মুসলিম বিশ্বের সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ জাতিসংঘ
- মো. আবু রায়হান
- প্রকাশ: ২৪ অক্টোবর ২০১৯, ০৮:১২ PM , আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০১:২০ PM
আজ ২৪ অক্টোবর। আজকের দিনে বিশ্ববাসীকে যুদ্ধ এবং অশান্তি থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করা হয়। জাতিসংঘে সনদের মূলকথা সকল রাষ্ট্রের প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গি, সকল রাষ্ট্রের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। কেউ অন্য রাষ্ট্রের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের উপর হস্তক্ষেপ করবে না। কোন রাষ্ট্রের সাথে অপর কোন রাষ্ট্রের বিরোধ দেখা দিলে তা জাতিসংঘের মাধ্যমে সমাধান হবে এবং জাতিসংঘের সেই সিদ্ধান্তের বাইরে কোন রাষ্ট্র কাজ করবে না। কিন্তু কাগজে-কলমে সবাই জাতিসংঘের মূল সনদের সাথে ঐক্যমত পোষণ করলে ও বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে বৃহৎ শক্তিসমূহ বরাবরই পালন করেছে উল্টো ভূমিকা। বিশেষ করে মুসলিমববিশ্বের সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘ পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
যদিও বিশ্বের অনেক সংকটের সমাধানে জাতিসংঘ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু মুসলিমবিশ্বের কঠিন মুহুর্তে জাতিসংঘ থেকেছে নীরব ও নিরুদ্বেগ। সেক্ষেত্রে জাতিসংঘের কার্যকলাপ মুসলমানদের মনে সংশয়ের বীজ বপন করেছে। অবশ্য এর পেছনে যৌক্তিক কারণও রয়েছে। এজন্য বারবার মুসলিমদেশগুলো থেকে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় আলাদা জাতিসংঘ গঠনের প্রস্তাব করা হয়ে থাকে। যদিও ওআইসি মুসলিমবিশ্বের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারছে না।
আমরা চাই, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বিশ্বের ১৮০ কোটি মুসলমানের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্ব থাকুক। বিশ্ব শান্তির জন্য নিরাপত্তা পরিষদে মুসলিম বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব থাকতেই হবে। জাতিসংঘ সনদেই তার ব্যর্থতার বীজ নিহিত রয়েছে। আর সেটা হচ্ছে ভেটো ক্ষমতা, যার মালিক হচ্ছে বৃহৎ পাঁচ রাষ্ট্র তথা যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রিটেন, চীন এবং ফ্রান্স। এরা সম্মিলিতভাবে কৌশলে এই ভেটো ক্ষমতা প্রবর্তন করেছে এবং এর মালিকানা নিজেরা নিয়ে নিয়েছে।
বিশ্বে মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় ১৮০ কোটি। এটা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ। বর্তমান বিশ্বে ৬০টি মুসলিম রাষ্ট্র।
২০১৭ সালে, বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ২৪.১ শতাংশ মুসলমান ছিল। এর মধ্যে, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রায় ৬২ শতাংশ, মধ্যপ্রাচ্য-উত্তর আফ্রিকায় ৯১ শতাংশ, সাব-সাহারান আফ্রিকায় ২৫ শতাংশ, ইউরোপে প্রায় ৩ শতাংশ এবং আমেরিকায় ০.৩ শতাংশ। ওআইসিভুক্ত ৫৭টি মুসলিম দেশ পৃথিবীর ২৩ শতাংশ ভূমির অধিকারী। পৃথিবীর মোট তেল ও গ্যাসের ৮০ ভাগ, বয়লার ৬০ ভাগ, স্বর্ণের ৬৫ ভাগ, রাবার ও পাটের ৭৫ ভাগ ও খেজুরের ১০০ ভাগই মুসলিম দেশগুলোর। বর্তমানে অমুসলিম বিশ্বের ৮৭ ভাগ বাণিজ্যই মুসলিম দেশগুলোর সাথে। তারপরও মুসলিমবিশ্ব আজ অবহেলিত এবং মুসলমানরা চরমভাবে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত।
মুসলিমবিশ্বের যেসব সমস্যা সমাধানে এখনো পর্যন্ত জাতিসংঘ যেসব ইস্যুতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে সেগুলো হলো -
ক. কাশ্মীর বিষয়ে সমাধান না করতে পারা: ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘেই কাশ্মীরের গণভোট অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়েছিল এবং গণভোটের ফলাফলের ভিত্তিতে কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। অথচ জাতিসংঘের সেই সিদ্ধান্ত আজো বাস্তবায়িত হয়নি বৃহৎ শক্তিসমূহের অনিহার কারণে। বর্তমান কাশ্মীরের জনগণ বন্দী জীবনযাপন করছে। ভারত সেখানে দশ লক্ষ সৈন্য মোতায়েন করে রেখেছে।
খ. ইসরায়েলের আগ্রাসন বন্ধে ব্যর্থতা: ১৯৪৮ সালে ইসরাইলের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের ওপর চালিয়ে যাচ্ছে বর্বরতা ও নির্যাতন। এটা তো বিশ্ববাসীর কাছে দিবালোকের মত পরিষ্কার। ফিলিস্তিনের উপর পরিচালিত ইসরাইলি এই হত্যা এবং নির্যাতনও কিন্তু জাতিসংঘ বন্ধ করতে পারেনি। জাতিসংঘে এ পর্যন্ত যতবারই ইসরাইলের বর্বরতার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোন প্রস্তাব এসেছে ততবারই যুক্তরাষ্ট্র ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে সেই প্রস্তাবকে বাতিল করে দিয়েছে।
