তবে কি সেদিন হত্যার উদ্দেশ্যেই সাংবাদিক রিয়াজের ওপর হামলা করেছিল চবি ছাত্রলীগ?

মো. জাহিদুল হক
মো. জাহিদুল হক  © সংগৃহীত

১৯ জুলাই (শুক্রবার) রাত তখন ১০ টা বেজে ৪৫ মিনিট। ক্যাম্পাসে বিদ্যুৎ নেই, হালকা বৃষ্টি, শাটডাউন চলছে, একটু পরেই কারফিউ জারি হবে। শিবির সন্দেহে দুই শিক্ষার্থীকে বেধড়ক মারধর করে জিরো পয়েন্ট পুলিশ বক্সে নিয়ে এসেছে চবি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। বিষয়টি জানতে পেরে সেখানে গেলাম। এরই মধ্যে পুলিশ বক্সে উপস্থিত হন চবি সাংবাদিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আজহার, সাধারণ সম্পাদক রোকনুজ্জামান, যুগ্ম সম্পাদক শাহরিয়াজ মোহাম্মদ ও রেদওয়ান ভাই। এসে জানতে পারলাম কোনো একসময় ফেসবুকে সরকার বিরোধী পোস্ট ও ম্যাসেজ আদান-প্রদান করার কারণে ওই দুই শিক্ষার্থীকে মারধর করে লীগের নেতাকর্মীরা। ওই সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে যে নিজেরাই সংবাদের উৎস হয়ে যাব সেটা স্বপ্নেও ভাবিনি। আরেকটু পেছন থেকে শুরু করি তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে।

১৭ জুলাই (বুধবার) সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে ছেলেদের ও রাত সাড়ে ১০টার মধ্যে মেয়েদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে দেশে বিরাজমান বিশৃঙ্খলার মধ্যে মেয়ে শিক্ষার্থীরা হল ছাড়বেনা বলে দাবি জানায়। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে ১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) সকাল ১০ টা পর্যন্ত সময় বর্ধিত করা হয় এবং নিরাপদে বাসায় পৌঁছে দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দেয় হল কর্তৃপক্ষ। তবুও যেকোনো মূল্যে হল ছাড়তে হবে। 

WhatsApp Image 2024-09-25 at 7-58-40 PM

অভিযুক্ত চবি ছাত্রলীগের এই ১১ আসামীর বিরুদ্ধে মামলা হয়

এদিকে ছেলেদের হলেরও একই অবস্থা। কোনো শিক্ষার্থীই হলে থাকতে পারবে না। সিলগালা করে দেওয়া হয় সবগুলো হল। কিন্তু হাস্যকর ব্যাপার হলো, মেয়েদেরকে হল থেকে বের করে দিয়ে ছেলেদের হলে লীগের নেতাকর্মীরা ঠিকই সিলগালা ভেঙে আয়েশ করে থাকছে। এক সহ সভাপতির মুখ থেকে শুনলাম ‘হল পাহাড়া দেওয়ার জন্যে প্রশাসনই আমাদের থাকতে বলেছে’ কি সুন্দর ভ্রাতৃত্ব প্রশাসন আর লীগের মধ্যে; চমৎকার! 

ওদিকে আর না যাই, মূল ঘটনায় আসি। প্রত্যেক হলেই লীগের নেতাকর্মীরা রুমের সিলগালা ভেঙে অবস্থান করছে জানার পরে ১৯ জুলাই (শুক্রবার) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পেশাদারীত্বের জায়গা থেকে প্রভোস্টদের জানিয়ে হলগুলো পরিদর্শন করে দেখা গেল সোহরাওয়ার্দী, আলাওল, এফ রহমান, আমানত ও শাহজালাল হলে প্রায় ২০০ এর অধিক রুমের সিলগালা ভেঙে লীগের নেতা-কর্মীরা অবস্থান করছে। পরবর্তীতে বিষয়টি প্রক্টর ও প্রভোস্টদের জানানো হলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সাংবাদিকদের হল পরিদর্শনের বিষয়টি কানে যায় নেতাকর্মীদের। অবশ্য পরিদর্শনের সময় কয়েকজনের সাথে কথাও হয়। তাদের সাথে কথা বলে জানা গেল, বাড়ি দূর হওয়ায় যেতে পারেনি বলে থাকতে হচ্ছে। 

