সবার বিচার চাওয়ার অধিকার আছে, পাবার অধিকার নেই
- মো. আবু রায়হান
- প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০১৯, ০৩:৩২ PM , আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১২:১৩ PM
আমরা আবরার ফাহাদের জন্য যে ন্যায় বিচার পাবো না তা অনেকটাই নিশ্চিত।এর পেছনে যৌক্তিক অনুমান আছে।পূর্বে ঘটে যাওয়া এরকম বীভৎস দুটো ঘটনা এখানে উপস্থাপন করলে বিষয়টি পরিস্কার হবে। ঘটনা দুটো হলো বিশ্বজিৎ ও ঢাবি শিক্ষার্থী আবুবকরের হত্যাকান্ডের ঘটনা। দুটো ঘটনায় মামলা হয়েছিল কিন্তু সেই গুরুত্বপূর্ণ মামলার বিচারের নামে আমরা প্রহসন দেখেছি।গত এক দশকে বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘর্ষে দুই ডজন শিক্ষার্থী নিহত হবার খবর আমরা জানি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি), বুয়েট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ (চবি) দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে রাজনৈতিক সহিংসতায় লাশ হয়েছেন এসব শিক্ষার্থী। লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের আধিপত্য বিস্তার, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি মূলত এসব হত্যাকান্ডের প্রধান কারণ।
এসব হত্যাকান্ডের অধিকাংশই বিচার হয়নি। অপরাধীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আবরার ফাহাদের যে সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত হবে না তার প্রধান কয়েকটি কারণ হতে পারে, নিম্নোক্ত ঘটনা গুলো,
প্রথমত: প্রথমেই আবরার হত্যাকান্ডের সিসিটিভির ফুটেছ গায়েব বা নষ্ট করে আবরার হত্যাকান্ডের মূল হোতাদের আড়ালের চেষ্টা।
দ্বিতীয়ত: আবরার হত্যাকান্ডে অংশ নেওয়া অন্যতম অভিযুক্ত অমিত সাহাকে গ্রেফতার না করা ও অভিযুক্তদের তালিকায় তার নাম থাকা। আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় ১৯ জনকে আসামি করা হয়েছে।এই মামলা থেকে রহস্যজনক ভাবে বাদ পড়েছে আবরার হত্যাকান্ডের অন্যতম অভিযুক্ত বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের আইন বিষয়ক উপ সম্পাদক অমিত সাহা। খোঁজ নিয়ে জানা যায় সে শেরে- বাংলা হলের ২০১১ নং রুমে থাকতো যে রুমে আবরারকে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আবরারের একাধিক সহপাঠী অভিযোগ করে বলেন, এই হত্যাকান্ডের সাথে আমিত সাহা সরাসরি সম্পৃক্ত কিন্ত রহস্যজনকভাবে মামলার এজহার থেকে তার নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। পত্র পত্রিকা ও টেলিভিশনেও তার সমপৃক্ততার খবর প্রচারিত হলেও তাকে এখনো আইনের আওতায় আনা হয়নি।
তৃতীয়ত: দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি।
চতুর্থত: আগেই বলেছি আলোচিত আবু বকর ও বিশ্বজিৎ হত্যার সুষ্ঠু বিচার না হওয়া ও অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত না করতে পারা। আজ বিচার ব্যবস্থা হয়েছে সক্রেটিসের বহুল আলোচিত বাণীর ন্যায়,
'যার টাকা আছে তার কাছে আইন খোলা আকাশের মত, আর যার টাকা নেই তার কাছে আইন মাকড়ষার জালের মত!'এবার আসি আবু বকর ও বিশ্বজিতের মামলা ও বিচার প্রসঙ্গে।
বর্তমান সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের এক বছরের মাথায় ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নির্মমভাবে নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের মেধাবী ছাত্র আবু বকর। ঘটনার পর হলের আবাসিক ছাত্র ওমর ফারুক বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটির তদন্ত শেষে এফ রহমান হল শাখার তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি সাইদুজ্জামান ফারুকসহ আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় শাহবাগ থানার পুলিশ।
পরে বাদীর নারাজি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে সিআইডি মামলাটির অধিকতর তদন্তের ভার নেয় এবং ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়। তাতে আগের আটজনসহ আরও দুজনকে অভিযুক্ত করা হয়। আসামীদের সবাই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ছিলেন। কিন্তু এই হত্যা মামলার রায়ে ছাত্রলীগের সাবেক ১০ নেতাকর্মীর সবাই পরবর্তীতে বেকসুর খালাস পান।বড় বিস্ময়কর ব্যাপার হলো মামলার রায় হওয়ার আট মাস পর গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়।এ মামলার রায়ের বিষয়ে নিহত আবু বকরের বাবা-মা, এমনকি বাদীকে রায় সম্পর্কে কিছুই জানানো হয়নি।এই হলো বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা ও অপরাধীর শাস্তি!
দ্বিতীয় বহুল আলোচিত ঘটনা ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর ১৮ দলের অবরোধ কর্মসূচির দিনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বাহাদুর শাহ পার্কে দর্জি দোকানি বিশ্বজিৎ দাসকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।যে হত্যাকান্ডের দৃশ্য গোটা জাতিকে হতবিহবল ও বিস্মিত করেছিল। এ ঘটনায় আটজনের মৃত্যুদন্ড ও ১৩ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ডের রায় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বড়ই কষ্টের খবর কি জানেন? মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত দুজন ও যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত ১১ জনই পলাতক। এ হচ্ছে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঘটা বহুল আলোচিত দুটো হত্যাকান্ডের বিচার। তাহলে আবরারের ক্ষেত্রে আমরা কি বিচার পেতে পারি। আদৌও কি সুষ্ঠু বিচার পাবো? আপাতত বলতে হয় না পাবো না। কেননা উপরে আলোচিত মামলা দুটোর আসামী আর আবরার খুনের আসামিরা একই ঘরানার ও শক্তি সামর্থ্যের অধিকারী। আমরা পারি স্লোগান দিতে, অপরাধীর শাস্তি দাবি করতে কিন্তু বাকি কাজ আদালতের।
আমরা We want justice বলে স্লোগান দিয়ে মুখে ফেনা তুলতে পারি কিন্তু ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে পারি না।আবরার খুনের আসামিকে যখন পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায়, কি দেখলেন? হাসি খুশি জলি মুডে। এরপরও আপনারা ন্যায় বিচারের স্বপ্ন দেখেন?এদেশে সবার বিচার চাওয়ার অধিকার আছে কিন্তু বিচার পাবার অধিকার নেই।শেষ করি হযরত আলীর একটি উক্তি দিয়ে, 'রাজ্যের পতন হয় দেশ হতে সুবিচার উঠে গেলে, কারণ সুবিচারে রাজ্য স্থায়ী হয়। সুবিচারকের কোন বন্ধুর দরকার হয় না। ”তবে আশা করি বিশ্বজিৎ ও আবুবকরের প্রতি এ রাষ্ট্র যে অবিচার ও নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে আবরারের ক্ষেত্রে তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। রাষ্ট্র আবরারের খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করে মানবিকতা ও ন্যায় বিচারের নজির উপস্থাপন করবে। আমাদের যাবতীয় অনুমান ও ধারণা ভুল প্রমাণিত করবে।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক