা কি বিচার পাবে? না কিছু মানুষের জন্য বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদবে?

গত বছরের অক্টোবরে আইনমন্ত্রী জাতীয় সংসদে জানান, দেশে মোট বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৪ লাখ ৫৩ হাজার ৩৫৩টি। এর মধ্যে দেওয়ানি ১৩ লাখ ৯৭ হাজার ৩৫৪টি, ফৌজদারি ১৯ লাখ ৬৭ হাজার ১৬৫টি এবং অন্যান্য ৮৮ হাজার ৮৩৪টি। তবে ইউএনডিপির পূর্বাভাস মতে ২০২০ সালের মধ্যে দেশে মামলার জট ৫০ লাখে দাঁড়াবে।

২০২১ সালে বাংলাদেশ যখন মধ্যম আয়ের দেশ হবে, মামলার জটে আক্রান্ত জাতি তখন মধ্যম আয়ের দেশের সুখ কী করে বিনা জঞ্জালে উপভোগ করবে? যদিও বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে (২০০৯-২০১৮) জেলা ও দায়রা জজ আদালত এবং সমপর্যায়ের ট্রাইব্যুনালে মোট ১ কোটি ১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৬১টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে। মামলার জট কমাতে আরো বিচারক নিয়োগ প্রয়োজন। একটি উন্নত ও সভ্য দেশ গঠনে সব নাগরিকের ন্যায় বিচার পাবার অধিকার আছে।

শুধু আলোচিত মামলা নয়, সব মামলার কার্যক্রম সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে পরিচালনা করতে হবে। মনে রাখতে হবে অন্যায়ভাবে কোনো নাগরিককে যেন বিনাবিচারে কারাভোগ না করতে হয়।কথিত আছে- ‘আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে দশজন দোষী ব্যক্তি বের হয়ে যেতে পারে, কিন্তু একজন নিরপরাধ ব্যক্তি যেন শাস্তি না পায়’। এটাই বিচারের মূলনীতি।

সবল দুর্বল সবার জন্য যেন ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা যায়। ‘আইন মাকড়সার জালের মত, ক্ষুদ্র কেউ পরলে আটকে যায় বড়োরা ছিড়ে বেড়িয়ে আসে।’ -(সলোন)। এমনটি যেন না হয়। ন্যায় বিচার না থাকলে সামাজিক অবক্ষয় অস্থিরতা বেড়ে চলে।

মারটিন লুথার কিং জুনিয়রের মতে, ‘Injustice anywhere is a threat to justice everywhere’। বঙ্গবন্ধুর খুনি, জাতীয় চারনেতার হত্যাকান্ড ও যুদ্ধ অপরাধীদের মতো আলোচিত বিচারগুলো সুষ্ঠুভাবে নিষ্পন্ন হওয়ায় জাতি ন্যায়বিচার পাবার স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া কিছু হত্যাকান্ডের বিচার না হওয়ায় জাতি আশাহত। আশা করি সরকার সর্বক্ষেত্রে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে। যা নাগরিকদের ন্যায় বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করবে।

হযরত আলী (রা.)বলেন, ‘রাজ্যের পতন হয় দেশ হতে সুবিচার উঠে গেলে, কারণ সুবিচারে রাজ্য স্থায়ী হয়। সুবিচারকের কোন বন্ধুর দরকার হয় না।’


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence