মুজিবের মেয়ে বলে ঢাবি ভর্তিতে শেখ হাসিনাকে বেগ পেতে হয়েছিল

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেখ হাসিনা
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেখ হাসিনা  © ফাইল ফটো

বাংলাদেশের চারবারের সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আজ শনিবার তার ৭৩তম জন্মদিন। শেখ হাসিনার শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছে পারিবারিক আঙিনায়। মৌলভী, পণ্ডিত ও মাস্টার বাড়িতেই থাকতেন। তাদের কাছ থেকেই শেখ পরিবারের শিশুরা শিশুশিক্ষা গ্রহণ করত। শেখ হাসিনারও হাতেখড়ি পারিবারিক সেই পাঠশালায়। তারপর তিনি টুঙ্গিপাড়ার নিকটবর্তী করালকোপা প্রাইমারি স্কুলে পড়তে যান।

এ বিষয়ে শেখ হাসিনা নিজেই লিখেছেন, ‘আমাদের পরিবারের জন্য মৌলভী, পণ্ডিত ও মাস্টার বাড়িতেই থাকতেন। আমরা বাড়ির সব ছেলেমেয়ে সকাল-সন্ধ্যা তাদের কাছে লেখাপড়া শিখতাম। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলেও কিছুদিন পড়াশোনা করেছিলাম’। 

স্মৃতির দক্ষিণ দুয়ার খোলা: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৩ সালের ১৪ নভেম্বর ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে কাউন্সিলরদের ভোটে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। সে সময় রাজনৈতিক কারণে তাকে ঢাকায় থাকতে হতো। ফলে সে বছরই তিনি সপরিবারে বসবাসের জন্য ঢাকার মোগলটুলির রজনীবোস লেনে বাসা ভাড়া নেন। এ রজনীবোস লেনের বাসায় শুরু হয় শেখ হাসিনার গ্রাম ছাড়া সেই দূরের শহর জীবনের নতুন অধ্যায়। সে সময় শেখ হাসিনার সাত বছরের মতো বয়স ছিল। ১৯৫৬ সালে তাকে টিকাটুলির নারী শিক্ষা মন্দিরে ভর্তি করে দেওয়া হয়। বর্তমানে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি শেরেবাংলা গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামে পরিচিত।

এ স্কুলে ভর্তি প্রসঙ্গে শেখ হাসিনার ক্লাসমেট সুলতানা কামাল লিখেছেন, ‘সেই প্রেক্ষিতে হাসিনা ভর্তি হলো নারী শিক্ষা মন্দিরে। আমারও প্রাথমিক শিক্ষার শুরু নারী শিক্ষা মন্দিরে, লীলা নাগ প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে। হাসিনা আমি তৃতীয় শ্রেণি থেকে সহপাঠী হলাম।’ 

নেতা ও বন্ধু শেখ হাসিনা: ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর থেকে বঙ্গবন্ধু পরিবার নিয়ে ধানমন্ডির নিজস্ব বাসভবনে বসবাস শুরু করেন। শেখ হাসিনা সে সময় নারী শিক্ষা মন্দির ছেড়ে এসে আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৬৫ সালে তিনি এ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। মাধ্যমিক পর্যায় অতিক্রমের পর তিনি তৎকালীন ইডেন কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শাখা গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হন। পরবর্তীকালে ইডেন কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শাখা গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজটি বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ নামে আলাদা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠে। 

১৯৬৬ সালের ৮ জুন বঙ্গবন্ধুকে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। সে সময় বেগম ফজিলাতুন্নেছাও সরকারের রোষানলের শিকার হন। পরিবারটি অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু বেগম ফজিলাতুন্নেছাও ছিলেন অত্যন্ত সাহসী, দৃঢ়চেতা এবং পরম কষ্টসহিষ্ণু ধৈর্যশীল নারী। নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেও সন্তানদের তিনি আগলে রেখেছেন, লেখাপড়া করার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।