গ. বসনিয়ার নৃশংসতা বন্ধে ব্যর্থতা: সার্ব খ্রিস্টানদের নির্যাতনে বসনিয়ার দুই লক্ষ মুসলমান প্রাণ হারিয়েছে। এক্ষেত্রে ও জাতিসংঘ সার্বদের বর্বরতার হাত থেকে বসনিয়ার নিরপরাধ মুসলমানদেরকে রক্ষা করতে পারেনি। বসনিয়া হার্জেগোভিনার ইতিহাস আমরা জানি। হাজার হাজার মুসলিম নর-নারীকে সেখানে নির্মমভাবে হত্যা ও অগণিত মুসলিম নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। মুসলিমদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়েছে।
ঘ. মুসলিম স্বাধীনতাকামীদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ: চেচনিয়া আর মিন্দানাওয়ের মুসলমানরা পারেনি স্বাধীনতা অর্জন করতে। অথচ জাতিসংঘ ঠিকই পূর্বতিমুরের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করেছে। সেখানে গণভোটে অনুষ্ঠান করেছে এবং সেই গণভোটের রায় অনুযায়ী পূর্বতিমুরকে স্বাধীন করেছে। পূর্বতিমুর যেহেতু একটি খ্রিস্টান অধ্যুষিত এলাকা এবং এটি যেহেতু মুসলিম প্রধান ইন্দোনেশিয়ার অন্তুর্ভুক্ত, তাই মুসলমানদের কাছ থেকে খ্রিস্টানদের স্বাধীন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা জাতিসংঘের মাধ্যমে সেখানে গণভোটের মাধ্যমে পূর্বতিমুরকে স্বাধীনের ব্যবস্থা করেছে। একই ঘটনা সুদানের বেলায়ও তারা বাস্তবায়িত হয়েছে। সুদানকে ভেঙ্গে দক্ষিণ সুদান নামে আলাদা খ্রিস্টান রাষ্ট্র বানিয়েছে। অথচ চেচনিয়া, মিন্দানাও কাশ্মীর, চিনের জিনজিয়াং, রাশিয়ার দাগেস্তান, শ্রীলঙ্কার মান্নার দ্বীপের ব্যাপারে জাতিসংঘের ভূমিকা সম্পূর্ণ উল্টো ও বধির টাইপের।
ঙ. রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতা: এ সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘ চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। মিয়ানমার রোহিংগা মুসলমানদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন চালালেও, জাতিসংঘ রোহিঙ্গা মুলনমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এখনও ছয় লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে৷ তারা ‘গণহত্যার মারাত্মক ঝুঁকির’ মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনে জাতিসংঘের নেই কোনো পদক্ষেপ।
২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসের হিসেব অনুযায়ী, ২৫ আগস্ট ২০১৭ সালে মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর দ্বারা শুরু হওয়া গণহত্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রায় ৬ লাখ ৫৫ হাজার থেকে ৭ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।বিগত তিন দশক ধরে মায়ানমার সরকারের সহিংস নির্যাতন থেকে ৩ লাখের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে অবস্থান করছে। এ মুহূর্তে কক্সবাজারে সব মিলিয়ে অন্তত ১১ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে।
চ. অন্যান্য: সিরিয়ার যুদ্ধ বন্ধ করতে না পারা, লিবিয়া বা ইরাকে বেসামরিক মানুষকে রক্ষা ও গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র ধ্বংসের নামে ইরাকে, সোমালিয়ায় যুদ্ধের আয়োজন করে দিয়েছে জাতিসংঘ। ন্যাটো জোটকে বিশ্বের যত্রতত্র যুদ্ধের বৈধতাও দিয়েছে জাতিসংঘ। আফগানিস্তানে লাদেনকে ধরার নামে আমেরিকা এবং ইংল্যান্ড দেশটিকে তছনছ করলো অথচ জাতিসংঘ ছিল নীরব দর্শক।
মোটা দাগে উপরিউক্ত সমস্যা গুলো জাতিসংঘের সমাধান করার এখতিয়ারে থাকলেও জাতিসংঘ তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। শুধু জাতিসংঘকে মুসলিম বিশ্বের করুণ পরিস্থিতির জন্য দায়ী করে লাভ কী? মুসলমানরা এ পরিস্থিতির জন্য কম দায়ী নয়।
বিশ্বে ৬০টি মুসলিম দেশের মধ্যে অন্তত ৫টি দেশে সরাসরি যুদ্ধ চলছে। এছাড়া ১০টি দেশ সন্ত্রাস ও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। ৫টি দেশের সন্ত্রাস জঙ্গীদের থাবায় আক্রান্ত হবার আশংকা রয়েছে। অপরদিকে প্রায় ২০টি মুসলিম দেশ একে অপরের বিরুদ্ধাচরণ কিংবা পরোক্ষভাবে হানাহানি উস্কে দিচ্ছে। এক কথায় ৬০টি মুসলিম দেশের মধ্যে ৩৫টি দেশ চরম অশান্তির মধ্যে অবস্থান করছে। অবশিষ্ট ২৫টি দেশ মোটামুটি অনেকটা নিরাপদ। এক্ষেত্রে আবার ২৫টি নিরাপদ দেশ নিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, এদের অধিকাংশ দেশ পশ্চিমা দোসর কিংবা তাবেদার সরকার দ্বারা পরিচালিত।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক।