জিয়াউর রহমানের শুরু করা খাল আজ ব্যর্থ এক প্রতিশ্রুতি

জিয়াউর রহমান
জিয়াউর রহমান  © সংগৃহীত

একটি খাল কখনও শুধুই পানি বয়ে নেয় না—কখনও তা বহন করে ইতিহাস, কখনও নেতৃত্বের দর্শন, আবার কখনও একটি জাতির আত্মনির্ভরতার স্বপ্ন। যশোর জেলার শার্শা উপজেলার উলাশী ইউনিয়নে অবস্থিত এমনই এক খাল আজ অচল, অবহেলিত। অথচ এই খালটির জন্ম হয়েছিল এক সময়ের রাষ্ট্রনায়ক শহীদ জিয়াউর রহমানের সরাসরি নির্দেশনায়, যার লক্ষ্য ছিল—দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় দীর্ঘস্থায়ী অবদান রাখা।

১৯৭৬ সালের নভেম্বরে যে সময় খালটির খনন কাজ শুরু হয় রাষ্ট্রপতির হাত ধরে, সেটি ছিল এক বড় স্বপ্নের সূচনা। খাদ্য ঘাটতিতে জর্জরিত বাংলাদেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান যে ১৯ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন, তার অন্যতম স্তম্ভ ছিল জলাধার নির্মাণ। দেশজুড়ে খাল খননের এই আন্দোলন ছিল কেবল অবকাঠামো উন্নয়ন নয়, বরং জনগণকে স্বেচ্ছাশ্রমকে সম্পৃক্ত করে একটি জাতিগত ঐক্যের মডেল গড়ে তোলার প্রয়াস।

উলাশীর এই খাল ছিল সে সময়কার একটি পাইলট প্রকল্প—এই মহাপরিকল্পনার সূচনা হয়েছিল যশোরের শার্শা উপজেলার উলাশী ইউনিয়নে। ১৯৭৬ সালের ১ নভেম্বর, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিজ হাতে খনন কাজের উদ্বোধন করেন উলাশী থেকে যদুনাথপুর পর্যন্ত বিস্তৃত এই খালটির। স্থানীয়রা একে শ্রদ্ধাভরে ‘জিয়া খাল’ নামে ডাকেন। খাল খননের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত আজও উলাশীর প্রবীণদের স্মৃতিতে স্পষ্টভাবে গেঁথে আছে।

খাল খননের দিন রাষ্ট্রপতি জিয়া স্থানীয় একটি ভবনে রাত যাপন করেন; যা পরবর্তীতে কৃষি সম্প্রসারণ কার্যক্রমের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। সেখানে কৃষকদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হতো বৈঠক, প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। এমনকি ছিল বীজ সংরক্ষণের ব্যবস্থাও।

এই খাল মূলত পরিকল্পিত হয়েছিল সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং প্রাকৃতিক জলাধার রক্ষার মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে। তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৯ থেকে ১৯৮১ সালের মধ্যে জিয়াউর রহমানের শাসনামলেই দেশে খনন হয় ১৫০০টির বেশি খাল, যার মোট দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ২৬ হাজার কিলোমিটার।

কিন্তু আজ সেই খাল মৃতপ্রায়। বর্ষা মৌসুমে সামান্য পানি জমলেও সেচ মৌসুমে তা কার্যত শুকিয়ে যায়। স্থানীয় কৃষকদের ভাষ্যে জানা যায়, এক সময় এই খালের মাধ্যমে পাশের বিলগুলো—বিশেষ করে সোনামুখী ও বন মান্দার বিল—জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা পেত। এখন সেখানে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে, যার খরচ বহন করা অনেকের পক্ষে সম্ভব নয়।

শার্শা উপজেলা বিএনপির উপদেষ্টা, প্রবীণ নেতা খায়রুজ্জামান মধু বলেন, ‘উলাশীর খাল শুধু একটি খাল নয়, এটি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের উন্নয়ন দর্শনের বাস্তব প্রতিফলন। এই খাল খনন হয়েছিল দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে, কৃষিকে টিকিয়ে রাখার জন্য। আজ যখন কৃষকরা সেচের জন্য হাহাকার করছে, ভূগর্ভস্থ পানির জন্য খরচে জর্জরিত, তখন খাল পুনঃখননের প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি স্পষ্ট।’

তিনি আরও বলেন, ‘খাল খননের মাধ্যমে একদিকে যেমন ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমানো যায়, অন্যদিকে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের পথও প্রসারিত হয়। ভূপৃষ্ঠের পানির ব্যবহারে খরচ কম, এবং এটি স্বাস্থ্যকরও। ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকসহ নানা ভারী ধাতু থাকতে পারে, যা মানবদেহে প্রবেশ করে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। জিয়াউর রহমান সময়ের প্রয়োজন অনুধাবন করেই যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা এখনো সময়োপযোগী।’

জাতীয় পর্যায়ে এই পরিস্থিতি কেবল একটি খালের করুণ পরিণতি নয়, বরং রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার ধারাবাহিকতা হারানোর ও গ্রামীণ অবকাঠামোর প্রতি দীর্ঘদিনের অবহেলার প্রতিচ্ছবি। যে নেতৃত্ব একদিন কৌশলগতভাবে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার ভিত গড়তে চেয়েছিল, তা আজ কেবল নথিতে টিকে আছে—ভূতের মতোই ঘুরে বেড়ায় মাঠে-ঘাটে।

বর্তমান বাস্তবতায়, যেখানে প্রতিবেশী দেশ থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা কঠিন, সেখানে বর্ষার পানি সংরক্ষণ করে শুষ্ক মৌসুমে ব্যবহারের চেয়ে কার্যকর কোনো সমাধান হতে পারে না। জলবায়ু পরিবর্তন, খরার প্রকোপ ও পানির সংকট—এই ত্রিমুখী চাপে কৃষিকে টিকিয়ে রাখতে হলে, খাল পুনঃখননের মতো সুপরিকল্পিত উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি।

উলাশীর খাল তাই আজ শুধু একটি মৃতপ্রায় জলপথ নয়, বরং এক পরিত্যক্ত সম্ভাবনার প্রতীক। যা একদিন দেখিয়েছিল নেতৃত্বের সাহসী প্রয়াস কীভাবে জনগণকে সম্পৃক্ত করে জাতীয় উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে পারে। এখন সেই পথ ফিরে পাওয়ার জন্য চাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সুসংগঠিত পরিকল্পনা এবং অতীতের শিক্ষা থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার যথাযথ প্রয়োগ।


সর্বশেষ সংবাদ

X
APPLY
NOW!