সে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘১৯৬৬ সালের কথা। কয়েকদিন ধরে আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটির সভা চলছিল। আমার তখন উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের কয়েকটা পরীক্ষা, যার নম্বর দ্বিতীয় বর্ষে যোগ হবে। কিন্তু পড়ব কি, মিটিং চলছে বাড়িতে, মন পড়ে থাকে সেখানেই। একবার পড়তে বসি, আবার ছুটে এসে জানালার পাশে বসে মিটিং শুনি, সবাইকে চা বানিয়ে দিই। যাক সেসব। বিকেলে নারায়ণগঞ্জে বিশাল জনসভা হলো ছয় দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য। আব্বা বিছানায় শুতে গেলেন। আমি পড়তে বসলাম। ওই বছরই বাড়ির দোতলার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কাজেই দোতলার পেছনের উত্তর-পূর্ব দিকের ঘরটা আমার, দক্ষিণে বড় জানালা। আমি খুব জোরে পড়তাম ঘুম তাড়ানোর জন্য। এর মধ্যে নিচ থেকে মামার চিৎকার শুনলাম। পুলিশ এসেছে, বাড়িতে ঢুকতে চায়, গেটের তালা খুলতে বলে। আব্বাকে ওরা নিয়ে গেল। ছোট রাসেল অবুঝ, অঘোরে ঘুমুচ্ছে কিছুই বুঝবে না, জানবে না। সকাল হয়ে গেল, পড়াশোনা আর হলো না। মনে হলো বাড়িটা বড় শূন্য ফাঁকা। এতদিনের কর্মচাঞ্চল্য হঠাৎ করে যেন থেমে গেল। সারাটা দিন কারও খাওয়া-দাওয়া হলো না।’ 

স্মৃতির দক্ষিণ দুয়ার খোলা: এই গ্রেপ্তারের পর বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তিলাভ করেন। জেনারেল আইয়ুব খানের চক্রান্তমূলক এ গ্রেপ্তারের পর বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিকূলতার মধ্যে পড়তে হয়েছে। যেসব দলীয় নেতা নিয়মিত বাসায় আসতেন, সরকারের রোষানলে পড়ার ভয়ে তাদের অনেকেই আসা বন্ধ করে দেন। একসময় কয়েকজন একান্ত আত্মীয় ছাড়া পরিবারটির খোঁজ নেওয়ার কেউ ছিল না। সেই প্রতিকূল প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। 

১৯৬৭ সাল। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান। তিনি হয়তো গল্পের সেই রাখাল বালকের মতো উপলব্ধি করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক অভিঘাতেই তার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে। হয়তো তাই পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হওয়ার পর থেকে তিনি বঙ্গবন্ধুকে হয়রানি ও নিঃশেষ করে দেওয়ার সবরকম প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। সে সময় সুধীমহলের সবাই জানতেন, গভর্নর মোনায়েম খানের প্রধান প্রতিপক্ষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ছিলেন তারই নিয়োজিত ড. ওসমান গণি। তিনিও ব্যক্তিগতভাবে প্রবল আওয়ামী লীগ বিদ্বেষী ছিলেন। সেই প্রতিকূল সময়ে শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য যান। কিন্তু ড. ওসমান গণির আক্রোশের ভয়ে সে সময় সরকারের প্রবল প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা, কারাবন্দি ও বিচারাধীন শেখ মুজিবের মেয়েকে ভর্তি করতে অনেক বিভাগ আগ্রহী ছিল না। সে সময় শেখ হাসিনাকে বাংলা বিভাগে ভর্তি করার বিষয়ে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী প্রবল আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঢাকা জেলে বন্দি ছিলেন। সেখানেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর আগ্রহে শেখ হাসিনা বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। তারপর তিনি নিয়মিত ক্লাস শুরু করলেন। 