ওইদিন (১৯ জুলাই) রাতে জিরো পয়েন্টে শিবির সন্দেহে দুই শিক্ষার্থীকে আটক করার ঘটনাটি দেখতে এসেই লীগের হামলার শিকার হন চবি সাংবাদিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক ও দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার সাংবাদিক শাহরিয়াজ মোহাম্মদ ভাই। মুখে কাপড় পেঁচিয়ে বেধড়ক মারধর করা হয় তাঁকে। ওই সময় লীগের উপগ্রুপ ভিএক্স, সিএফসি, বিজয়, সিক্সটি নাইন, একাকার, কনকর্ড  সবগুলো গ্রুপের নেতা ও তাদের চেলাচামুণ্ডারা উপস্থিত ছিল (আরেকটি বিষয়, কোটা আন্দোলনের ওই সময়ে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ছাড়া সাধারণ শিক্ষার্থী একদমই ছিল না, যারা ছিল তাদের সবাই শহরে অবস্থান করছিল)। 

হামলার স্থান

আক্রমণের ৩০ সেকেন্ড আগে কৌশলে ‘প্রক্টর ডাকছে’ বলে নেতারা পুলিশ বক্সের ভিতরে চলে যায়। তাৎক্ষণিক কিছু বুঝে ওঠার আগেই সাদা একটি গেঞ্জি মাথায় পেঁচিয়ে ১০ থেকে ১৫ জন ছাত্রলীগের পা-চাটা কর্মী উপর্যুপরি কিল-ঘুষি মারতে থাকে রিয়াজ ভাইকে। একদম পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি, আজহার ভাই, রোকন ভাই ও রেদওয়ান ভাই। সবাই মিলে প্রোটেক্ট করে পুলিশ বক্সের ভিতরে নিয়ে আসি রিয়াজ ভাইকে। রডের ব্যবহারও করেছে সন্ত্রাসী ছাত্রলীগের কর্মীরা। যেটি মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পর পিঠের দাগ দেখে বুঝতে পারি। ওই সময় আমরা উপস্থিত না থাকলে আল্লাহ না করুক কি করুণ অবস্থা হতো ভাবলেই গাঁয়ে কাটা দিয়ে ওঠে।

পরিকল্পিত এ আক্রমণের শেষে শুরু হল নেতাদের নাটক। সবাই একের পর এক এসে আমাদের উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো ‘গেইটে সিসি টিভি আছে, ওইটা দেখে শনাক্ত করে দিবি, আমরা সবকয়টার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব’। মজার বিষয় হল তারা যে নাটক করছে এটা বুঝা গেল তখন, যখন জানতে পারলাম সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে রাখা হয়েছে আগেই এবং এ বিষয়টি তারা ভালো করেই জানতো। যাইহোক এই ঘটনার সাথে যে প্রশাসন জড়িত তারও প্রমাণ পাওয়া গেল প্রক্টর অহিদুল আলমের মন্তব্যে। তিনি ঘটনা শুনার পর বললেন, ‘এক হাতে তালি বাজে না’। শুধু তাই নয়, যখন রিয়াজ ভাইয়ের ওপর আক্রমণ করা হয় তখন পুলিশ বক্সে উপস্থিত ছিলেন দুই সহকারী প্রক্টর। 

ভুক্তভোগী শাহরিয়াজ মোহাম্মদ

ছাত্রলীগের পরিকল্পনা অনুযায়ী সেদিনের আক্রমণ ব্যর্থ হয়নি। ইন্টারনেট বন্ধ তাই নিউজ করা যাবে না, বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিয়েছিল তাই কারও চেহারা দেখা যাবে না, ক্যাম্পাস বন্ধ তাই প্রশাসনিক কোনো পদক্ষেপও নেওয়া যাবে না। কিন্তু তারা এটা জানতো না যে ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের ফলে যেই মসনদটি তারা এতদিন ধরে রেখেছিল সেই মসনদটি এত অল্প সময়ে গুড়িয়ে পড়বে! 

হ্যাঁ দীর্ঘ ১ মাস পর গত ৪ সেপ্টেম্বর (বুধবার) আক্রমণকারীদের শনাক্ত করে লীগের কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার একটি কালো অধ্যায় ছিল জুলাই মাসের প্রতিটি দিন। সে আলাপ নাহয় অন্য আরেকদিন করব। 

শুধু মনে করিয়ে দিতে চাই, ক্ষমতা কখনোই চিরস্থায়ী হয় না। আজ আপনি ক্ষমতাবলে শোষণ, নির্যাতন-নিপীড়ন করছেন, এসব আপনার কাছেই ফিরে আসবে দিগুণ হয়ে। সেটা এপারে ভোগ না করলেও ওপারে ভোগ করতে হবে ঠিকই। 


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence