গবেষণা সম্মেলনে উৎকর্ষতা ও প্রভাব তৈরির কৌশল তৈরি করবেন কীভাবে

মো. আবুল হাসানাত
মো. আবুল হাসানাত  © টিডিসি সম্পাদিত

গবেষণা ও শিক্ষা জগতে কনফারেন্সের গুরুত্ব একেবারেই অনস্বীকার্য। একজন গবেষক হিসেবে আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে অংশগ্রহণ কেবল নতুন জ্ঞান অর্জনই নয়, বরং এটি একটি অপরিহার্য মাধ্যম যা অন্য অভিজ্ঞ গবেষক ও পেশাজীবীদের সঙ্গে মূল্যবান মতবিনিময় এবং জ্ঞান শেয়ার করার সুযোগ প্রদান করে। এমন একটি প্ল্যাটফর্মে নিজের গবেষণাকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে পারা, যেমন একটি নতুন চিন্তার জন্ম দেয়, তেমনি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে পুরানো সমস্যাগুলোর সমাধানও মেলে। 

আমি হাসানাত, একজন পুরকৌশলী বা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এবং পিএইচডি গবেষক। ২০২৪ সালে IIT Hyderabad এর অর্থায়নে গ্রীস, জার্মানি, এবং ভারতে তিনটি আন্তর্জাতিক সুনামধন্য কনফারেন্সে আমার চারটি গবেষণা উপস্থাপন করেছি- যার মধ্যে একটিতে (IWA LET 2024, জার্মানি) "সেরা গবেষণা পোস্টার" এর পুরস্কারও পেয়েছি। এই অভিজ্ঞতার আলোকে কনফারেন্সের গুরুত্ব এবং ফলপ্রসূ করার কিছু কৌশল তুলে ধরবো। যারা এখন স্নাতক পড়ছেন এবং  উচ্চশিক্ষায়  আগ্রহ থেকে থাকে, এখন থেকেই কনফারেন্সে অংশগ্রহণের অভ্যাস করতে পারেন। বাংলাদেশে সারাবছর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কনফারেন্স আয়োজন হয়, খুবই অর্থবহ হয়ে উঠবে যদি আপনি সুযোগগুলি কাজে লাগাতে পারেন।

কনফারেন্স: জ্ঞান-বিনিময়ের এক অপূর্ব মঞ্চ
কনফারেন্স- নামটা শুনলেই কেমন একটা গুরুগম্ভীর পরিবেশের ছবি মনে আসে, তাই না? সারি সারি চেয়ার, পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন, আর ভারী ভারী সব আলোচনা। কিন্তু আমার মতে, কনফারেন্স শুধু পেপার পড়া আর সার্টিফিকেট নেওয়ার জায়গা নয়, বরং এটি একটি জ্ঞানের ভোজ, যেখানে নতুন ধারণা, নতুন মানুষের সাথে পরিচয়, আর নিজের গবেষণাকে আরও উন্নত করার সুযোগ পাওয়া যায়। কনফারেন্সগুলো গবেষকদের জন্য এক অসাধারণ সুযোগ, যা তাদের ক্যারিয়ারের গতি ও গুণগত উন্নতিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে নিজের কাজকে দেখা
আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে একজন গবেষক তার নিজের গবেষণাকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার সুযোগ পান। এখানে বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞরা আপনার গবেষণা সম্পর্কে মূল্যবান মতামত দেন, যা গবেষণাকে আরও সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করে। একটি উদাহরণ দিই - সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমার উপস্থাপিত গবেষণা সম্পর্কে জাপানের একজন বিশেষজ্ঞ এমন কিছু দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন, যা আমার গবেষণাকে একটি নতুন মাত্রা দিয়েছে। আসল ব্যাপারটা হলো- দৃষ্টিভঙ্গি, কোনো একটা জিনিস ঘুরিয়ে দেখার মতো, আপনি যেই বিষয়টি ভাবেনই নেই, আরেকজনের দৃষ্টি সেখানেই পড়তে পারে। 

নেটওয়ার্কিং ও সম্ভাবনা
সম্মেলনগুলি নেটওয়ার্কিং-এর অসাধারণ সুযোগ তৈরি করে। কফি ব্রেক থেকে শুরু করে ডিনার পার্টি পর্যন্ত - প্রতিটি মুহূর্ত নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত। এই সম্পর্কগুলি ভবিষ্যতে যौথ গবেষণার দ্বার খুলে দিতে পারে। একটি পরামর্শ- কোনো নির্দিষ্ট দলের সাথে সম্পূর্ণ সময় না কাটিয়ে ভিন্ন ভিন্ন গবেষকের সাথে আপনার কফি বা লাঞ্চ টেবিল শেয়ার করে নিতে পারেন।

নিজের কাজকে তুলে ধরার সুযোগ
গবেষণা কেবল গবেষণাগারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে তার পূর্ণ মূল্যায়ন সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করার মাধ্যমে আমরা আমাদের কাজের প্রতি বিশ্বব্যাপী মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেন। একটি বহুল প্রচলিত উদ্ধৃতি- A candle loses nothing by lighting another candle (James Keller). সহজ কথায় বলতে গেলে-প্রচারেই প্রসার। 

কনফারেন্সকে আরও ফলপ্রসূ করার উপায়

• সক্রিয় অংশগ্রহণ: শুধু দর্শক হয়ে বসে না থেকে আলোচনায় অংশগ্রহণ করুন, প্রশ্ন করুন, এবং নিজের মতামত দিন। 

• নেটওয়ার্কিং: কফি ব্রেক, লাঞ্চ, এবং অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হন। তাদের সাথে আপনার গবেষণা এবং আগ্রহ নিয়ে কথা বলুন। 

• পোস্টার সেশন: পোস্টার সেশন হল আরও গভীরভাবে আলোচনা করার একটি চমৎকার সুযোগ। আপনার পোস্টারের সামনে দাঁড়িয়ে অন্যদের সাথে আপনার কাজ নিয়ে আলোচনা করুন। 

• নোট নিন: কনফারেন্সে শোনা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং ধারণাগুলো নোট করে রাখুন। এটি পরে আপনার কাজে লাগবে। 

• ফলো আপ: কনফারেন্সের পর নতুন পরিচিতদের সাথে ইমেইল বা লিঙ্কডইনের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখুন।

• বিজনেস বা ভিজিটিং কার্ড: নিজের কার্ড সাথে রাখতে পারেন, চেষ্টা করুন কার্ড বিনিময় করতে। ভিসিটিং কার্ড না থাকলে, বিশেষ করে ছাত্র-ছাত্রীরা কার্ড বানিয়ে নিয়ে যাবেন, আপনার সাথে সোগাযোগের মাধ্যম এবং আপনার  সংক্ষিপ্ত পয়েন্ট (Highlights) উল্লেখ করুন। 

কনফারেন্স শুধু একটি অনুষ্ঠান নয়, এটি একটি শিক্ষণীয় যাত্রা। প্রতিটি সম্মেলন আপনাকে নতুন কিছু শেখায়, নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয় । এটি শুধু জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্র নয়, বরং এটি ব্যক্তিগত ও পেশাগত বিকাশের একটি অনন্য মাধ্যম।

লেখক: পিএইচডি ক্যান্ডিডেট, আই আই টি হায়দরাবাদ, 
অ্যালুমনি, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি এবং ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট)।


সর্বশেষ সংবাদ