শেখ হাসিনা লেখাপড়া ও শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়ে খুবই মনোযোগী ছিলেন। অত্যন্ত প্রাণোচ্ছল শেখ হাসিনা সহপাঠীদের সঙ্গেও ছিলেন খুব আন্তরিক। শিক্ষকদেরও তিনি অপরিসীম শ্রদ্ধা করতেন। সদালাপী ও সরলতায় তিনি অল্পসময়ে সবার আপন হয়ে ওঠেন। তার সম্পর্কে বেবী মওদুদ লিখেছেন, ‘শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ও পরিচয় হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষ অনার্স ক্লাসে, সেপ্টেম্বর ১৯৬৭ সালে। আমরা দুজন একই ক্লাসে পড়তাম। শেখ হাসিনা ঢাকায় স্কুল ও কলেজে লেখাপড়া করেছেন, তাই তার বন্ধুর সংখ্যাও ছিল অনেক। সবার মাঝে সে ছিল আনন্দময় বন্ধু, সহমর্মী সাথি। তার এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ছিল বলে সে সবার প্রিয় ছিল। সবাই তাকে চিনত, জানত এবং তার সঙ্গে কথা বলে গল্প করে সময় কাটাতে দ্বিধাবোধ করত না। আমি ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থক হলেও তার সঙ্গে বা তার বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে বিন্দুমাত্র অস্বস্তি বোধ করতাম না। সবার সঙ্গেই তার ছিল অগাধ বন্ধুত্ব এবং ভালোবাসা। খুব বড় মাপের মানুষের গড়ে ওঠার পেছনে এটা একটা বড় গুণ। তখন থেকেই দেখেছি তার মধ্যে বই পড়ার নেশা, রাজনীতিমনস্ক হয়ে ওঠা, মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে সাহায্য করা। অত্যন্ত বিনয়ী এবং শুদ্ধতম বাঙালি হয়ে ওঠার পেছনেও তাদের একটা পারিবারিক মূল্যবোধ আছে সত্য, তারপরও পিতা-মাতার প্রভাব শেখ হাসিনাকে একজন আদর্শ, মমতাময়ী মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছে।’ 

দেশ ও জাতির কল্যাণে সবার প্রিয় শেখ হাসিনা: ১৯৭১ সালে শেখ হাসিনার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে সময়টায় শেখ হাসিনা পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে বন্দি ছিলেন। অন্যদিকে, ছিলেন সন্তান-সম্ভবা। তার পক্ষে তখন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। ফলে সাবসিডিয়ারি পাস করে তৃতীয় বর্ষের ক্লাস কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করলেও শেখ হাসিনা বাংলায় অনার্স সম্পন্ন করতে পারেননি। তবে স্বাধীনতা-উত্তর ১৯৭৩ সালে সন্তান-সংসারের দায়িত্ব পালন করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কঠিন নিয়মে পরীক্ষা দিয়ে বিএ পাস করেন। নিয়মটি ছিল- ইলেকটিভ বিষয়, বিএ পাস কোর্সের বাধ্যতামূলক ইংরেজি ও বাংলা পরীক্ষা দিয়ে পাস করলে একজন সাবসিডিয়ারি পাস ছাত্র বা ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ ডিগ্রি অর্জন করার যোগ্যতা লাভ করত। 

সেই নিয়মানুসারে শেখ হাসিনা ৩০০ নম্বরের ইলেকটিভ বিষয় হিসেবে বাংলা সাহিত্য, ১০০ নম্বরের ডিগ্রি পাস কোর্সের ইংরেজি, ১০০ নম্বরের ডিগ্রি পাস কোর্সের বাংলা, সর্বমোট ৫০০ নম্বরের পরীক্ষা দেন। সাবসিডিয়ারিতে ৬০০ নম্বরের পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ ছিলেন। সুতরাং মোট ১১০০ নম্বরের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। 

শেখ হাসিনা স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে বিদেশে অবস্থান ও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কারণে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করতে পারেননি। 

এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরেও শেখ হাসিনা ছায়ানট সংগীত বিদ্যালয়ে ভায়োলিন শিখেছেন, সংস্কৃতিচর্চা করেছেন। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকে নিজেকে উৎকর্ষমণ্ডিত করেছেন। শেখ হাসিনা ছোটবেলা থেকেই ব্যতিক্রম প্রকৃতির ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে প্রকৃতিময় পরিবেশে, স্নেহপূর্ণ পারিবারিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে, পিতার ব্যাপক রাজনৈতিক পরিধির মাঝে শেখ হাসিনা বিকশিত হয়েছেন এক মহৎ শিক্ষায়। 

লেখক: গবেষক ও লেখক


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence