আগুনে অঙ্গার হয়ে গেল ১৬ জীবন, সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখে মনে হয় যেন কিছুই হয়নি
- শরিফুল হাসান
- প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:০৯ PM
রাজধানীর মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে পোশাক কারখানা ও রাসায়নিকের গুদামে আগুনের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৬ জন হয়েছে। আহত হয়েছে অনেকেই। এ ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। একটু ভেবে দেখুন, ১৬ জুন মানুষ আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেল, এতোটাই অঙ্গার যে ডিএনএ টেস্ট ছাড়া কাউকে শনাক্ত করা সম্ভব নয়! এ ঘটনাটি আজ দেশের সব ছাপা পত্রিকার প্রধান খবর। তবে ফেসবুকে খুব বেশি হইচই নেই, যেন কিছুই হয়নি। কারণ বোধহয় আমরা মেনে নিয়েছি যে, এই দেশে মানুষ এভাবে মরবে। প্রতিবার আগুন লাগার পর সেই পুরোনো কথাই জানবেন, পোশাক কারখানার ভবন বা রাসায়নিকের গুদামের কোনোটিরই অগ্নিনিরাপত্তা সনদ ছিল না। যে পোশাক কারখানার ভবন থেকে মরদেহগুলো উদ্ধার করা হয়েছে, সেই ভবনের ছাদের দরজায় দুটি তালা লাগানো ছিল। এর ফলে কারখানার শ্রমিকেরা কেউ ওপরে উঠতে পারেননি। এই কোন গল্পই অচেনা নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এভাবে আর কত?
আপনাদের কী মনে আছে? বেইলি রোডে আগুন লেগে ৪৬ জন মারা যাওয়ার পর রাজউক বলেছিল, তারা ঢাকার প্রতিটি ভবনের নকশা ও অনুমোদন খতিয়ে দেখবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। কোথায় সেই তদারকি? এর আগে বনানীর ভবন থেকে শুরু করে প্রতিটি আগুনের ঘটনার পর বলা হয়েছে এই শহরের প্রতিটি ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা দেখা হবে। কেন হয়নি? এর দায় কার?
অনেকবার লিখেছি, এই দেশে ভবনে কোনো দুর্ঘটনা বা আগুন লাগার পর জানা যায় অনুমোদন নেই। বাস বা লঞ্চে যে কোনো দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর পর জানা যায় ফিটনেস নেই। সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে সন্তানের মৃত্যুর পর জানা যায় হাসপাতালের অনুমোদন নেই। তার পরে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কারো ঘুম ভাঙে না। এ কারণেই আমি বলি, এগুলো কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড!
রাজউক বলে, বিআরটিএ বলে, ওয়াসা বলে, তিতাস বলে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইত্যাদি কত যে সরকারি সংস্থা ও মন্ত্রণালয় আছে এই দেশে! কিন্তু প্রত্যেকটা সরকারি সেবা সংস্থার সবাই যেন ঘুমিয়ে আছে। সেখানে গড়ে ওঠে দুর্নীতির পাহাড়। আচ্ছা, ঘুষ না দিয়ে রাজউক থেকে এই শহরে কতজন মানুষ ভবন নির্মাণের অনুমোদন পেয়েছে, শুধু সেই জরিপটা চলুক, তাহলেই বোঝা যাবে তাদের মান! প্রতিটি সরকারি সেবা দপ্তরের অবস্থা একই রকম।
৫৪ বছর ধরেই একই অবস্থা! কোথাও কোনো পরিবর্তন নেই! এসব কারণেই আমি এগুলোকে আর এখন দুর্ঘটনা বলি না—এগুলো কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড! আপনি কাজে গিয়ে আগুনে পুড়ে যাবেন, খেতে গিয়ে মরবেন, হাসপাতালে সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে মরবে আপনার সন্তান, এন্ডোস্কপি করাতে গিয়ে মরবে আপনার ভাই, নির্মাণাধীন ভবনের রড পড়ে মারা যাবে কোন বাবা; বাস দুর্ঘটনা, ট্রেনে আগুন কিংবা ভবনের আগুনে মারা যাবে সাধারণ মানুষ; গার্মেন্টস বা কারখানায় মরবে শ্রমিক আর সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা স্কুলে পুড়ে মরতে হবে নিষ্পাপ শিশুদের!
সাংবাদিক হিসেবে আগুনে পুড়ে মরে যাওয়া অসংখ্য মানুষের আহাজারি দেখতে হয়েছে। এই যে ১৬টি পরিবার শেষ হয়ে গেল—তারাই জানে বেদনা! লাশটাও তারা চিনতে পারছেন না! এই কষ্ট, এই আর্তনাদ বুক চিরে যায়। আমার বেশ মনে আছে তাজরীন কারখানার ঘটনা; তারিখটা ছিল ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর। আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন কারখানায় সেদিন আগুনে ১১১ জন শ্রমিক পুড়ে অঙ্গার হয়ে গিয়েছিলেন। পরে সেই লাশগুলো উদ্ধার করে একটা স্কুল মাঠে সারি সারি করে রাখা হয়। অবশ্য লাশ না; কঙ্কালের মতো, বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল। এর মধ্যেই পরম মমতায় ব্যাগে মোড়ানো একেকটি মৃতদেহ ছুঁয়ে চেনার চেষ্টা করছিলেন স্বজনেরা। পুড়ে যাওয়া এমন একটি কঙ্কালসম শরীরের কানে সোনার দুল দেখে চিৎকার করে উঠেছিলেন রাজবাড়ির মোহাম্মদ শোয়েব। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেছিলেন, ‘এটাই আমার স্ত্রী শিউলির লাশ’। সোনার এই দুলটা তিনি স্ত্রীকে কিনে দিয়েছিলেন; আর সেই দুল দেখে স্ত্রীর মরদেহ নিশ্চিত করতে পারলেন। আমি সেই চিৎকার কখনও ভুলব না! এভাবে আর কত মানুষ মারা যাবে?
আফসোস, প্রতিবারই মৃত্যুর ঘটনার পর নতুন করে তদন্ত কমিটি হয়, নানা আলোচনা হয়, তারপর আমরা ফের অপেক্ষা করি নতুন কোনো দুর্ঘটনার! আচ্ছা, স্বাধীনতার তো ৫৪ বছর হলো! এভাবে আর কতদিন চলবে? আর কত মানুষ মরলে আমাদের হুশ হবে? আর কত মানুষ মরলে এই রাষ্ট্রের ঘুম ভাঙবে? কবে আমরা বুঝব উন্নয়ন মানে শুধু বড় বড় ভবন নয়, জবাবদিহিতা ও সুশাসন জরুরি?
দেখেন, আমার এই প্রতিটি কথা পুরানো। গত ২০ বছরে অসংখ্যবার এই কথাগুলো লিখেছি। কিন্তু এই রাষ্ট্রের হুঁশ হয়নি। বারবার বলেই চলেছি, আপনারা যারা দেশ চালান, আপনারা যারা প্রশাসন চালান, আপনারা যারা নানা পদে বসেন, আপনারা যারা ক্ষমতাবান, আপনারা যারা নীতি-নির্ধারক, আপনাদের কাছে হাতজোড় করে বলি: জেগে উঠুন! নয়তো দেখবেন একদিন আপনার-আমার সন্তান কিংবা আমরা কেউ বেঁচে নেই। তাই দোহাই আপনাদের, ফের এমন প্রাণহানির আগে ব্যবস্থা নিন। ঘুম থেকে জাগুন, প্লিজ।
শরিফুল হাসান: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও বিশ্লেষক